অফবিট

জন্ম থাকলেও মৃত্যু নেই। বীর সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একাধিক মৃত্যু রহস্য

“স্বাধীনতা দেওয়া হয়না, ছিনিয়ে নিতে হয়।” নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর এই উক্তি তৎকালীন সময়ে যুব সমাজ সহ গোটা সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অনুপ্রেরণার মন্ত্র হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের কাছে। তাঁর মতে আবেদন নিবেদনের পালা শেষ দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র মাধ্যমই হচ্ছে সশস্ত্র আন্দোলন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান ছিল অসীম। এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যু কিভাবে ঘটেছিল তা আজ পর্যন্ত রহস্যই হয়ে রয়েছে দেশবাসীর কাছে। তাই তাঁর জন্ম আছে কিন্তু মৃত্যু নেই অর্থাৎ অমর হয়ে রয়ে গেছেন পৃথিবীর কোলে।

নেতাজীর মৃত্যু কিভাবে ঘটেছিল? এই প্রশ্নটি একটি বিতর্কমূলক প্রশ্ন। একেক ঐতিহাসিক এক এক রকম ব্যাখ্যা দেয় তাঁর মৃত্যু নিয়ে।

এই মতামতগুলির মধ্যে একটি মত খুবই  প্রচলিত রয়েছে যা সরকারি দলিল-দস্তাবেজ থেকে পাওয়া যায়। এটি  হল – 

১৮ আগস্ট  ১৯৪৫ সালে  মঞ্চুরিয়া যাওয়ার পথে তাইহোকুতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। তবে এই মতের একাধিক বিরোধীতা রয়েছে। বর্তমানে রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজীর চিতাভষ্ম পরীক্ষা করে জানা গেছে যে, ওই চিতাভস্ম নেতাজীর নয়। বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছিল কিনা সেই তথ্য তদন্ত করতে গঠিত হয়েছে একাধিক কমিশন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শাহনওয়াজ কমিশন, খোসলা কমিশন এবং মুখার্জি কমিশন। প্রথম দুই কমিশন দাবী করে যে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল। তবে মুখার্জি কমিশন অর্থাৎ বিচারপতি মনোজ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন গঠিত এই কমিশনটি এই তথ্য বিপক্ষে মতামত দিয়েছিল। তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং তাইহোকু বিমানবন্দরের সমস্ত নথি খতিয়ে দেখে জানান যে সেই দিন তাইহোকুতে কোনও বিমান দুর্ঘটনাই ঘটে নি। তবে এই তদন্ত রিপোর্ট কোন কারন না দেখিয়েই সরকার বাতিল করে দেয়। মুখার্জী কমিশন এও দাবি করেছিল যে নেতাজীর মৃত্যুর প্রমাণস্বরূপ কোন ডেথ সার্টিফিকেট নেই। এছাড়াও নেতাজীর গাড়ি চালকের থেকে জানা গিয়েছিল যে  নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছে বলে সমাধিক প্রচলিত থাকলেও আসলে তাঁর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি, কারন তিনি নিজে এই ঘটনার চার মাস পর মায়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে নেতাজীকে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন সদস্য হিসাবে।

এবার প্রশ্ন হল যে তাহলে নেতাজী কোথায় ছিলেন? এই প্রশ্ন উত্তরে অনেকে বলেছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নে (রাশিয়াতে) নেতাজী বন্দী অবস্থায় ছিলেন। 

কিভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল?এই নিয়েও প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন মতামত। অনেকের মতে, সুভাষচন্দ্র বসু রাশিয়াতে গিয়েছিলেন এবং রাশিয়ান সৈন্যরা গ্রেফতার করেছিল তাঁকে। এরপর রাশিয়ার  কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি। আবার কয়েকজন বলেন যে, সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছিল সার্বিয়াতে।

নেতাজীর রাশিয়ায় যাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় বোস: দ্য ইন্ডিয়ান সামুরাই- নেতাজী ও আইএনএ সামরিক পরিসংখ্যান – বইটিতে। যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে। এই বইয়ের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জি. ডি. বকশি জানিয়েছিলেন যে নেতাজীর মৃত্যু বিমান দুর্ঘটনায় হয়নি। নেতাজী যাতে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারেন সেই কারণে জাপানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির দ্বারা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হওয়ার তত্ত্বটি এবং এই পরিকল্পনাটি তিনি করেছিলেন টোকিওতে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সহায়তায়। জাপান থেকে পালিয়ে সার্বিয়াতে যাওয়ার পর সেখান থেকে তিনি তিনটি রেডিও সিরিয়াল সম্প্রচার করেন। নেতাজী যে সেই সময়েই জীবিত আছেন তা জানতেন ব্রিটিশরা এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁর জীবিত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেওয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারের কাছে অনুরোধ করে। এরপর ব্রিটিশ সরকার অনুমতি পাওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে নেতাজীকে। ওই সময় তাঁর উপর এতটাই নির্যাতন করা হয়েছিল যে তিনি মারা যান। তবে এই তথ্যটিকে বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই।

আবার দ্বিতীয় একটি মত অনুসারে বলা হয় যে, উজবেকিস্তানের তাসখন্দে নাকি সুভাসচন্দ্রকে দেখা গিয়েছিল। এই ঘটনাটি ছিল ১৯৬৬ সালে। ওই বছর ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী পাকিস্তানের সাথে তাসখন্দ চুক্তি করতে গিয়েছিলেন উজবেকিস্তানের তাসখন্দে। চুক্তি করার পরই হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মৃত্যু হয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর। তবে এই মৃত্যুটি স্বাভাবিক ছিল না। কারন তাঁর চিকিৎসক আর. এন. চুং দাবি করেছিলেন যে, লালবাহাদুর শাস্ত্রী একদম ফিট ছিলেন। এই বৈঠকের কিছু ছবিতে দেখা যায় এমন এক ব্যক্তিকে যার চেহারা সাথে অবিকল মিল ছিল সুভাসচন্দ্র বসুর। কিছু ফরেনসিক এক্সপার্টরাও দাবি করেছিলেন ওই ব্যক্তিটি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুই। 

এছাড়াও তৃতীয় মত অনুসারে বলা হয় যে, নেতাজী আসলে হলেন ফয়জাবাদের ‘ভগবানজি’ ওরফে গুমনামি বাবা। যার মৃত্যু হয়েছিল ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালে। ফয়জাবাদের ‘ভগবানজি’ ওরফে গুমনামি বাবার সাথে চেহারাগত দিক থেকে কিছুটা মিল পাওয়া গিয়েছিল নেতাজীর সাথে। এমনটি  দাবী করা হলেও কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি এই বিষয়ে।

একাধিক তথ্য বিশ্লেষণ এবং কিছু তথ্য নেট মাধ্যম থেকে পাওয়া। এই নিয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *