অফবিট

১৯৭১ এর ভারত-পাক যুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনী কেন ঢাকার সরকারি ভবনে আক্রমণ করেছিল?

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে ১৯৭১ সালের কথা স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে। এই বছরই ভারত পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশাল জয় লাভ করেছিল, শুধু জয়লাভই নয় বরং পাকিস্তান দেশটিকে ভেঙে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ তৈরি করেছিল ভারত। 

১৯৭১ সালের যুদ্ধ ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন ছিল কারন এইসময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল বিশ্বের বেশীরভাগ শক্তিশালী দেশ গুলো। কিন্তু ভারতের পক্ষে ছিল মাত্র দুটি দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইসরায়েল। তা সত্বেও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র, আইবি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাধারন বীরত্বে ভারত বিজয় লাভ করে। যার ফলস্বরূপ ৯৩,০০০ পাকিস্তান সেনা আত্মসমর্পনের মাধ্যমে লজ্জাজনক ভাবে পরাজিত হয় পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে ভারতের বিজয়ের জন্য ভারতের তিন বাহিনী একাধিক গুরুত্বপূর্ন অপারেশন করে। ঠিক এমনই একটি অপারেশন করেছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বায়ুসেনা যা যুদ্ধে ভারতের বিজয় সুনিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। 

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে পাকিস্তান রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়ে। পশ্চিম সেক্টরে ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তান বায়ুসেনার মেরুদন্ড ভেঙে দেয় যার কারনে পূর্ব সেক্টরে পাকিস্তান যুদ্ধবিমান পাঠাতেই পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানে সেসময় প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনা ছিল যারা বাঙ্গালীদের উপর নারকীয় অত্যাচার করছিলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার আগে র বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সশস্ত্র প্রশিক্ষন ও অস্ত্র সরবরাহ করে আসছিলো। এরপর ভারত ঠিক করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের কোনঠাসা করবে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জাতিসংঘের উদবাস্ত সংস্থার প্রতিনিধি জন কেলির উদ্দেশ্যে একটি ফোন আসে। যেখানে জন কেলিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি গভর্নর আব্দুল মালিক অনুরোধ করে ঢাকার গভর্নর হাউসে একটি গুরুত্বপূর্ন বৈঠক হবে যাতে জন কেলি এবং রেড ক্রশের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে হবে। এই বৈঠক অত্যন্ত গোপনভাবে আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের এই ফোন ট্যাপ করে নেয় ভারতীয় বায়ুসেনার বিশেষ বিভাগ। ফোন ট্যাপ করে এটাও জানা যায় ওই গোপন বৈঠকে পূ্র্ব পাকিস্তান বায়ুসেনার প্রধানও উপস্থিত থাকবে। এই তথ্য সাথে সাথে জানানো হয় শিলং এ পূর্ব ভারতীয় বায়ুসেনার এয়ার ভাইস মার্শাল চরনদাস গুরুদাস দেবাশরকে। ঠিক হয় ভারতীয় বায়ুসেনা ঢাকার সরকারি ভবনে হামলা করবে যার উদ্দেশ্য পাকিস্তানের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি যাতে তারা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। ঠিক হয় ১৪ ডিসেম্বর দুপুর বারোটায় ঢাকার সরকারি ভবনে ভারতীয় বায়ুসেনা বোম্বিং করবে। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমাগত কোনঠাসা হয়ে পড়তে থাকে পাকিস্তানি সেনা। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতের প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনীর কাছে রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছিল পাক সেনা। সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমের নিয়াজিকে প্রশ্ন করা হয় পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের আধিপত্য তৈরি হয়েছে কীনা, উত্তরে জেনারেল নিয়াজি আত্মবিশ্বাসের সাথে জানায় তার শেষপর্যন্ত যুদ্ধ করবে। উপরে আত্মবিশ্বাস দেখালেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজনীতিবিদরা সেসময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভয়ে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এদিকে ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার সরকারি ভবনে বৈঠক শুরু হয় পাকিস্তানের মন্ত্রীমন্ডলের মধ্যে। কিছুক্ষন পর সেখানে উপস্থিত হয় জন কেলি। গভর্নর আব্দুল মালিক নিজে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়। বৈঠকে যথেষ্ট চিন্তিত ছিল আব্দুল মালিক। জন কেলি সরাসরি জানায় পূর্ব পাকিস্তানে যে পরিস্থিতি তাতে যত দ্রুত সম্ভব পাকিস্তানের মন্ত্রী মন্ডলীকে ইস্তাফা দিয়ে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নেওয়া দরকার। তাদের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব জন কেলি স্বয়ং নেবে বলে জানায়। কিন্তু এই প্রস্তাবে অসম্মত হয়ে আব্দুল মালিক জানায় তারা ইস্তাফা দেবে না বরং তার পরিবারকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে নিরাপত্তা দেবার জন্য অনুরোধ করে। জন কেলি এই প্রস্তাবে সম্মত হয়। বৈঠক চলছিল ইতিমধ্যেই ভারতীয় বায়ুসেনা ঠিক দুপুর বারোটার সময় বোম্বিং শুরু করে।

ভারতীয় বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল হারিশ মাসান্দ এক সাক্ষাৎকারে জানান ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি ও তার সাথীরা প্রতিদিনের মতো সকালে কফি খাচ্ছিলেন গৌহাটির এয়ারবেসে। তারা প্রতিদিন খবর পাচ্ছিল ভারত একের পর এক গুরুত্বপূর্ন মিশন করছিলো কিন্তু তারা তখনও যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি। সেজন্য তারা একটু বিরক্তও ছিল। প্রতিদিন বিমান ওড়ানো, নজরদারি করে আবার বেসে ফিরে আসার এই কাজই করছিলো তারা। বাকী সব ইউনিট যখন যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে তখনও তারা যুদ্ধে অংশ নিতে না পারার কারনে সেদিন উইং কম্যান্ডার ভূপেন্দ্র বিষ্নোইকে বাধ্য হয়ে তিনি জানান তারা কবে যুদ্ধে অংশ নেবে। এরকমই আলোচনা চলছিলো নিজেদের মধ্যে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে খবর আসে ঢাকার সার্কিট হাউসে আক্রমন করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব সেজন্য দ্রুত তৈরি হতে হবে। সাথে সাথে এয়ার বেসে যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। আক্রমন করার কথা ছিল ঢাকার সরকারি ভবনে কিন্তু কোন কারনে ভুল করে সেটা সার্কিট হাউস লেখা হয়ে যায়। এই মিশনের জন্য মিগ-২১ যুদ্ধবিমান কে বেছে নেওয়া হয়। উইং কম্যান্ডার ভূপেন্দ্র বিষ্নোই সহ ফ্লাইং অফিসার হারিশ মাসান্দ এবং আরও দুই পাইলট মোট চারজন তৈরি হয় এই মিশনের জন্য। মিগ-২১ যুদ্ধ বিমানকে তৈরি করা হয়, রকেট ইনস্টল করা হয়। পাইলটদের কাছে ঢাকার কোন মানচিত্র ছিলনা, ঢাকার পর্যটক মানচিত্রই ভরসা ছিল। যখন উইং কম্যান্ডার তার যাত্রা শুরু করবে, তখনই এক অফিসার দৌড়াতে দৌড়াতে এসে জানায় লক্ষ্য পরিবর্তন হয়েছে। সার্কিট হাউসের বদলে ঢাকার সরকারি ভবনে আক্রমন করতে হবে। উইং কম্যান্ডার ভূপেন্দ্র বিষ্নোই এর সামনে সমস্যা তৈরি হয়ে যায় কারন তাদের কাছে ঢাকার সরকারি ভবনের অবস্থান সম্পর্কে কোন তথ্যই ছিলনা। তখন ঘড়িতে সময় সকাল ১১ঃ২৫, তাদের ১১ঃ৫০ এর মধ্যে ঢাকার সরকারি ভবনের কাছে পৌঁছাতে হত। মাত্র ২৫ মিনিট সময় ছিল হাতে। গৌহাটি থেকে ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগে কুড়ি মিনিট। লক্ষ্য পরিবর্তনের কথা তিনি সহকারী পাইলটদের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে জানাতেও পারছিলেননা কারন ট্রান্সমিটার জ্যামের ভয় ছিল। সেকারনে তিনি নিজের বিমান সবার আগে রেখে উড়ান শুরু করেন। এদিকে গৌহাটি থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে হাসিমারাতে ৩৭ নং স্কোয়াড্রনের উইং কম্যান্ডার স্বরূপকৃষ্ণ কলকেও দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকার সরকারি ভবনের উপর আক্রমনের। অর্থাৎ ভারতীয় বায়ুসেনার গৌহাটি ও হাসিমারা এয়ারবেস থেকে মিগ-২১ এর দুটি দল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। প্রথমে স্বরূপকৃষ্ণ কল ও তার দল ঢাকায় পৌঁছে দুই থেকে তিন চক্কর কাটে যাতে সাধারন মানুষ দূরে চলে যাওয়ার সময় পায় এবং তাদের কোন ক্ষতি নাহয়। এবার উইং কম্যান্ডার ভূপেন্দ্র বিষ্নোই ও তার দল ঢাকা এসে পৌঁছায়। এখানে ভাগ্য সহায় হয় ভূপেন্দ্র বিষ্নোই এর, তিনি ঢাকায় দেখতে পান একটি বিশাল বাড়ি যার সামনে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এবং বাড়ির মাথায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়ছে। তিনি সাথে সাথে ওই বাড়িতেই আক্রমনের নির্দেশ দেয়। উইং কম্যান্ডার ভূপেন্দ্র বিষ্নোই ও তার দল মোট ১২৮ টি রকেট ছোঁড়ে ঢাকার সরকারি ভবনকে লক্ষ্য করে। এরপর তার দল ফিরে যায়। সাথে সাথে দ্বিতীয় দফায় উইং কম্যান্ডার স্বরূপকৃষ্ণ কল ও তার দল আক্রমন শুরু করে, তারা মোট ৬৪ টি রকেট হামলা করে। অর্থাৎ দুই দফায় ঢাকার সরকারি ভবন লক্ষ্য করে ১৯২ টি রকেট হামলা করা হয়।

ভবনে থাকা জন কেলি সহ বাকী লোকেরা কোন রকমে পালিয়ে পাশের বাঙ্কারে চলে যায়। পাকিস্তানের কিছু অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান ভারতীয় মিগ-২১ লক্ষ্য করে গুলি চালায় কিন্তু একটাও মিগ-২১ এর কোন ক্ষতি হয়নি। ভারতীয় যুদ্ধ বিমান ফিরে যাবার কিছুক্ষন পর জন কেলি ও গভর্নর আব্দুল মালিক সরকারি ভবন দেখতে গিয়ে দেখেন পুরো ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। তারা দাঁড়িয়ে এসব বিষয়ে আলোচনা করছিলো ইতিমধ্যে আবারও সেখানে এসে উপস্থিত হয় দুটি ভারতীয় মিগ-২১ যুদ্ধ বিমান। এবার ককপিটে ছিল উইং কম্যান্ডার স্বরূপকৃষ্ণ কল এবং হারিশ মাসান্দ। তারা বিমান থেকে গুলি চালাতে শুরু করে। আবারও জন কেলি ও আব্দুল মালিক বাঙ্কারে পালিয়ে যায়। এরপর আব্দুল মালিক সাদা কাগজে তার ও তার মন্ত্রী সভার  ইস্তফা পত্র জন কেলিকে দিয়ে জানায় এটা রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে দিয়ে দিতে, এখন থেকে সে জাতিসংঘের আশ্রিত। এভাবে ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় চাপে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের পতন হয় এবং এর দুদিন ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় হয় পাকিস্তানের। অসাধারন বীরত্বের জন্য উইং কম্যান্ডার স্বরূপকৃষ্ণ কলকে মহাবীর চক্র এবং উইং কম্যান্ডার ভূপেন্দ্র বিষ্নোই ও ফ্লায়িং অফিসার হারিশ মাসান্দকে বীর চক্র সম্মান দেওয়া হয়।

১৯৭২ সালের ২০ নভেম্বর বাংলাদেশের সাধারন মানুষের উপর অত্যাচারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগে আব্দুল মালিককে আজীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়, ১৯৭৭ সালে জেলেই তার মৃত্যু হয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *