অফবিট

যে অপারেশনে জইশ ই মহম্মদের কোমড় ভেঙে দিয়েছিল বিএসএফ

বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ ভারতবর্ষ, যতবার ভারতবর্ষ আক্রমনের চেষ্টা করেছে কোন শত্রু ততবার ভারতীয় সেনাবাহিনী অসাধারন বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে। চারবার ভারতের কাছে পরাজিত হয়ে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে প্রক্সি ওয়ার বা ছায়া যুদ্ধ করছে দীর্ঘদিন ধরে। পাকিস্তান সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে তাদের গোপনে ভারতে সন্ত্রাসী কাজকর্মের প্রশিক্ষন দেয়। তবে ভারতের ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক এবং বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ যথেষ্ট শক্তিশালী যার জন্য পাকিস্তানের অধিকাংশ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। বিএসএফ পাকিস্তানের প্রক্সি ওয়ারের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ একটি অপারেশন করে ২০০৩ সালে যাতে জইশ ই মহম্মদের শীর্ষ নেতা গাজি বাবাকে হত্যা করা হয়। গাজি বাবাকে জইশ ই মহম্মদের সবচেয়ে নৃশংস সন্ত্রাসী বলা হত যে কাশ্মীরের ওসামা নামেও কুখ্যাত ছিল। এই অপারেশনে জইশ ই মহম্মদের কোমড় ভেঙে দিয়েছিল বিএসএফ।

১৯৪৭ সাল থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কাশ্মীর সমস্যা জাতিসংঘও সমাধান করতে পারেনি৷ কাশ্মীরের এক অংশ পাকিস্তান অবৈধ ভাবে দখল করে রেখেছে যাকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর বা পিওকে বলা হয়। দীর্ঘদিন ধরে পিওকে থেকে ভারতীয় ভূখন্ডে সন্ত্রাসী কাজকর্মের চেষ্টা করে আসছে পাকিস্তান। পিওকেতে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষন দেওয়ার কাজ করছে পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স সংস্থা আইএসআই। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী কাজকর্ম চালানোর চেষ্টা করছে আইএসআই। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে বাহাওয়ালপুরে জন্ম হয়েছিল গাজি বাবার যার পুরো নাম রানা তাহির নাদেম। অত্যন্ত নৃশংস স্বভাবের গাজি বাবা আবু জিহাদি, সাজিদ জিহাদি, সাহবাজ খান, মুদাসির সাহবাজ সাকলাইন, আবু হিজরাট সহ একাধিক নামে পরিচিত ছিল। বলা হয় গাজি বাবা প্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল পরে জইশ ই মহম্মদ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগদান করে এবং সংগঠনটির প্রধান হয়ে ওঠে। জইশ ই মহম্মদের পাশাপাশি হারকাত উল আনসার নামে সন্ত্রাসী সংগঠনের ডেপুটি কম্যান্ডার ছিল গাজি বাবা। পিওকে এবং আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষন দিত গাজি বাবা। 

১৯৯০ এর দশকে কাশ্মীরকে অশান্ত করবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান। সেসময় জম্মু কাশ্মীরের কিছু স্থানীয় যুবককে ব্রেন ওয়াশ করে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষন দিত আইএসআই। শাহিদ কাপূর এবং বিশাল ভরদ্বাজের হায়দার সিনেমায় ১৯৯০ এর দশকের কাশ্মীরের অবস্থা দেখানো হয়েছে। জম্মু কাশ্মীরে অন্তত কুড়িটি সন্ত্রাসী আক্রমনের জন্য গাজি বাবা সরাসরি দায়ী ছিল। 

১৯৯৫ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জলার পাহেলগাঁও এ ছয়জন বিদেশী ও তাদের দুজন গাইডকে অপহরন করে হারকাট উল আনসার যার পেছনে সরাসরি দায়ী ছিল গাজি বাবা। মাসুদ আজাহার সহ বেশ কিছু হারকাট নেতাকে মুক্তি দেবার জন্য এই অপহরন করা হয়। এদের মধ্যে একজন আমেরিকান ব্যক্তি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বাকী সাতজনকে মেরে ফেলা হয়। 

১৯৯৮ সালে প্রায় ২৪ জন হিন্দু পন্ডিতকে হত্যা করে গাজি বাবা। ১৯ এপ্রিল, ২০০০ সালে এবং ২৫ ডিসেম্বর, ২০০০ সালে শ্রীনগরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সামনে দুটো গাড়ি বোমা বিস্ফোরন ঘটানোয় অভিযুক্ত ছিল গাজি বাবা। গাজি বাবার সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী আক্রমন ছিল ১৩ ডিসেম্বর, ২০০১ সালে দিল্লিতে সংসদ ভবনে আক্রমন। লস্কর ই তালিবা এবং জইশ ই মহম্মদ পাকিস্তানের দুটি জঙ্গি সংগঠন যৌথ ভাবে দিল্লির সংসদ ভবনে আক্রমন করে। এই ঘটনায় দিল্লি পুলিশের ছয় সদস্য, দুজন সংসদের রক্ষী এবং একজন মালি সহ নয়জন মারা যায় এবং আঠারো জন আহত হয়। জঙ্গিরা আত্মঘাতি বোম্ব এবং একে ৪৭ বন্দুক, গ্রেনেড লঞ্চার ব্যবহার করেছিল এই আক্রমনে। সংসদে হামলার সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানি সহ প্রায় একশো জন গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপস্থিত ছিল সংসদে। 

দিল্লি পুলিশের দাবি ছিল এই ঘটনার পেছনে পূর্ন মদত ছিল আইএসআই এর। আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএও জানায় এই আক্রমনের পেছনে ছিল আইএসআই। এই আক্রমনে জড়িত থাকা পাঁচজন জঙ্গিকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে দিল্লি পুলিশ। এই ঘটনার মাত্র এক মাস আগেই নভেম্বরে জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে এই ধরনের একটি আক্রমন করা হয় যাতে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়। দিল্লির সংসদ ভবনে হামলার অভিযোগে ২০০২ সালে চারজন জইশ ই মহম্মদ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয় যাদের মধ্যে আফজাল গুরু ছিল এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত, যাকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। 

২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী দিল্লির তিহার জেলে সকাল আটটায় ফাঁসি দেওয়া হয় আফজাল গুরুকে। আফজাল গুরুকে জিজ্ঞাসাবাদে বারবার গাজি বাবার নাম জানা যায়, যে পাকিস্তান থেকে এই আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। দিল্লির সংসদ ভবনে এই আক্রমনের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। 

২৮ আগস্ট, ২০০৩ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতের সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের একটি বৈঠকের আয়োজন করে। সেই দিনই সন্ত্রাসীরা লালচকে সন্ত্রাসী হামলা করে। এরপরেই বিএসএফ গাজি বাবাকে যে করেই হোক হত্যা করবার অপারপশন শুরু করে। ২৯ আগস্ট প্রায় ৭০ জন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে হঠাৎই সাইকেলে আসা এক ২১ বছর বয়সী স্থানীয় যুবক চলে আসে, সেনাবাহিনীর সন্দেহ হওয়ায় সেই যুবককে তল্লাশি চালায়, সেই যুবকের কাছ থেকে গ্রেনেড, একে ৪৭ বন্দুক পাওয়া যায়। সেই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায় গাজি বাবা শ্রীনগরেই লুকিয়ে আছে। 

ভারতীয় সেনাবাহিনী নাসির নামে এক কাঠের কাজ করা ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে, তার কাছ থেকে জানা যায় গাজি বাবা নূর পুরে লুকিয়ে আছে। ৩০ আগস্ট, ভোর সাড়ে তিনটেয় নূর পুরের একটি তিন তলা বাড়ি ঘিরে ফেলে বিএসএফ। বিএসএফের ৬০ এবং ১৯৩ তম ব্যাটেলিয়ন এই অপারেশনের নেতৃত্বে ছিল। এই অভিযানে নেতৃত্বে ছিল এন এন দুবে, পরে ওনাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্মান কীর্তিচক্র দেওয়া হয়। প্রথমে দুই তলায় বিএসএফের অভিযানে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, তৃতীয় তলাতে গিয়েও প্রথমে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন নাসিরকে নিয়ে যাওয়া হয় তৃতীয় তলায়, সেখানে একটি অদ্ভুত দেখতে আয়নার উপর ইশারা করে নাসির। সেই আয়নাটাকে ভেঙে ফেলতেই দেখা যায় ভিতরে পুরো একটি ঘর রয়েছে যার মধ্যে ভারী অস্ত্র সহ বেশ কিছু সন্ত্রাসী রয়েছে। সাথে সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও জঙ্গিদের মধ্যে গুলির লড়াই শুরু হয়। দীর্ঘ গুলির লড়াইয়ের পর অবশেষে মারা যায় গাজি বাবা সহ বেশ কীছু সন্ত্রাসী। 

ভোর সাড়ে তিনটে থেকে শুরু হয়ে এই অপারেশন দুপুর অবধি প্রায় এগারো ঘন্টা ধরে চলে। গাজি বাবার কাছে প্রচুর আরডিএক্স এবং ডিটোনেটর পাওয়া যায়। এই পুরো অপারেশনে নয় জন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন। অপারেশন গাজি বাবায় জইশ ই মহম্মদের শিরদাঁড়া ভেঙে যায় এবং পরবর্তী অনেক বছর কাশ্মীর উপত্যকায় জইশ ই মহম্মদের কোন অস্তিত্ব ছিলনা। অপারেশন গাজিবাবায় বিএসএফের অসাধারন বীরত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুকুটে আরও একটি সাফল্যের পালক যুক্ত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *