চীনকে সরিয়ে নেপালের হাইড্রো পাওয়ারের দায়িত্ব পেল ভারতবর্ষ
রাজেশ রায়:– ভারতবর্ষ এবং নেপালের সম্পর্ক যে কতোটা গভীর তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে বর্তমানে আবারও আরও কাছাকাছি এসেছে দুই দেশ। পশ্চিম সেতি পাওয়ার প্রজেক্ট সম্পর্কে পাশাপাশি ভারত ও নেপালের সম্পর্ক নিয়ে আজ আলোচনা করা হবে। নেপালের সেতি নদীর একদম পশ্চিম দিকে এই হাইড্রো ইলেকট্রিক ড্যাম তৈরি হবে। নেপালের সেতি ও করনালি নদীর সঙ্গম স্থল থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে তৈরি হতে যাওয়া এই ড্যামের রিজার্ভার নেপালের চার জেলা দোতি, দাদেলধুরা, বেইতাদি ও বাজহাং জেলায় অবস্থিত হবে।
নেপালে যে সেতি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্টের কাজ ভারত শুরু করতে চলেছে এই প্রজেক্টর দায়িত্বে ছিল প্রথমে চীন। ২০১২ থেকে ২০১৮ অবধি ছয় বছর চীন এই প্রজেক্টে কাজ করে তারপর চীন এই প্রজেক্ট থেকে বেড়িয়ে যায়। এবছরই ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নেপাল সফরে যান তখনই ভারতের ন্যাশনাল হাইড্রো পাওয়ার করপোরেশন বা এনএইচপিসি এই প্রজেক্টের ব্যাপারে প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করে দেয়। তবে এপ্রিল মাসে নেপালের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দিউবা যখন ভারত সফরে আসেন তখনই এই প্রজেক্টের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। শের বাহাদুর দিউবা মে মাসের প্রথমের দিকে নেপালে এটা প্রচার করে যে ভারত নেপালের পাওয়ার মার্কেটের বড় উৎস কিন্তু ভারতের একটি নীতি আছে তারা চীনের থেকে বা চীনের তৈরি কোন প্রজেক্ট থেকে বিদ্যুৎ কিনবে না। সেজন্য পশ্চিম সেতি পাওয়ার প্রজেক্ট ভারতকেই দিয়ে দেওয়া উচিৎ। এই প্রজেক্টে এর আগে চীনের একটি সংস্থা ও অস্ট্রেলিয়ার একটি সংস্থা কাজ করেছিল। চীনের থ্রি গরজেস করপোরেশনের অধীনে থাকা সিডব্লুই সংস্থা এই প্রজেক্টে কাজ করছিল। ২০১৮ সালে সংস্থাটি ৷ নেপাল সরকারকে জানায় এই প্রজেক্টে তার কাজ করতে পারবে না তারা কারন হিসাবে জানায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয় এবং এখান থেকে জনবসতি অন্যত্র সরাতে অত্যাধিক খরচা হবে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার স্নো মউন্টেন ইন্জিনিয়ারিং কর্পোরেশান লাইসেন্স বাতিল করে দেয় নেপাল সরকার। কারন তারা প্রায় ১৯৯০ থেকে ১০ বছর ধরেও প্রজেক্টের কাজ তেমন করতে পারে নি।
অস্ট্রেলিয়ার এই কোম্পানিকে বুট স্কিমের আওতায় নেপাল ৩০ বছরের জন্য লাইসেন্স দিয়েছিল সংস্থাটিকে কিন্তু আশানুরূপ কাজ না হওয়ায় লাইসেন্স বাতিল করা হয়। বুট স্কিমের পুরো অর্থ হচ্ছে বিল্ড, ওন, অপারেট ও ট্রান্সফার। যার মানে কোন বড় প্রজেক্ট কোনও প্রাইভেট সংস্থা তৈরি করে কীছু সময়ের জন্য ব্যবহার করে আবার দেশের সরকারকে ফিরিয়ে দেয়। যেমন অস্ট্রেলিয়ার এই সংস্থাটির সাথে ৩০ বছরের চুক্তি হয়েছিল। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা প্রাকৃতিক ভাবেই নেপালের অনেক বেশী কারন নেপালে ৬০০০ নদী আছে যা থেকে ৮৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। বর্ষা থেকে আরাম্ভ করে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে বরফের স্তর ভেঙে আসা নদী উৎসের অভাব নেই নেপালের। তবে নেপালের সাথে ভারতের একটু বিরোধীতা আছে কিছু প্রজেক্টের ব্যাপারে, যেগুলো ভারতীয় কিছু সংস্থা শুরু করেও সঠিক সময়ে শেষ করতে পারে নি। যেমন মহাকালী চুক্তি। ১৯৯৬ সালে হওয়া এই চুক্তি অনুযায়ী নেপালের জন্য ৬,৪৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা ছিল কিন্তু এটা আজও হয়ে ওঠে নি। আরও একটি প্রজেক্ট আছে সেটা হচ্ছে আপার কর্নালী হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট। নেপালের কর্নালী নদীর উপর হতে চলা এই প্রজেক্টে প্রায় ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন হবার কথা, যা নেপালের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হত। এতে উৎপন্ন বিদ্যুৎের বেশীরভাগ প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বাংলাদেশকে এবং ২৯২ মেগাওয়াট ভারতকে সাপ্লাই দেবার কথা, নেপাল নিজের জন্য ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রাখত। এই প্রজেক্টে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ কিন্ত এটি এখনও সম্পন্ন হয় নি, ২০২৪ এ হওয়ার কথা।
তবে ভারত ও নেপালের এই বিরোধিতা কেটে গেছে ধীরে ধীরে কারন পূর্ব নেপালের সাংখ্যুয়াসভাতে ভারত ৯০০ মেগাওয়াটের অরুন থ্রি প্রজেক্ট সম্পন্ন করছে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া এই প্রজেক্ট ২০২৩ এ সম্পন্ন হবে। ভারতের সুতলেজ বিদ্যুৎ নিগম বুট স্কীমে এই প্রজেক্ট করছে। এরজন্য সংস্থাটিকে ৬৯৫ মেগাওয়াটের অরুন ফোর নামেও একটি প্রজেক্ট দেওয়া হয়েছে। এই পচিম সেতি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্টের দয়িত্ব ভারতকে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম সেতি প্রজেক্টের মোট খরচ নেপালী মু্দ্রায় ১০৪ বিলিয়ন এবং ভারতীয় মুদ্রায় ৬৫০০ কোটি টাকা। এই কেন্দ্রে উৎপন্ন বিদ্যুৎ এর ৩১.৯ শতাংশ নেপালের মানুষকে বিনামুল্যে দেওয়া হবে। এই প্রজেক্টের ফলে যেসব মানুষকে অন্যত্র বসতি স্থাপন করতে হচ্ছে তাদের নেপালী মুদ্রায় ১০ মিলিয়ন এবং মাসে ৩০ ইউনিট করে বিদ্যুৎ বিনামূল্যে দেওয়া হবে। নেপালের সংবিধানে একটি আইন আছে যখনই সরকার বাইরের কোন দেশকে প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কিত কোন প্রজেক্ট দেবে তার জন্য সংসদে তিন ভাগের দুই ভাগের অনুমতি লাগবে। তবে সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে নেপাল ও ভারতোর মধ্যে রাজনৈতিক ঝামেলা রয়েছে। ঐতিহাসিক ভাবে নেপাল ভারতের যথেষ্ট বন্ধু দেশ এবং ধর্মীয় দিক থেকেও নেপাল ঘোষিত হিন্দু দেশ। কিন্তু নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলির সময় থেকে নেপালের সাথে ভারতের ঝামেলা শুরু হয়। নেপালে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি চীনের বিআরআই এর মতন প্রকল্প এবং ২০১৯ সালে নেপাল ভারতের কীছু অংশ তাদের ম্যাপে নিজেদের বলে দাবি করে, এই নিয়ে দীর্ঘকাল নেপাল ও ভারতের সম্পর্ক শীতল হয়েছে একটু। তবে নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দিউবার সময়ে ভারত ও নেপালের সম্পর্কের উন্নয়ন হচ্ছে যথেষ্ট। নেপালের বিদ্যুৎ এর অভাব রয়েছে যথেষ্ট। এই মহূর্তে নেপালের ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র দরকার কিন্তু নেপাল করছে ৯০০ মেগাওয়াটের সুতরাং ঘটতি রয়েছে। এদিকে নেপাল থেকে ভারত ৩৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনে। পশ্চিম সেতি এই পাওয়ার প্রজেক্ট শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয় বরং এর রিজার্ভের জলে চাষ, মাছ উৎপাদন সহ এটি বন্যা নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখবে, ফলে বিদ্যুৎ এর দাম কম হবে এবং ভারত ও নেপাল দুই দেশেরই সুবিধা হবে। তবে কীভাবে প্রজেক্ট এগোবে কখনও সেব্যাপারে কোনও তথ্য তেমন দেয়নি এনএইচপিসি। প্রথমে ঠিক ছিল এখানে ৭৫০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র তৈরি করা হবে কিন্তু এখন ঠিক হয়েছে ৯০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। এখানে উৎপন্ন বিদ্যুৎ ভারতকেও সরবরাহ করা হবে।