ডিফেন্স

পরমানু অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে “ভারতবর্ষের নো ফাস্ট ইউজ পলিসি”। দেশের উপর আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ এই নীতি?

রাজেশ রায়:– পৃথিবীতে পারমানবিক অস্ত্র তৈরি ও তার দ্রুত বৃদ্ধির কারন দুটি দেশ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদের দুজনের মধ্যে হওয়া স্নায়ু যুদ্ধের কারনেই বিশ্বে পারমানবিক অস্ত্র তৈরির এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ১৯৯১ এর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার সাথে সাথে এই স্নায়ু যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় তবুও আজ বিশ্বের কয়েকটি দেশের কাছে এতটাই পরমানু হাতিয়ার রয়েছে যে তা দিয়ে গোটা বিশ্বকে কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব। পরমানু অস্ত্র মানবজাতির পক্ষে হুমকি হলেও, এটি যেকোনও দেশের কাছে একটি আশীর্বাদ স্বরুপ। একটু ভাল করে বলি সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ যদি দেখেন তাহলে দেখবেন রাশিয়ান সেনা ইউক্রেনে ঢুকে অপারেশন করছে। ১৯৯৪ সালে বুদাপেস্ট চুক্তি অনুযায়ী ইউক্রেন তার সমস্ত পারমানবিক অস্ত্র রাশিয়াকে দিয়ে দেয়। আজ যদি ইউক্রেনের কাছে পরমানু অস্ত্র থাকত তাহলে রাশিয়াকী এত সহজে ইউক্রেনকে আক্রমন করতে পারত? উত্তর হবে না, এই জন্য পরমাণু হাতিয়ার যেকোনও দুর্বল দেশের কাছে বিমার মতন আবার কোনও বড় দেশের কাছে আরও শক্তিশালী হবার অস্ত্রের মতন। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে এটা প্রমান হয়ে গেছে যদি নিজেদের পরমানু যুদ্ধাস্ত্র না থাকে তাহলে বাইরে থেকে কোনও বন্ধু দেশ সাহায্য করবে না পরমানু অস্ত্র দিয়ে। আমেরিকা, ইউরোপ ইউক্রেনকে যত সাহায্যই করুক না কেন তারা সরাসরি রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করবে না, কারন বিশ্বে সবচেয়ে বেশী পরমানু হাতিয়ার আছে রাশিয়ার। এই একই ভাবে চীন ও তাইওয়ানকে ভয় দেখায়। যদি আমাদের দেশ ভারতের কথা বলি তাহলে আমাদের প্রধান দুই শত্রু দেশ পাকিস্তান ও চীন উভয়েই পরমানু ক্ষমতা সম্পন্ন দেশ। কিন্তু ভারতের নো ফাস্ট ইউজ পলিসির সুযোগ নিয়ে অরুনাচল প্রদেশ, লাদাখের কাছে সীমান্তে চীন প্রায়ই বাড়াবাড়ি করে। তবে কী ভারতের উচিত নো ফাস্ট ইউজ পলিসি তুলে দেওয়া??? আজ এসম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

ভারতের পরমানু অস্ত্র তৈরির যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৮ এর পরের দিকে যার নেতৃত্বে ছিলেন ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। কিন্তু সেসময় ভারতের পরমানু পোগ্রাম ছিল সিভিলিয়ানদের জন্য। অর্থাৎ দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নয়ন সহ দেশের উন্নতির জন্য, হাতিয়ার তৈরির জন্য তখন পরমানু টেকনোলজি ব্যবহার করার কথা দূর দূরান্তেও ছিল না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু নিজেও নিউক্লিয়ার ওয়েপনস এর বিরোধী ছিলেন। তিনি নিজে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পরমানু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা বন্ধের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ১৯৬২ সাল থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। এই সময় ভারত চীন যুদ্ধে ভারত হেরে যায়। এরপর চীন তাদের প্রথম পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে। 

১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর ভারত বুঝতে পারে এবার সময় এসেছে পরমাণু অস্ত্র তৈরির কারন শান্তির মাধ্যমে সবকিছু সমাধান সম্ভব না। ১৯৬৮ সালে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব আনা হয় যার নাম এনপিটি বা নিউক্লিয়ার নন প্রলিফিরেশন ট্রিটি যাতে বলা হয় জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ছাড়া বিশ্বের কোনও দেশ পরমাণু হাতিয়ার তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু ভারতের শত্রু দেশ চীনের কাছে পরমানু অস্ত্র থাকায় ভারত আজও এই চুক্তি সই করে নি। এরপর ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। এর তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে পোখরানে প্রথম পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে যাকে অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধা বলা হয়। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তান তার পরমানু কার্যকালাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৯৮ সালের ১১ ও ১৩ মে ভারত পাঁচটি পরমানু পরীক্ষা করে। এর পর আমেরিকা ভারতের সমালোচনা করে। কিন্তু ততক্ষনে অফিসিয়ালি ভারত পরমানু অস্ত্রের অধিকারী হয়ে যায়। এরপর ২০০৩ সালে ভারত তার নিউক্লিয়ার ডকট্রিন লঞ্চ করে যাতে বলা হয় ভারতের হাতে এতটা পরমানু হাতিয়ার থাকা দরকার যাতে শত্রু আক্রমন করতে ভয় পায়। ঠিক কতটা সংখ্যক পরমানু হাতিয়ার থাকার কথা সেটা কোথাও বলা হয় না তবে অনুমান করা হয় সংখ্যাটা ৫০০। তবে সংখ্যায় সবকীছু নির্ভর করে না কোন স্ট্রাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পরমানু অস্ত্র ইনস্টল করা হচ্ছে সেটা দরকারী। যেমন ইসরায়েলের কাছে নিউক্লিয়ার ওয়েপনস অনেক কম কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এগুলো মোতায়েন করে রেখেছে। ভারতের নিউক্লিয়ার ড্রকটিনে কতগুলো বিশেষ কথা বলা হয়েছে। যেমন নো ফাস্ট ইউজ পলিসি অর্থাৎ ভারত আগে থেকে কারও উপর পরমানু আক্রমন করবে না, কিন্তু ভারতের উপর আক্রমন হলে ভারত জবাব দেবে। ভারত কোনও নন নিউক্লিয়ার দেশের উপর পরমাণু বোম্ব ব্যবহার করবে না। ভারতের পরমানু অস্ত্র ব্যাবহারকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিতর্ক তৈরি হয়েছে এই নো ফাস্ট ইউজ পলিসি নিয়ে।

দুটি গ্রুপ রয়েছে ভারতে এক পক্ষের দাবি এই নীতি অটুট রাখা হোক কিন্তু অন্য পক্ষের দাবি বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পলিসি পরিবর্তন করা হোক। দুটি মতবাদই এক এক করে জানা যাক। প্রথমে জানা যাক নো ফাস্ট ইউজ পলিসি কেনো দরকারী? ১৯৯৮ সালে ভারতের পরমানু বোম্ব পরীক্ষার পর ভারতের উপর প্রচুর আন্তর্জাতিক চাপ আসে। এমন অবস্থায় এই নো ফাস্ট ইউজ পলিসি গ্রহন করে ভারত বিশ্বের সামনে একটি দায়িত্বশীল নিউক্লিয়ার পাওয়ার দেশ হিসাবে উদাহারন তৈরি করল। এই কারনেই ২০০৫ সালে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সিভিল নিউক্লিয়ার চুক্তি হয়। বাকী ইউরোপীয়ান দেশ গুলোও ভারতকে পরমানু পাওয়ার দেশ হিসাবে গ্রহন করে। এমনকী মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম বা এম টি সি আরের সদস্য হয় ভারত এবং নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপের জন্য আবেদন করেছে ভারত। এবার দেখা যাক কেন নো ফাস্ট ইউজ পলিসি তুলে নেওয়া দরকার। ভারতের একদিকে রয়েছে পাকিস্তান এবং অন্যদিকে চীন। চীনের বিশাল ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করা মানে আমাদের অর্থনীতির উপর চাপ দেওয়া যার জন্য পরমানু হাতিয়ার ভারতের সবচেয়ে বড় ইনশিওরেন্স। এর জন্য সবার প্রথমে নো ফাস্ট ইউজ পলিসি তোলা দরকার। ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী স্বর্গীয় মোনোহর পারিকর এবং ২০২০ সালে বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এই বিষয়ে কথা বলেছিলেন। লক্ষ করার মত বিষয় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স কেউই নো ফাস্ট ইউজ পলিসি ফলো করে না। রাশিয়া একটা সময় এই পলিসি ফলো করত কিন্তু এখন করে না। পাকিস্তান বিগত কয়েক বছরে টেকটিক্যাল নিউক্লিয়ার মিসাইল বানিয়েছে অনেক যা খুব সহজেই জঙ্গি গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে তাই ভারতের নো ফাস্ট ইউজ পলিসি বদল দরকার। তবে নো ফাস্ট ইউজ পলিসি তুললে খরচ অনেক বেড়ে যাবে ভারতের। কারন পরমানু অস্ত্র কে সবসময় রেডি রাখতে রক্ষনাবেক্ষম খরচ অনেক বেশী, সাথ সাথে ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট ও টেকনিক্যাল সেক্টরে অনেক বেশী বিনিয়োগ করতে হবে। ২০০৩ এর থেকে এখন ২০২২ এ পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। আজ আমেরিকা সহ ইউরোপ ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধ করছে না পরমানু যুদ্ধের ভয়েই। এই ভয় চীনের মনেও গেঁথে দিতে হবে ভারতকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় নি পরমানু অস্ত্রের কারনেই। অর্থাৎ অনেক সময় বিধ্বংসী অস্ত্র মানব জাতির জন্য আশীর্বাদ রুপেই আসে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *