অফবিট

ভারত মায়ানমার সীমান্তে অবাধ চলাচল বন্ধ করতে ভারত সরকারের অবাক করার মতো উদ্যোগ

২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ তিনবছর পরেও থামার কোনও লক্ষন নেই। এরকম পরিস্থিতিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক একটি গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম (এফএমআর) বা অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা বন্ধ করা হবে। ভারতের আভ্যন্তরীন সুরক্ষার জন্য, বিশেষ করে উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যার কাঠামো নিয়ন্ত্রন করার জন্য সরাষ্ট্রমন্ত্রক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

২০২৩ সালে মনিপুর সংকটের সময়েই ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে অবাধ যাতায়াত বন্ধ করবার চিন্তাভাবনা শুরু করে সরাষ্ট্রমন্ত্রক এবং ভারত মায়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ারও কথা হয় এই সময়। উত্তর পূর্ব ভারতে শান্তি বজায় রাখার জন্য ভারত মায়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করছে ভারত সরকার। 

নভেম্বর, ২০২০ সালে মায়ানমারে জাতীয় নির্বাচন হয়। আং সাং সু কীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশানাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি দল ৮৩ শতাংশ আসনে জয়লাভ করেছিল। সেই জন্য ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারী মায়ানমারের সংসদ নতুন সরকার গঠন করার ঘোষনা করে। নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার পর আং সাং সু কী ২০১৫ সাল থেকেই মায়ানমারের বেসামরিক নেত্রী ছিল। কিন্ত বাস্তবে মায়ানমারের সেনাবাহিনী তাতমাদাও কোনওদিন ক্ষমতা ছাড়েইনি। ২০০৮ সালে এক সংবিধান অনুযায়ী তাতমাদাও মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রন তাদের অধিকারে রাখে এবং সংসদে মন্ত্রীসভায় নিজেদের কিছু প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিল তাতমাদাও। সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক নেতৃত্ব থেকে স্বতন্ত্র রাখার জন্য মায়ানমারের সেনাবাহিনী এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। 

২০২০ সালের নভেম্বরে হওয়া মায়ানমারের নির্বাচন এবং ন্যাশানাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি দলের বিজয়কে অস্বীকার করে মায়ানমারের তাতমাদাও জেনারেলরা এবং ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মায়ানমার সেনাবাহিনী সংসদ ভবন ঘিরে ফলে। আং সং সু কী সহ মায়ানমারের রাষ্ট্রপতি ইউ উইন মিন্ট সহ অনেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আটক করা হয়। সেনাবাহিনী মায়ানমারে জরুরী অবস্থা জারি করে, সমস্ত গুরুত্বপূর্ন প্রশাসনিক ভবন সেনার অধীনে চলে যায়৷ পুরো দেশ জুড়ে শেয়ার বাজার সহ সব বানিজ্যিক ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায়। সেনাবাহিনী মায়ানমারে সমস্ত আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়ে যায় যে মায়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে মানুষজন খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করার জন্য এবং এটিএমের বাইরে লম্বা লাইন দেয়। ১৭ ফেব্রুয়ারী হাজার হাজার মানুষ ইয়াঙ্গুনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জড়ো হয়। পরিস্থিতি আরপ খারাপ হয়  ২০ ফেব্রুয়ারী যখন মায়ানমারের সেনাবাহিনী দুইজন নিরস্ত্র ব্যাক্তিকে গুলি করে হত্যা করে যার মধ্যে একজন ১৬ বছর বয়সী ছেলে ছিল৷ এই ঘটনার প্রতিবাদে দুইদিন পর কয়েক লাখ লোক সেনাবাহিনী বিরুদ্ধে রাস্তায় প্রতিবাদ শুরু করে। আন্দোলন বাড়ার সাথে সাথে সেনাবাহিনীও হিংসাত্মক ভাবে বিদ্রোহ দমানোর চেষ্টা শুরু করে। এর আগেও ১৯৮৮ ও ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী জন আন্দোলন দমন করবার জন্য নিরস্ত্র মানুষদের উপর গুলি চালিয়েছিল। এপ্রিল, ২০২১ এর মধ্যে সেনাবাহিনীর অত্যাচারে মায়ানমারের অনেক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ন্যাশানাল ইউনিটি গভর্মেন্ট বা এনইউজি তৈরি করে সেনা বিরোধী জনতা। এনইউজির লক্ষ্য দেশের শাসনক্ষমতা থেকে সেনাবাহিনীকে সরানো। এছাড়া মায়ানমারে বেশ কিছু সশস্ত্র সংগঠনও তৈরি করা হয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। যেমন  মে, ২০২১ সালে মায়ানমারে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স নামে একটি সংগঠন গঠন করা হয় যাতে ষাট হাজার সদস্য রয়েছে। এরা মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায়ই লড়াই করে। এনইউজি দাবী করে মায়ানমারের অর্ধেক এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। মায়ানমারের বিভিন্ন প্রদেশে বেশ কিছু সন্ত্রাসী সংগঠনও গড়ে উঠেছে দেশের এরকম সংকটজনক অবস্থার সুযোগে। মায়ানমারের এই পরিস্থিতির কারনে বহু নাগরিক ভারত সহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে শরনার্থী হিসাবে আশ্রয় নিয়েছে। 

ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে ১,৬৪৩ কিলোমিটার লম্বা আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। ভারতের চারটি রাজ্য অরুনাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মনিপুর ও মিজোরামের সাথে ভারতের সীমানা রয়েছে। অরুনাচল প্রদেশের সাথে ৫২০ কিলোমিটার, নাগাল্যান্ডের সাথে ২১৫ কিলোমিটার, মনিপুরের সাথে ৩৯৮ কিলোমিটার ও মিজোরামের সাথে ৫১০ কিলোমিটার লম্বা সীমানা রয়েছে মায়ানমারের। 

১৯৬৭ সালের সীমানা চুক্তি অনুযায়ী উভয়দেশের মধ্যে সীমানা নির্ধারন করা হয়। অতীতে ভারতের উত্তর পূর্ব অংশ বার্মার কোনবাং রাজবংশের অধীনে ছিল। ১৮০০ সালের দিকে ব্রিটিশরা এখান থেকে বার্মাকে হটিয়ে দেয়। ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ ও বর্মার মধ্যে ইয়ানদাবু চুক্তি অনুযায়ী উভয়দেশের মধ্যে সীমনা নির্ধারন হয়। কিন্তু এই সীমানা নির্ধারনের ফলে স্থানীয় কুকি, চীন, মিজো, নাগা উপজাতিরা সীমানার দুই দিকে দুটি ভিন্ন দেশের অংশ হয়ে যায়। এছাড়া এই সীমানা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে কোনও গ্রাম, এমনকী কোনও ঘরের মধ্যে দিয়েও সীমারেখা গেছে। ফলে উভয়প্রান্তের মানুষই সমস্যায় পড়েছিল। এই সমস্যা দূরীকরণে ১৯৬৮ সালে ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তবর্তী মানুষদের উভয়দিকে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত অবাধ চলাচলের অধিকার দেওয়া হয়। 

২০০৪ সালে এই চুক্তি পুনরায় সংশোধনের মাধ্যমে এই দূরত্ব কমিয়ে ১৬ কিলোমিটার করা হয়। ২০১৬ সালে নতুন সংশোধিত নীতি অনুযায়ী সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতে আসা মায়ানমারের নাগরিকদের ৭২ ঘন্টা এবং মায়ানমারে আসা ভারতীয় নাগরিকদের ২৪ ঘন্টা থাকার অধিকার দেওয়া হয়। ভারত ও মায়ানমারের সীমানায় বেশীরভাগ এলাকায় গভীর জঙ্গল ও উঁচু পার্বত্যঞ্চল রয়েছে। এই ভৌগলিক পরিবেশ এবং অবাধ চলাচল নীতির লাভ উঠিয়ে মায়ানমার থেকে জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা উত্তরপূর্ব ভারতে সান্ত্রাসী কাজকর্ম, মাদকের চোরাকারবারি, মহিলা পাচারের মতো অপরাধমূলক কাজকর্ম করে। রুয়াক, মেকং নদীর সঙ্গমে মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসের মিলিত সীমানাকে সোনালী ত্রিভুজ বলা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম চাষের কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি এই সোনালী ত্রিভুজ। এখান থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী মাদকদ্রব্যের বিশেষ করে হেরোইনের চোরাকারবারি হয়। এই সোনালী ত্রিভুজ থেকে প্রচুর হেরোইন সহ মাদকদ্রব্য অতীতে মনিপুরের মোরে সীমান্ত দিয়ে ভারতে অবৈধ উপায়ে নিয়ে আসত চোরাকারবারিরা। যার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিএসএফ ভারত মায়ানমার সীমান্তে কড়া নজরদারি করে। ফেব্রুয়ারী, ২০২১ সালে মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহের পর থেকে চীনের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে মায়ানমারের। চীন মায়ানমারের সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক পার্টনারদের মধ্যে একটি। 

২০২২-২৩ সালে চীনের সাথে মায়ানমারের ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয়েছে। চীন মায়নামারে বিগত কয়েক দশক ধরে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চীন মায়ানমারে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। মায়ানামারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে চীন ১১৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে মায়ানমারে। চীনের বিআরআই বা বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ন অংশ মায়ানমার। দেশটিতে সড়ক, রেললাইন নির্মানের পাশপাশি তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন তৈরি করছে চীন। মায়ানমারের পশ্চিমে কায়াকপিওতে বন্দর তৈরি করছে চীন। ভারত মহাসাগরে মায়ানমারের এই বন্দর চীন তার স্ট্রিং অফ পার্লস নীতিতে ভবিষ্যতে ভারতকে ঘিরে ফেলবার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। ময়ানামার ও চীনের কুটনৈতিক সম্পর্ক ভারতের জন্য চিন্তার কারন, চীন পাকিস্তানের মতোন ভারতের বিরুদ্ধে মায়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করে ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করার জন্য। 

বর্তমানে মনিপুর ও মিজোরামের কাছে ভারত মায়ানমার সীমান্তে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ চলছে এবং মায়ানমার সেনা এসব এলাকাতে এয়ারস্ট্রাইক করছে। যার কারনে প্রচুর মায়ানমার নাগরিক শরনার্থী হিসাবে ভারতে চলে আসার চেষ্টা করছে। সেপ্টেম্বর, ২০২২ সালে মনিপুর থেকে প্রায় ৪,৩০০ মায়ানমার নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। মনিপুর সরকারের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে ২,১৮৭ জন শরনার্থী এসেছে মনিপুরে, একইভাবে মিজোরামে মায়ানমার থেকে ৪৪,০০০ শরনার্থী চলে এসেছে। এসব কারনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে অবাধ চলাচল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছুসময় আগেই আরাকান আর্মি ময়ানমারের চীন রাজ্যের পেলেটওয়া রাজ্য দখল করে নেয়। কালাদান নদীর উপর অবস্থিত পেলেটওয়ার রাজ্যের সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা রয়েছে। এখানকার মূল অধিবাসী চীন জনগোষ্ঠী। এই চীন জনগোষ্ঠী ও আরাকান অঞ্চলের আরাকান আর্মি মায়নামার সেনার বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়াই করছে। পেলেটওয়া দখলের ফলে ভারত ও মায়ানামারের মধ্যে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টে সমস্যা হবে। এই আরাকান আর্মিকে সহায়তা করে চীন। সুতরাং উত্তর পূর্ব ভারতে দীর্ঘকালীন শান্তি বজায় রাখতে ভারত মায়ানমার সীমান্ত কাঁটাতার দেওয়া, অবাধ চলাচল বন্ধ করা এবং কড়া নজরদারির বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *