ডিফেন্স

ইসরায়েলের মাটিতে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের জয়। ব্যাটেল অফ হাইফা

 ইতিহাসে এমন অনেক যুদ্ধ আছে যা আজও আলোচনা করা হয়। এই সব যুদ্ধের উপরই ভিত্তি করে বর্তমান সমাজ গড়ে উঠেছে, এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যাটেল অফ হাইফা। আজ গোটা বিশ্বে ইসরায়েল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী দেশ এবং ভারতের সাথে ইসরায়েলের ব্যাপক বন্ধুত্ব রয়েছে। কিন্তু রাতারাতি এই বন্ধুত্ব তৈরি হয় নি। ইসরায়েল ও ভারতের মধ্যে এই বন্ধুত্বের বেশ কয়েকটি কারন ছিল যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই ব্যাটেল অফ হাইফা। ইসরায়েলের মাটিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্যরা তুরস্কের বিখ্যাত অটোম্যান সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করেছিল। সেসময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী এই অটোম্যান সাম্রাজ্য এই ভাবে ভারতের সেনাদের কাছে হেরে যাওয়া মানতে পারেনি অনেকেই। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এটাই যে ২০১৭-১৮ অবধি এই ব্যাটেল অফ হাইফার কথা তেমন কেউ জানতই না, বলা ভাল ভারতীয়দের দীর্ঘদিন জানতে দেওয়া হয়নি। তবে বর্তমানে মোটামুটি বেশীরভাগ মানুষই আসল সত্যি জেনে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একবার ভাষনে বলেছিলেন তিনি যখনই ইসরায়েলে যান সেখানকার প্রধানমন্ত্রী তাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের ছবি দেখান যে কীভাবে ভারতীয় সেনারা অটোম্যানদের কাছ থেকে হাইফা শহরকে মুক্ত করিয়েছিল, তিনি এটাও বলেছিলেন ফ্রান্সে ভারতীয় সেনাদের সম্মানে স্মারক রয়েছে। এই ব্যাটেল অফ হাইফা সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার। বিশ্ব দুইভাগে ভাগ হয়ে যায় একদিকে থাকে অ্যালায়েড ফোর্স এবং অন্যদিকে সেন্ট্রাল ফোর্স। অ্যালায়েড ফোর্সে ছিল আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মত বড় বড় শক্তিশালী দেশ গুলো। সেসময় ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল যার জন্য ভারতও অ্যালায়েড ফোর্সেরই অংশ ছিল। অন্যদিকে সেন্ট্রাল ফোর্সে ছিল জার্মানি, বুলগেরিয়া, অটোম্যান সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলেছিল ১৯১৪ থেকে নভেম্বর, ১৯১৮ পর্যন্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড় লক্ষ ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য কে পরাস্ত করা। সেসময় অটোম্যান সাম্রাজ্য বিশাল বড় ছিল, তুরস্ক, ইরাক, লিবিয়া, ইসরায়েল, সৌদিআরব, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, গ্রীসের বিশাল অংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিল এই অটোম্যান সাম্রাজ্য। একে হারাতে পারলে ব্রিটশ সাম্রাজ্যের আয়তন অনেক বেড়ে যেত। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইউরোপে থাকা অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু অটোম্যানের দক্ষিন ভাগ তখনও শক্তিশালী ছিল। এই দক্ষিন ভাগেই ছিল জর্ডন, ইরাক ও ফিলিস্তিনের মতন দেশ যারা অটোম্যানদের অধীনে ছিল। আচ্ছা এখানে ফিলিস্তিন বলা হল কারন তখনও ইসরায়েল তৈরি হয়নি, পুরোটাই ফিলিস্তিন ছিল। এই ফিলিস্তিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হচ্ছে হাইফা যা আজ বর্তমানে ইসরায়েলের।

হাইফা গুরুত্বপূর্ণ এই কারনে যে এখানে একটি বন্দর আছে যা দিয়ে সরাসরি বাকী প্রদেশে যোগাযোগ করা সম্ভব। ব্রিটিশদের লক্ষ ছিল এই হাইফা দখল করা যাতে ধীরে ধীরে জর্ডন, ইরাকের মতন দেশ গুলোকে মুক্ত করানো যায়। কিন্তু ব্রিটেনের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তাদের সেনা। কারন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে তখন ইতিমধ্যে চার বছর হয়ে গেছে অর্থাৎ ১৯১৮ সাল হয়ে গেছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সংখ্যাও অনেক কমে গেছে তাহলে যুদ্ধ করবে কে? তখন ব্রিটিশরা ভারতীয়দের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করতে পাঠায়। ব্রিটিশরা প্রথমে ভারতীয়দের যুদ্ধের জন্য পাত্তা দিতনা, কারন তাদের ধারনা ছিল ভারতীয়দের উচ্চতা কম ইউরোপীয়ানদের থেকে, যুদ্ধে অভিজ্ঞতা নেই সেজন্য। সেসময় সুয়েজ ক্যানেল, ফ্রান্সে ভারতীয় সেনা মজুত ছিল যাদের হাইফা পাঠানো হয় সাথে অনেক ল্যান্সারও পাঠানো। ল্যান্সার হচ্ছে ঘোড়ার পিঠে চড়া সেনা যাদের হাতে বল্লম থাকতো। দেখুন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেশিনগানের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সেসময় বন্দুক এতটা উন্নত ছিলনা, অর্থাৎ একবার গুলি করলে তারপর রিলোড হয়ে আবার গুলি চালাতে একটু সময় লাগতো, সেজন্য ল্যান্সাররা যুদ্ধ করতে পারত। এটাই বোধহয় শেষ কোনও যুদ্ধ যেখানে বন্দুকের বিরুদ্ধে ল্যান্সার ব্যবহার করা হয়। এই ল্যান্সারদের ক্যাভলারি ব্রিগেড বলা হত। ব্রিটেন তাদের ১৫ তম ক্যাভলারি ব্রিগেড যাতে ৪০০ ভারতীয় সেনা ছিল তাদের হাইফার উদ্দেশ্যে পাঠায়। সেসময় হাইফাতে প্রায় ১৫০০ অটোম্যান ও জার্মান সেনা ছিল যাদের কাছে আর্টিলারি ও মেশিনগান ছিল। শুধু একবার ভাবুন একবার ভারতীয় সেনাদের কাছে বন্দুক নেই, উপরন্তু তারা সংখ্যায়ও কম আবার তাদের অটোম্যান সাম্রাজ্যে ঢুকে আক্রমনের জন্য পাঠানো হল কারন সেসময় হাইফা অটোম্যান সাম্রাজ্য ভুক্ত ছিল। পুরো আত্মঘাতী মিশন যাকে বলে। 

প্রথমে ব্রিটেনের পরিকল্পনা ছিল নেভি দিয়ে আক্রমন করারা কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন নেভি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় যার জন্য সরাসরি স্থলপথে হাইফা আক্রমন ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু হাইফায় পৌঁছানো এত সহজ ছিল না কারন হাইফার আগে কিছু শহরের উঁচু পাহাড়ে জার্মান ও অটোম্যান সেনা মেশিনগান নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছিল। গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে ব্রিটেন ভারতীয় সেনাকে যেতে নিষেধ করে কিন্তু ভারতীয় ক্যাভলারি ব্রিগেডের প্রধান দেলপাত সিং শেখাওয়াত একটি স্ট্রাটেজি তৈরি করে যাতে তার পুরো সেনা তিনভাগে বিভক্ত হয়। দুই দল সেনা দুই দিক দিয়ে পাহাড়ে ওঠে এবং একদল সেনা নীচে দিয়ে পাঠানো হয় সাধারন ভাবেই যাতে সন্দেহ না হয়, এবং এত দ্রুত আক্রমন করা হবে যাতে শত্রু বুঝতে না পারে। এই পরিকল্পনায় ভারতীয় সেনা পাহাড়ে বসে থাকা জার্মান ও অটোম্যান সেনাকে হঠাৎ বুঝতে না দিয়ে আক্রমন করে পরাস্ত করে সরাসরি হাইফা আক্রমন করে। ভারতের যোধপুর, হায়দ্রাবাদ ও মাইসোর থেকে সেনা গিয়েছিল এখানে। হাইফা আক্রমন করার পর দুপুর তিনটের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।

ভারতীয় সেনা ১৩৫০ জার্মান ও অটোম্যান সেনাকে গ্রেফতার করে সাথে সাথে ১৭ টি আর্টিলারি গান, প্রচুর মেশিনগান, ক্যামেল গান বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাইফা ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে কিন্তু বলা হয় প্রত্যেক সাফল্যের পিছনে কিছু বলিদান থাকে। এখানেও তাই হয়, এই হাইফা বিজয়ের নায়ক মেজর দেলপাত সিং শেখাওয়াত যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত হন, ওনাকে পরে হিরো অফ হাইফা সম্মানে ভূষিত করা হয়। হাইফা দখল করেই ব্রিটেন তার আরও সেনা হাইফায় নিয়ে আসে এবং দেখতে দেখতে অটোম্যান সাম্রাজ্যের দক্ষিন ভাগকে পুরো দখল করে নেয়। সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাক, জর্ডান সব ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে। ব্যাটেল অফ হাইফা বর্তমান ইসরায়েল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল কারন ইসরায়েলের ভূমি তখন ব্রিটেনের অধীনে ছিল যা ব্রিটেন ইহুদিদের দান করে দেয়। ব্রিটেন এই যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনার সম্মানে দিল্লিতে তিন মূর্তি চক তৈরি করে, যা মাইসোর, যোধপুর ও হায়দ্রাবাদের ল্যান্সারদের প্রতীক। ২০১৮ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু এটি দেখতে যান তখন এর নাম পরিবর্তন করে তিন মূর্তি হাইফা চক রাখা হয়। এই চক ডিজাইন করেছিল রবার্ট টর রাসেল নামে একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ আর্কিটিস্ট। ইসরায়েল ব্যাটেল অফ হাইফার সম্মানে ২০১৮ সালে একটি স্ট্যাম্প পেপার তৈরি করে যাতে ভারতীয় সেনাদের ছবি ছিল। প্রতি ২৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল হাইফা ডে পালন করে। ব্যাটেল অফ হাইফার ব্যাপারে আরও জানা যায় আব্দুল বাহার ঘটনা থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ৫০-৬০ বছর আগে ফিলিস্তিন এলাকায় বাহা নামে একটি ধর্ম মত প্রতিষ্ঠা হয়। অটোমানরা এদের সহ্য করতে পারত না, যার জন্য এই ধর্ম মতের প্রবক্তার ছেলে আব্দুল বাহাকে জেলে বন্দী করে রাখা হয়। তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী উদ্ধার করে। আজও ইসরায়েলে কিছু অংশে বাহা ধর্মের প্রচলন আছে। আব্দুল বাহা তার লোকেদের বলেছিল জীবনে একবার হলেও ভারত ভ্রমনে আসতে। ব্যাটেল অফ হাইফাতে সর্ব মোট আট জন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং ৩৪ জন আহত হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *