অফবিট

জ্যোতিষরা কিভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?

রাশিফল হোক কিংবা জ্যোতিষ শাস্ত্র মেনে চলেন বহু মানুষ। এমনও অনেক মানুষদের দেখা গিয়েছে যারা প্রত্যেকদিন সকালে উঠে নিজের রাশিফলে একবার চোখ বুলিয়ে নেন, আজকের দিন কেমন যাবে? কোন রংটা শুভ হবে, কোন সংখ্যাটা ভালো হবে এইসব দিকে নজর রাখার অভাব নেই মানুষের। এছাড়াও অনেকে নিজের ভবিষ্যতে কোন বাধা-বিপত্তি আছে কিনা? থাকলে সেটা কিভাবে দূর করা যাবে? সেই বিষয়ে চর্চা করতে পৌঁছায় জ্যোতিষের কাছে। তবে জ্যোতিষ বিদ্যা চর্চিত কোন মানুষ কিন্তু ভগবান নয়। আপনার কিংবা আমার ভবিষ্যতে কি লেখা রয়েছে সেটি তিনি একজন মানুষের বলে দিতে পারেন কিভাবে? সাধারণ মানুষের কাছে এই বিষয়টা প্রথমে একটু কঠিন লাগলেও বেশ কিছু নিয়ম আছে যেগুলো মেনে চললে সহজ হয়ে যাবে জ্যোতিষ শাস্ত্র।

মানুষের হাত দেখিয়ে তার নক্ষত্র, গণ বলে দেওয়া কোন কঠিন কাজ নয়। যে নিয়ম মেনে জ্যোতিষ শাস্ত্র তৈরি হয় এবং পঞ্জিকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে লেখা হয় সে নিয়ম একবার দেখে নেওয়া যাক। 

জ্যোতিষ শাস্ত্রে প্রথম যে বিষয়টা আসে সেটি হল পঞ্চাঙ্গ। সময়ের এই পাঁচটি অঙ্গ হলো যথাক্রমে -বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই পঞ্চাঙ্গ দ্বারা নির্ণয় করা হয় সময়ের মান। অর্থাৎ সোজা ভাষায় বলতে গেলে কোন সময়ে কাজ করলে সেটা শুভ হবে সে নির্দিষ্ট সময় নির্ণয় করা হয় পঞ্চাঙ্গ দ্বারা। এই পদ্ধতিতে এই পঞ্জিকায় বিবাহ অন্নপ্রাশন পুজোর তিথি সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় নির্ণয় করা হয়ে থাকে। তিথি নক্ষত্র সংক্রান্ত যে শাস্ত্রে লেখা থাকে সেটিকে মুহূর্ত শাস্ত্র বলে। 

এই মুহূর্ত শাস্ত্র কিংবা মুহূর্ত জ্যোতিষের সময় সব সময় ভালো নাও হতে পারে। একটা শিশু জন্মের সময় কিছুটা ভালো সময় থাকে তো কিছুটা খারাপ সময় থাকে। যদি কোন শিশুর জন্মের পঞ্চাঙ্গে খারাপ সময় থাকে তাহলে সেটি তিনি ব্যবহার করতে পারেন। সেই যোগ বা কারণ ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে খারাপ বিবেচিত হবে না। আবার পঞ্জনগের আরেকটি বিশেষ অঙ্গ হল যেটি জন্মক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয় সেটি হল “বার”। এইবারের সঙ্গে কিছু শুভ ও অশুভ সময় যুক্ত হয়ে থাকে। কিছু গ্রহ এই বারের কারণে ‘মারক’ গ্রহ হবে। যেমন- রবিবার- শনি,সোমবার- রাহু,মঙ্গলবার- কেতু,বুধবার- সূর্য,বৃহস্পতিবার-চন্দ্র,শুক্রবার- মঙ্গল। 

যেহেতু বার নির্ধারণ করে অগ্নিতত্ত্ব তাই, বারগুলির সঙ্গে লং এর জোকস আজব থাকলে সেই ব্যক্তির শারীরিক অসুস্থতা এবং চাকরিতে বিঘ্নিত আসতে পারে। যদি কোন ব্যক্তির বারেশ খুব ভালো থাকে তাহলে চন্দ্র বা সূর্যের মতো সৌম্য গ্রহ জীবনে খুব একটা খারাপ দিক তৈরি করতে পারবেনা। 

এবার আসা যাক জ্যোতিষ শাস্ত্রের মূল কেন্দ্রবিন্দু তিথি, নক্ষত্র এবং যোগের বিষয়ে।

I) তিথি – চন্দ্র ও সূর্যের মধ্যে যে দূরত্ব থাকে সেই দূরত্বটাকে তিথি বলা হয়। মূলত এই তিথি মানুষের জীবনে জল তত্বের মতো কাজ করে। যদি কোন মানুষের জীবনে জল তত্ত্ব নিয়ন্ত্রিত কিংবা অনিয়ন্ত্রিত থাকে তাহলে সেই জিনিসটা নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির সম্পর্ক, মানসিক স্থিতি, খুশি হওয়া, বিষন্ন হওয়া, আশা বা নিরাশাবাদী হওয়া ইত্যাদির উপর। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে এই জল তত্ব মানুষের মানসিক স্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। 

সূর্য থেকে চন্দ্র যখন ১২° দুরত্বে তখন তা একটি তিথির সমান। এইভাবে ১৫ টি তিথি আছে। চন্দ্র যখন সূর্যের সামনে তখন সূর্যের অবস্থান ডিগ্রি থেকে ১৮০° পর্যন্ত হল শুক্ল পক্ষ। ১৮১° থেকে ৩৬০° পর্যন্ত( সূর্যের অবস্থান ডিগ্রি) হবে কৃষ্ণ পক্ষ। এই দুটি পক্ষকে যদি আপনি ১২ ডিগ্রির ভাগে বিভক্ত করতে থাকেন, তাহলে আপনি ১৫ টি তিথি পেয়ে যাবেন। কিন্তু তার গণনা হবে বিপরীত। তার মানে, শুক্ল পক্ষে সূর্য থেকে চন্দ্র যখন ১২° দুরত্বে তখন চন্দ্রের যে crescent তৈরী হবে, তা হবে অতীব সুক্ষ এবং তীক্ষ্ণ। এবং এটি বাম মুখী হবে। এই তিথিকে আমরা বলছি প্রতিপদ। এই দিনে জন্মানো ব্যক্তি খুব তীক্ষ্ণ আলোচনা করতে পারেন। ফুটিয়ে কথা বলতে পারেন। কুষ্ঠি বিশেষে যদি তেমন ভাবে কথা না-ও বলেন, কিন্তু সমালোচনা করার দৃষ্টি ভঙ্গি খুব তীক্ষ্ণ। কিন্তু যখন কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ হবে, তখন এর বিপরীত হবে, তখন চাঁদের অন্ধকার ভাগ খুব তীক্ষ্ণ একটি crescent ( এটি ভাষার সীমিত জ্ঞানে ভুল অভিব্যক্তি) তৈরী করবে, পাশাপাশি সেটি ডান মুখী হয়ে পড়বে এবং এইভাবেই বিভিন্ন তিথিতে বিভিন্ন রকমের মানসিকতা দেখা দিতে থাকে।

মূলত এই সকল তিথির মাধ্যমিক জীবনের বিভিন্ন বিশেষ সময়ের ফলাফল নির্ধারণ করা যায়। তার কারণ প্রত্যেকটি তিথিতে একটি করে গ্রহ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন একটা উদাহরণসহ বলা যায় যে ষষ্ঠী তিথিতে কোন ব্যক্তি জন্মালে সেই ব্যক্তির সন্তান জন্মানোর সময় সমস্যা দেখা দেবে। অর্থাৎ এভাবেই প্রত্যেকটি তিথির ভালো ও খারাপ দুটি দিকই থাকে।

II) নক্ষত্র :- মানুষের জীবনে বায়ু তত্ত্বের প্রতিক হিসেবে কাজ করে নক্ষত্র। সেই ব্যক্তির মানসিক স্থিতি কতটা নমনীয় হবে, কতটা মানিয়ে নেবে, কতটা সহ্য করার ক্ষমতা থাকবে এই সবকিছু নির্ভর করে বায়ু তত্ত্বের উপরে। মানুষের জীবন যখন একটা নাটক এবং দুনিয়া যখন একটি নাট্যমঞ্চে পরিণত হয় তখন মুহূর্তে মুহূর্তে বদলায় তার চরিত্র। আর সেই চরিত্র টাই নির্ভর করে নক্ষত্রের উপর। প্রত্যেকটা নক্ষত্রের একটি বিপরীত নক্ষত্র থাকে। সেই হিসেবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে প্রতিটি নক্ষত্র বিচার করলে যোগী নক্ষত্র, অবযোগী নক্ষত্র, শূণ্য নক্ষত্র, বৈনাশিক নক্ষত্র ইত্যাদি নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটবে। তবে এইসব নক্ষত্র থেকে একটি ভিন্ন নক্ষত্র হলো নবতারা বা জন্ম নক্ষত্র। কোন শিশু জন্মানোর সময় নয়টি নক্ষত্রের মিলনে এই নক্ষত্রের তৈরি হয়। তবে এই নক্ষত্রের ব্রম্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তিনজনের শক্তি মিলিত থাকে বলে এই নক্ষত্র গণনা করা একটু জটিল। এছাড়াও এটি বায়ু তত্ব বলে সর্বদা পরিবর্তনশীল। 

নক্ষত্র গণনা করার সহজ উপায় হল প্রথমে দেখে নিতে হবে চন্দ্র কোন রাশিতে অবস্থান করছে, এরপর চন্দ্রের ভগ্নাংশ কি এবং পথ ডিগ্রিতে রয়েছে। এই তথ্য জানা হয়ে গেলে ডিগ্রিকে মিনিটে পরিবর্তন করে তাকে ৮০০ দিয়ে ভাগ করে নিতে হবে। এরপর যে সংখ্যাটা বের হবে সেটা ডেসিমেলের পর সংখ্যা থাকবে। সেক্ষেত্রে অনুমান করে নিতে হবে ডেসিমেলের আগে যে সংখ্যাগুলো রয়েছে সেই নক্ষত্র গুলি চন্দ্র পেরিয়ে এসেছে। এবার ডেসিমেলের পরে যে সংখ্যা রয়েছে ততগুলি নক্ষত্র চন্দ্রের বর্তমানে অবস্থান করছে। এভাবেই ২৭ টি নক্ষত্রের নির্ণয় করা হয়।

III) যোগ:- সূর্য ও চন্দ্রের ভগ্নাংশকে যোগ বলে। এই ভগ্নাংশকে প্রথমে ১৩.২৩° অথবা ৮০০ দিয়ে ভাগ করে নিতে হবে। এবার যে সংখ্যাটা আসবে সেটি হলো ওই দিনের যোগ। যেমন ১৬.৫৬ সংখ্যা আসলে, বুঝতে হবে ১৬টি যোগ পূর্ণ হয়ে ১৭টি যোগে পড়েছে। এভাবেই একের পর এক করে‌ ২৭টি যোগ নির্ণয় করা হয়। নক্ষত্রের মতো যোগও সীমাবদ্ধ। কোন ব্যক্তির নামের মধ্যে দিয়েই তার কতটা যোগ রয়েছে সেটি নির্ণয় করা যায়। আর এই ২৭টি যোগ হলো যথাক্রমে- বিষকূম্ভ, প্রিতি, আয়ুষমান, সৌভাগ্য, শোভন, অতীগন্ড,সুকর্ম, ধৃতি, শূল, গন্ড, বৃদ্ধি, ধ্রুব, ব্যাঘাত, হর্ষণ, বজ্র, সিদ্ধি, ব্যাতীপাত, বরেণ্য, পরিঘ, শিব, সিদ্ধ, সাধ্য, শুভ, শুক্ল, ব্রহ্ম,ঐন্দ্র, ব্যয়ধৃতী। 

IV) কারণ :-  জ্যোতিষশাস্ত্রে পঞ্চাঙ্গের মধ্যে কারণ হল সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে দূরত্বের ভগ্নাংশ। অর্থাৎ চন্দ্র এবং সূর্যের মধ্যে দূরত্ব যদি ১২° ডিগ্রি হয় তাহলে সেটি হল তিথি, তবে চন্দ্রের অর্ধেক মান যদি ৬° হয় তাহলে সেটি হল কারণ। এর মানে হল একটি তিথিতে দুটি কারণ অবস্থান করে। কারণ কি মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায় একটি হলো স্থির কারণ এবং অপরটি হলো নেতিবাচক কারণ। শকুনি, চতুষ্পাদ, নাগ ও কিনস্তুঘ্ন হলো স্থির করণ। নেতিবাচক বলে ধরা হয় বভ, বলব, কৌলভ,তৈতিল, গর, বণিজ, ভিষ্টি বা ভদ্রাকে।

বহু মতান্তর রয়েছে এইসকল বিষয় নিয়ে। একাধিক বিশ্লেষণ এবং তথ্য নির্ভর লেখা, এই নিয়ে বহুমত থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *