অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টের পাশাপাশি দেশের ছোট ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে ই কমার্সে বিরাট পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় সরকারের
গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে ভারত ডিজিটালাইজেশনের পথে হাটছে। ইতিমধ্যেই ভারতের অর্থনীতি ও সামাজিক মাধ্যমের বড় অংশ ডিজিটাল হয়ে গেছে যার সবচেয়ে বড় উদাহারন আধার কার্ড যা ভারতের ১.৩ বিলিয়ন লোককে যুক্ত করেছে। আজ এই আধার দেশের মানুষের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র হিসাবে কাজ করে। আধারের মাধ্যমে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল সুবিধাভোগী দেশে পরিনত হয়েছে। কারন হাজার হাজার কোটি টাকা দুঃস্থ মানুষদের অ্যাকাউন্টে খুব সহজেই পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। ব্যাঙ্কের সাথে আধার কার্ড যোগ করে আর্থিক লেনদেন প্রচুর সুবিধা হচ্ছে। সহজেই টাকা জমা ও তোলা যাচ্ছে। এভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কয়েক মিলিয়ন ডলারের লেনদেন করে ভারত। এছাড়া ভারত বর্তমানে ইউপিআই বা ইননিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস তৈরি করেছে যা ডিজিটাল সেক্টরে বিপ্লব এনে দিয়েছে। ২০১৬ সালে লঞ্চ হওয়া এই সিস্টেম ভারতে এতটাই সফলযে নেপাল, সিঙ্গাপুর সহ বেশ কীছু দেশ এই সিস্টেম ব্যবহার করতে চলেছে। একটি ডাটা অনুযায়ী ২০২২ এর এপ্রিল পর্যন্ত ভারত ইউপিআই এর মাধ্যমে ৫,৫৮৩ মিলিয়ন ডলার বা ৯,৮৩,০০০ কোটি টাকা লেনদেন করেছে! যা কোনওদিন কেউ কল্পনাও করেনি। ফাস্টট্যাগ নামে একটি সিস্টেম চালু হয়েছে যা রোড ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে, এর মাধ্যমে টোল প্লাজাতে কয়েক সেকেন্ডে অটোমেটিক টোল কেটে নেওয়া হয় যেকোনও গাড়ি থেকে শুধু মাত্র ২ সেকেন্ড লাগে স্ক্যান করতে। এই সিস্টেমের ব্যবহারে প্রতিদিন অন্তত ১০০ কোটি টাকা লাভ হয় ভারত সরকারের। স্বাস্থ্যখাতে উন্নত পরিষেবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আয়ুষ্মান ভারতের মোতো ডিজিটাল স্বাস্থ্য কার্ড চালু করতে চলেছে। শুধু অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যখাতেই নয় বরং ডিজিটালাইজেশনের উপর ভর করে ভারতের ই কমার্স সেক্টর ব্যাপক অত্যাধুনিক হয়েছে। আজকে ভারতোর এই ই কমার্স সেক্টর সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সাথে সাথে ভারতের ওএনডিসি বা ওপেন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কমার্সের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করা হবে। ভবিষ্যতে ওএনডিসির মাধ্যমে ভারতের কী লাভ হতে পারে সেটাও জানান হবে।
ভারতের বিশাল বাজার এবং স্মার্ট ফোনের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ই কমার্স কোম্পানির জন্য ভারত সবচেয়ে আদর্শ প্ল্যাটফর্ম। ২০১৮ সালে ই কমার্স সেক্টরের ভারতে বাজার ছিল ২২ বিলিয়ন ডলার সেখানে ২০২৭ এ বেড়ে হতে চলেছে ২০০ বিলিয়ন ডলার। এভাবে চললে ২০৩০ এ খুব সহজেই ভারত তার লক্ষ ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে পৌঁছে যাবে। বর্তমানে ভারতীয় ই কমার্স সেক্টরে সবচেয়ে বড় দুটি সংস্থা হচ্ছে অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্ট। ২০১৭ সালে অ্যামাজনই ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় ই কমার্স সংস্থা। তবে সময়ের সাথে ফ্লিপকার্ট, মিন্ত্রার মত সংস্থা গুলি তাদের মার্কেট তৈরি করেছে এবং এই সেক্টরে প্রতিযোগিতা ক্রমশ বাড়ছে। একটি সার্ভে অনুযায়ী ২০২০ সালে করোনা মহামারীর সময়ে অনলাইন বিক্রি বহুগুণ বেড়ে গেছে। ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি এবং ইউপিআই এর মতন সহজ পেমেন্ট সিস্টেমের কারনে ই কমার্স সেক্টর এত বেশী এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে যেখানে প্রতি ক্রেতা পিছু গড় ৫০ ডলার লভ্যাংশ তৈরি হত সেখানে ২০২৪ আসতে আসতে ই কমার্স সেক্টরে প্রতি ক্রেতা পিছু ৭৫ ডলার লভ্যাংশ তৈরি হবে। কিন্তু একটা সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা যায় যে ভারতীয় বাজরে শুধু বিশেষ কিছু ই কমার্স সংস্থার মোনোপলি তৈরি হয়ে গেছে এবং তারা তাদের পচ্ছন্দ মত জিনিসকেই সবচেয়ে বেশী প্রোমোশন করছে। এটা বন্ধ করতে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর একটি প্রাইভেট সংস্থার নেতৃত্বে নন প্রফিট সংস্থা ওনএনডিসি তৈরি করা হয়। ভারত সরকারের কোয়ালিটি কন্ট্রোল কাউন্সিলে ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি এন্ড প্রোমোশন মিনিস্ট্রি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ওএনডিসি এই অনলাইন মার্কেটকে নিয়ন্ত্রন করবে। ওএনডিসিকেম পূর্ন ভাবে ডিজাইন করবার জন্য নয় সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষ কমিটি তৈরি করা হয়েছে যাতে ভারতের বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্বরা রয়েছে। এই সংস্থায় রয়েছে ইনফোসিসের নন্দন নীলকানি, ন্যাশনাল হেলথ অথরিটির সিইও আর এস শর্মা, কিউসিআই এর চেয়ারম্যান আদিল জাইনুলভাই, অভান্যা ক্যাপিটালের ফাউন্ডারের অঞ্জলি বনশাল এবং ডিজিটাল ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের সহকারী প্রতিষ্ঠাতা অরভিন্দ গুপ্তা। ওএনডিসির লক্ষ দেশে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মার্কেট তৈরি যাতে সমস্ত ছোট ব্যাবসায়ীরাও বড় ব্যাবসায়ীদের সাথে সমান ভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। এর জন্য ভারত সরকার ইন্টারনেট পরিষেবার মান বৃদ্ধি করবার সাথে সাথে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তেও ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ ছোট ব্যাবসায়ীকে ভারতের বিশাল বাজরের সাথে যুক্ত করতে চলেছে। এতদিন ভারতের বাজারে অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টেরই মোনোপলি ছিল কিন্তু ওএনডিসির মাধ্যমে একটি বড় বিকল্প তৈরি হবে। গত ২৯ এপ্রিল এর জন্য ভারত সরকার দিল্লি, শিলং, ভোপাল, ব্যাঙ্গালোর ও কোয়েম্বাটুরে একটি পাইলট প্রজেক্ট শুরু করে। এই প্রজেক্টে ভারত সরকার একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করবে যা ভারতের যেকোনও প্রান্তের লোক তার কাছের জায়গা থেকে জিনিস কিনতে পারবে, সাথে সাথে এক ছাদের তলায় সব কীছুকে নিয়ে আসা হবে। অর্থাৎ ক্রেতা ফ্লিপকার্ট ও অ্যামাজনের জিনিসও এখান থেকে কিনতে পারবে।
এতদিন ই কমার্স সংস্থা গুলো বিশেষ কীছু সংস্থার জিনিস বিক্রি করত ফলে অনেক ছোট ব্যাবসায়ী ক্ষতিগ্রস্থ হত কিন্ত ওএনডিসির মাধ্যমে নিরপেক্ষ ভাবে সবাই যুক্ত হতে পারবে। আবার ধরুন কোন সংস্থার জিনিস শুধু অ্যামাজনেই পাওয়া যায় কিন্তু ক্রেতা ফ্লিপকার্টে সেই জিনিস খুঁজে পেল না তখন সে বাধ্য হয়ে অ্যামাজন অ্যাপ ডাউনলোড করে রেজিস্টার করে জিনিস কীনবে। কিন্তু ওএনডিসির মাধ্যমে কোন ক্রেতা অ্যামাজন বা ফ্লিপকার্টে রেজিস্টার না করে সরাসরি জিনিস কীনতে পারবে। আগামী আগস্ট মাস থেকে ওএনডিসি শুরু হবার কথা, একবার শুরু হলে ভারতের ই কমার্স সেক্টর পুরো বদলে যাবে। এর মাধ্যমে ২০২৭ এর মধ্যে ভারত ২০০ বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি করতে চলেছে। কিন্তু অনেক বড় সংস্থা ভারতের এই পদক্ষেপের বিরোধীতা করেছে। এদিকে ২০ টির বেশী সরকারি ও বেসরকারি ইতিমধ্যেই এতে ২.৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাঙ্ক, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক। বর্তমানে ৮০ টির বেশী সংস্থা ওএনডিসির সাথে ছোট বড় সমস্ত ব্যাবসায়রীদের যুক্ত করার কাজ চলছে। ওএনডিসির প্রধান টেকনিক্যাল এক্সপার্ট ইনফোসিসের নন্দন নীলকানির কথায় এটি গেম চেঞ্জার হতে চলেছে। এই নন্দন নীলকানিই ভারতের আধার কার্ড ও ইউপিআই সিস্টেম তৈরিতে যুক্ত ছিল। ওনএনডিসিন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হতে চলেছে যেখানে একজন ব্যাক্তি শ্যম্পু থেকে শুরু করে বিমানের টিকিট পর্যন্ত কিনতে পারবে। ফ্লীপকার্ট, অ্যামাজন ভারতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের, এই বিপুল বিনিয়োগ ও হিউজ ডিসকাউন্টের কারনে ভারতের লক্ষ লক্ষ ছোট ব্যাবসায়ী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ছোট ব্যাবসায়ীরাই দেশের রিটেল মার্কেট ধরে রাখে। এই ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন দেশের ৮০ শতাংশ রিটেল মার্কেট ধরে রেখেছে যার জন্য এরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে ভবিষ্যতে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের মত ভারতেও ছোট ব্যাবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন লোক স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা ইন্টারনেট ভারতেই পাওয়া যায় যার কারনে ভারতের বাজার বিশাল বড়। বিশ্ব জুড়ে প্রচুর কোম্পানি এই ভারতীয় বাজার দখলের লড়াইয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে ওএনডিসি ভারতের বাজারকে নিয়ন্ত্রিত ও নিরপেক্ষ রাখবে। ওএনডিসির মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অত্যন্ত ৯ লাখ কর্মসংস্থান হবে এবং গ্রামাঞ্চলে ৪ লাখ নতুন সংস্থা তৈরি হবে। বর্তমানে ভারতে ৪০০০ ছোট বড় ই কমার্স সংস্থা, ৫০০ লজিস্টিক কোম্পানি এবং ২০,০০০ কোম্পানি রয়েছে যারা ট্রাভেল, হোটেল বুকিং সব করে যার জন্য অনুমান করা হচ্ছে ২০২৬ আসতে আসতে ভারতের এই সেক্টরের মূল্য দাঁড়াবে ২০০ বিলিয়ন ডলার। ভারতে এখন আমেরিকার থেকেও বেশী ইন্টারনেট ইউজার রয়েছে যা দেশের ডিজিটালাইজেশনের জন্য সবচেয়ে বড় দিক। আগামী পাচ বছরে অনলাইন লেনদেন ৪.৫ ট্রিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ ট্রিলিয়ন করতে চলেছে ভারত। আজ বিশ্বের কোন দেশের কাছে ভারতের আধার কার্ডের মত এত বিশাল সংখ্যায় বায়োমেট্রিক কার্ড নেই এবং ভারতের মত সহজে লেনদেনের ইউপিআই সিস্টেমও নাই। সুতরাং এসব দেখে বলা যায় ওএনডিসি যথেষ্ট সফল হবে।