অফবিট

ভারতের রেলপথে পন্য পরিবহনে নতুন যুগের সূচনা করবে মোদী সরকার

যেকোনও উন্নত দেশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার পরিবহন ব্যবস্থা। কোনওদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, রেল পরিবহন ব্যবস্থা যত আধুনিক হবে তত দ্রুত পন্য পরিবহনে সুবিধা হবে। যার কারনে দেশটির বানিজ্য ব্যবস্থা আরও সমৃদ্ধ হবে এবং জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। 

২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠনের পর থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছে। একদিকে যেমন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করির নেতৃত্বে জাতীয় সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ের জাল তৈরি করা হচ্ছে পুরো দেশে, তখন তার সমান্তরালে রেলওয়ে পরিকাঠামোরও ব্যাপক আধুনিকরন করা হচ্ছে। 

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভারতের পরিবহন বিভাগে রেলওয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। পরিবহন বিভাগে বিশেষে করে পন্য পরিবহনের বেশীরভাগই মালগাড়ির মাধ্যমে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পরিবহন করা হত। কিন্তু ধীরে ধীরে ভারতে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয় ট্রাকে করে পন্য পরিবহন শুরু হয়। তবে সড়ক পরিবহনে রেল পরিবহনের তুলনায় খরচ অনেকটাই বেশী হয়। বিগত কয়েকবছর ধরেই ভারত সরকার দেশে বিশেষ ফ্রেট করিডর নির্মানে জোর দিয়েছে যাতে পন্য পরিবহনে খরচ কমার পাশাপাশি পন্যের দামও কমে যায়। ইতিমধ্যেই দুটি ফ্রেট করিডর নির্মান সম্পূর্ন হয়ে গেছে। প্রায় দুই লাখ কোটি টাকায় আরও তিনটি ফ্রেট করিডর নির্মানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ সালে ডিএফসি নেটওয়ার্কের উদ্বোধন করেছিলেন। এই ডিএফসিকে একবিংশ শতকে ভারতের পন্য পরিবহনের জন্য একটি গেম চেঞ্জার বলা হচ্ছে। 

ডেডিকেট ফ্রেট করিডর বা ডিএফসি একটি উচ্চগতির, উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন রেলওয়ে পথ। যেমন ধরা যাক দিল্লি ও কলকাতাকে সংযুক্তকারী রেলপথে চারটি রেললাইন রয়েছে, যার মধ্যে দুটি রেললাইন কলকাতা থেকে দিল্লিগামী ট্রেন এবং বাকী দুটি রেললাইন দিল্লি থেকে কলকাতাগামী ট্রেন ব্যবহার করে। ভারতের বিশাল জনসংখ্যার কারনে মালগাড়ি ছাড়াও ভারতীয় রেলওয়েতে অসংখ্য মেলট্রেন, সুপারফাস্ট ট্রেন, লোকাল ট্রেন রয়েছে। এই একই রেলপথ মালগাড়ি ও যাত্রীবাহী ট্রেন উভয়েই ব্যবহার করে। মালগাড়ির গতি খুবই ধীরগতির, তাই প্রায়ই বিভিন্ন স্টেশনের পাশে মালগাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কারন যাত্রীবাহী ট্রেনকে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য মালগাড়িকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। যার জন্য পন্য পরিবহনে সময় অনেকটাই লেগে যায়। এই কারনে কম সময়ে পন্য পরিবহনের জন্য ট্রাকে করে বেশী খরচেও পন্য পরিবহন করতে বাধ্য হয় বিভিন্ন সংস্থা। তাই ভারত সরকার মালগাড়ির যাতায়াতের জন্য আলাদা একটি রেলপথ তৈরি করছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতে পন্য পরিবহন আরও দ্রুত হয়। এই ধরনের বিশেষ রেলপথকেই ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর বলে। ডিএফসির কারনে পন্য পরিবহনে খরচ ও সময় কম লাগার পাশাপাশি শক্তির খরচ কম হয়, পরিবেশ দূষন কম হয়, পন্যের খরচ কমে যায়, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ভারতের যে অঞ্চল দিয়ে ডিএফসি যায় সেখানে জমির দামও বেড়ে যায়। ডিএফসি তৈরি করার জন্য ডিএফসিসিআইএল বা ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড নামে একটি বিশেষ সংস্থাও তৈরি করা হয়েছে। 

ভারতীয় রেলওয়ের অধীনে ২০০৬ সালে এই সংস্থাটি তৈরি করা হয়, ভারতে সমস্ত ডিএফসি তৈরি, অর্থায়ন, পরিচালনার দায়িত্ব এই ডিএফসিসিআইএলেরই। ভারতে ইতিমধ্যেই দুটি ফ্রেট করিডর নির্মানের কাজ প্রায় সম্পূর্ন হয়ে গেছে। পূ্র্ব ডিএফসি যা পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে পশ্চিমবঙ্গের ডানকুনি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং পশ্চিম ডিএফসি যা উত্তরপ্রদেশের দাদরি থেকে মহারাষ্ট্রের জওহরলাল নেহেরু পোর্ট ট্রাস্ট পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্ব ডিএফসি নির্মান সম্পূর্ন হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই এবং পশ্চিম ডিএফসির ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে। গত এপ্রিল মাসের তথ্য অনুযায়ী পূর্ব ও পশ্চিম ডিএফসির মোট পথের ৯৬.১ শতাংশের কাজ সম্পূর্ন হয়ে গেছে। পশ্চিম ডিএফসির মোট দৈর্ঘ্য ১,৫০৪ কিলোমিটার যা পাঁচটি রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, গুজরাট ও রাজস্থানের মধ্যে দিয়ে গেছে। পূর্ব ডিএফসির দৈর্ঘ্য ১,৮৫৬ কিলোমিটার যা সাতটি রাজ্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দিয়ে গেছে। রেলওয়ের প্রথম লক্ষ্য ছিল দিল্লি হাওড়া ও দিল্লি মুম্বাই পথে মালগাড়ির জন্য আলাদা রেলপথ তৈরি যাতে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলেও সুবিধা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম ডিএফসির সুবিধা দেখে কেন্দ্রীয় সরকার আরও তিনটি ডিএফসির কাজ শুরু করতে চলেছে। এই তিনটি ডিএফসিতে মোট ৪,৩০০ কিলোমিটার রেলপথ তৈরি করা হবে যাতে দুই লাখ কোটি টাকা খরচ হবে। বর্তমানে ভারতে মোট পন্য পরিবহনের ২৮ শতাংশ রেলপথের মাধ্যমে হয়। রেলওয়ের লক্ষ্য ২০৫১ সালের মধ্যে এরমাত্রা বাড়িয়ে ৪৪ শতাংশ করা। অর্থাৎ স্বাধীনতার পরে ভারতীয় রেলওেয়ের পন্য পরিবহনে যে ভূমিকা ছিল তা পুনরায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে ভারত সরকার। বর্তমানে দেশে পন্য পরিবহনে জিডিপির ৩০ শতাংশ খরচ হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে এটা কমিয়ে ৮ শতাংশে নিয়ে আসাই কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য। 

নতুন যে তিনটি ডিএফসি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলো হচ্ছে:—

১) পূর্ব উপকূলীয় করিডর:—- পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের তেনালি পর্যন্ত ১,২০০ কিলোমিটার লম্বা ডিএফসি তৈরি করা হবে। প্রথমে এই করিডর খড়গপুর থেকে বিশাখাপত্তনমের বন্দর পর্যন্ত তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল কিন্তু পরে এটা বৃদ্ধি করে তেনালি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশার মতোন খনিজ সম্পদে পরিপূর্ন রাজ্যগুলো থেকে কয়লা, সার, লোহারমতো খনিজসম্পদের পাশাপাশি অন্যান্য পন্য পরিবহন করা হবে এই পথে। 

২) উত্তর দক্ষিন করিডর:—- মধ্যপ্রদেশের ইটারসি থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের তেনালি পর্যন্ত ১০০০-১,২০০ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথ চারটি রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যে দিয়ে যাবে। এই পথে কয়লা, সিমেন্ট, সার, পেট্রোলিয়াম দ্রব্যের পরিবহন হবে। পরে এই করিডরকে অন্যান্য ডিএফসির সাথেও সংযুক্ত করা হবে। 

৩) পূর্ব পশ্চিম করিডর:—- ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘতম ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর হতে চলেছে এই পূর্ব পশ্চিম করিডর। পশ্চিমবঙ্গের অন্ডাল থেকে মহারাষ্ট্রের পালগড় পর্যন্ত প্রায় ২,১০০ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথ পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাবে। এই পথে মূলত কয়লা, লোহা, স্টিল সহ গুরুত্বপূর্ন জিনিসের পরিবহন হবে। 

এই তিনটি করিডর নিয়ে সিদ্ধান্ত খুব শীঘ্রই ঘোষনা করবে রেলওয়ে। চলতি লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বারবার বিভিন্ন জনসভাতে বলছেন তাদের সরকার পুনরায় আসবে এবং রেলওয়ের একশো দিনের পরিকল্পনা তৈরি রয়েছে। এই পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অংশ বন্দেভারত স্লিপার ট্রেন চলাচল ও জম্মু-কাশ্মীরে বাকী থাকা রেল প্রজেক্ট। নতুন সরকার গঠনের পরেই নতুন তিনটি ডিএফসির ব্যাপারেও ঘোষনা করা হবে। ডিএফসির নির্মানের ফলে সড়কেও যানজট কমবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *