অফবিট

নোবেল শান্তি পুরস্কারের কারনেই মৃত্যু হয়েছিল ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর! কেন জানেন?

১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩, আমেরিকার হোয়াইট হাউসে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন, ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফত এবং ইটজহেক রবিনের মধ্যে অসলো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য শুরু হওয়া এই চুক্তি নষ্ট হয়ে যায় ১৯৯৫ সালে। সেই বছর ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা বেলায় ইটজহেক রবিনের এক ভাষনের জন্য একত্রিত হয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ, হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি ইটজহেক রবিনকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গুলি চালায় যাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইটজহেক রবিনের। তাঁর মৃত্যুর কারন ছিল দুই বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে হোয়াইট হাউসে হওয়া ওই অসলো শান্তি চুক্তি। অসলো শান্তি চুক্তির কারনে ১৯৯৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি কিন্তু এই চুক্তিই শেষপর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কারন হয়।মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ইসরায়েল ফিলিস্তিন সংঘাত। দীর্ঘদিন ধরে গাজা উপত্যকা, ওয়েস্টব্যাঙ্ক ও জেরুজালেম নিয়ে ফিলিস্তিনের সাথে বিবাদ রয়েছে ইসরায়েলের। ১৯৯২ সালে ইটজহেক রবিন দ্বিতীয় বারের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়। ইটজহেক রবিনের লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের সাথে ইসরায়েলের বিবাদের অবসান ঘটানো, ইসরায়েলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করা। সেসময়ই ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন বিবাদ মেটানোর জন্য অসলো চুক্তির কথা ওঠে। এই চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল গাজা উপত্যকা থেকে তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিত। ইটজহেক রবিন নিজেও শান্তি চাইতো কিন্তু তিনিও চাননি এত দ্রুত এই চুক্তি হোক এবং ইসরায়েল সেনাবাহিনী এত তাড়াতাড়ি বিশাল সংখ্যক এলাকা থেকে ফিরে আসুক, কারন তিনি ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে ইয়াসির আরাফতকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তিনি চাইছিলেন ধাপে ধাপে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়া হবে। ইয়াসির আরাফত প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও এর চেয়ারম্যান ছিল প্রথমে, এই পিএলও প্রথমে ছিল একটি সন্ত্রাসী সংগঠন যারা ইসরায়েলে সন্ত্রাসী কাজকর্ম করতো। এই পিএলও ছিল ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি।

১৯৭৮ সালে মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে হওয়া ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পরিমার্জিত রূপ এই অসলো চুক্তি, যার মূল উদ্দেশ্যে ছিল মধ্য প্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা। নরওয়ের রাজধানী অসলোতে গোপনে এই চুক্তির রূপরেখা তৈরি করা হয়েছিল। এই চুক্তিতে বলা হয় গাজা উপত্যকা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক বা পশ্চিম তীর থেকে ইসরায়েল তাদের সেনাবাহিনী সরিয়ে নেবে এবং এই অঞ্চলে প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের জন্য একটি ফিলিস্তিনি সরকার গঠন হবে। এই চুক্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন দেশ গঠনের কথা না বলা হলেও পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের পাশে ভবিষ্যতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন দেশ গঠনেরই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। এই চুক্তি হলে পিএলও ইসরায়েলকে স্বাধীন দেশ হিসাবে মেনে নেবে এটাই শর্ত রাখা হয়। এই চুক্তি দ্বারা জাতিসংঘের ২৪২ এবং ৩৩৮ ধারা অনুযায়ী মধ্য প্রাচ্যে ইসরায়েল ফিলিস্তিন বিবাদের স্থায়ী সমাধান করা হত। সম্পূর্ন চুক্তি দুটি পর্যায়ে করার কথা হয়। 

প্রথম পর্যায়ের চুক্তি হয় ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে এবং দ্বিতীয় পর্যায় বা অসলো চুক্তি ২ হয় মিশরের তাবাতে ১৯৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। 

অসলো চুক্তির বিরোধীতা শুরু করে ইসরায়েলের নাগরিকদের একটি বড় অংশ, তাদের ধারনা ছিল এই চুক্তির ফলে পিএলও ইসরায়েলের পাশে একটি বড় জায়গা পেয়ে যাবে এবং সেখান থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজকর্ম চালাবে। অসলো চুক্তির বিরুদ্ধে ইসরায়েলে রীতিমতো প্রদর্শনী শুরু হয়। ১৯৯৫ সালের ৪ নভেম্বর ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিভে বক্তৃতা দেবার সময়ে ইয়াগিল আমির নামে এক ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করে ইটজহেক রবিনকে। এই ব্যক্তি অসলো চুক্তির বিরোধী ছিল। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ইটজহেক রবিন ইসরায়েলকে মধ্য প্রাচ্যে আরও শক্তিশালী করে দিয়ে যান।

১৯৯০ এর দশকেই ইসরায়েল এর সাথে সিরিয়া ও লিবিয়ার দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছিল। ইসরায়েলের উত্তরভাগে সিরিয়া ও লেবাননের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য আমেরিকা চেষ্টা করছিলো বটে কিন্ত তেমন কিছু লাভ হচ্ছিল না। সিরিয়া ও লেবাননের মধ্যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন কাজ করছিল, যার নাম হিজবুল্লাহ। তারা ইসরায়েল সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন করে এই শান্তি চেষ্টা ভেস্তে দেয়। 

যার কারনে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি ইসরায়েল হিজবু্ল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে অপারেশনের পরিকল্পনা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী ইটজহেক রবিন হিজবুল্লাহের বিরুদ্ধে অপারেশনের আদেশ দেয় ইসরায়েল সেনাবাহিনীকে। ইসরায়েলের সমস্ত গোপন পরিকল্পনার পেছনেই থাকে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, যাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক বলা হয়।  অ্যাগোস নামে বিশেষ কম্যান্ডো দল তৈরি করে ইসরায়েল সেনাবাহিনী এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে গোরিলা আক্রমন শুরু হয়। অ্যাগোস গোরিলা আক্রমনে হিজবুল্লাহের অনেক সদস্যকে হত্যা করে। এরপর মোসাদ হিজবুল্লাহের দুজন প্রধান ব্যাক্তিকে নিশানা করে। জেনারেল আব্বাস এবং ইয়াসিন। 

জেনারেল আব্বাসকে হিজবুল্লাহের সহকারি প্রতিষ্ঠাতা বলা হত। তাকে হত্যা করা হয় ড্রোনের মাধ্যমে লেজার গাইডেড মিসাইল ব্যবহার করে। ইয়াসিন ছিল হিজবুল্লাহের একজন শীর্ষস্থানীয় কম্যান্ডার। তার উপর মোসাদ দুই সপ্তাহ নজরে রাখে। মোসাদ লক্ষ্য করে সপ্তাহে একটি দিন ইয়াসিন গাড়ি করে তার বাড়ি থেকে বেইরুটে যায় এবং গভীর রাতে ফিরে আসে। ১৯৯৫ সালের ৩০ মার্চ বাড়ি থেকে গাড়িতে করে বেইরুটের উদ্দেশ্যে যাবার সময়েই অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে আসা মিসাইলের আঘাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ইয়াসিনের। প্রধানমন্ত্রী হয়েই ইটজহেক রবিন দুটি লাল কাগজে সই করে। প্রথম লাল কাগজে ছিল ফিলিস্তিনি জঙ্গি শাকাকির নাম যাকে হত্যা করা দরকার হয়ে পড়েছিল। ১৯৮৮ সালে শাকাকিকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা করে ইরান। এরপরেই শাকাকি ১৯৯০ সালে মিশরে একটি বাসের উপর আত্মঘাতী হামলা চালায় যাতে নয়জন ইসরায়েলি লোকের মৃত্যু হয়। ইহুদিদের উপর এরকম একের পর এক আক্রমন করতেই থাকে শাকাকি যার কারনে শাকাকিকে হত্যা করবার আদেশ দেওয়া হয় মোসাদকে। কিন্তু শাকাকিকে হত্যা করা এত সহজ ছিলনা কারন শাকাকি ইরান, সিরিয়া, লিবিয়া সহ একাধিক দেশে লুকিয়ে থাকত। সেসময় লিবিয়ার স্বৈরাচারী শাসক গদ্দাফির সাথেও ভাল সম্পর্ক ছিল শাকাকির। ইব্রাহিম নামে একটি লিবিয়ান পাসপোর্টও ছিল শাকাকির। বেশ কয়েক মাস শাকাকির উপর নজর রাখার পর মোসাদ জানতে পারে শাকাকি লিবিয়া যাবার জন্য প্রথমে মাল্টা যায়, সেখানে একটি বিলাসবহুল হোটেলে একদিন থেকে তারপর লিবিয়া যায়। একদিন মোসাদ জানতে পারে ১৯৯৫ সালের ২৬ অক্টোবর শাকাকি মাল্টা যাবে। সেই মতো আগেই মাল্টায় পৌঁছে যায় ইসরায়েলের বিশেষ কম্যান্ডো দল। ২৬ অক্টোবর মাল্টায় পৌঁছে হোটেলে খানিকক্ষন বিশ্রাম নিয়ে শাকাকি রাস্তায় ঘুরতে বেরোয়। শাকাকি ভাবেওনি তার উপর কেউ নজর রাখছে। শাকাকিকে দেখেই জেরি নামে এক মোসাদ এজেন্ট ফোনে দুটি শব্দ বলে হানি বান যার অর্থ টার্গেটকে শেষ করা। কিছুক্ষনের মধ্যে মটর বাইকে দুজন ব্যক্তি এসে মাথায় দুটি গুলি করে হত্যা করে শাকাকিকে। মিশন সম্পন্ন হবার পরেই ইসরায়েলের কম্যান্ডো দল সমুদ্রপথে ইসরায়েলে ফিরে আসে। 

ইটজহেক রবিনের সই করা দ্বিতীয় লাল পাতায় নাম ছিল আইয়াশের যাকে ইঞ্জিনিয়ার নামে ডাকা হত। আইয়াশ ১৯৯২-৯৩ এর মধ্যে ইসরায়েলে একাধিক আত্মঘাতী বিস্ফোরন ঘটায় যাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। ইসরায়েলেী অভ্যন্তরীন গোয়েন্দা সংস্থা সিনবেট নজর রাখতে শুরু করে আইয়াশের উপর। আইয়াশ গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েল বিরোধী কাজ করতো। সিনবেট কয়েক মাস আইয়াশের উপর নজর রেখে জানতে পারে উত্তর গাজা উপত্যকায় ওসামা নামে এক বন্ধু আছে আইয়াশের সেখানে সে মাঝে মধ্যেই যায়। সিনবেট ওসামার কাকা কামালের সাথে যোগাযোগ করে ওসামাকে একটি ফোন দিতে বলে যার মধ্যে ট্রান্সমিটার থাকবে, যার মাধ্যমে আইয়াশের সমস্ত কথা শুনতে পাবে সিনবেট। এর বদলে কামাল সহ তার পরিবারকে আমেরিকায় আশ্রয় দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় সিনবেট। কিন্তু এখানে সিনবেট কামালকে মিথ্যা কথা বলেছিল সেই ফোনে কোন ট্রান্সমিটারের বদলে ছোট একটি বোম্ব ছিল। একটি বিশেষ বিমান থেকে এই ফোনের উপর নজর রাখা হত। প্রথমবার যখন ওসামা যখন আইয়াশকে ফোন দেয় তখন বোম্বটি ফাটেনি যার কারনে কামালের মাধ্যমে ফোনটি ফেরত নিয়ে এসে সিনবেট ঠিক করে আবার পাঠায় আইয়াশকে, এবার আর কোনও ভুল হয়নি। বোম্ব ফেটে মৃত্যু হয় আইয়াস ওরফে ইঞ্জিনিয়ারের। পূরন হয় প্রধানমন্ত্রী ইটজহেক রবিনের দুটি লাল পাতার টার্গেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *