অফবিট

রাতের বেলা পর্যটকদের তারা দেখাতে কি প্ল্যান করা হয়েছে লাদাখে?

রাজেশ রায়:– আজ ভারতের কেন্দ্রশাসিত প্রদেশ লাদাখের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করব। লাদাখের লে তে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে যার মাধ্যমে হ্যানলে অবজারভেটরিকে ডার্ক স্কাই স্যাংচুয়ারি তৈরি করা হবে। আজ বিস্তারিত ভাবে বলব হ্যানলি অবজারভেটরি কী?  এবং ডার্ক স্যাংচুয়ারি কাকে বলে?

সম্প্রতি লে প্রশাসন এর নেতৃত্বে লে হিল কাউন্সিল, বন্যপ্রান সংরক্ষণ সংস্থা ও পর্যটক সংস্থা যৌথভাবে একটি চুক্তি করে যাতে হ্যানলে অবজারভেটারিকে অ্যাস্ট্রো টুরিজমের আওতায় ডার্ক স্কাই স্যাংচুয়ারি তৈরি করা হবে। ডার্ক স্কাই স্যাংচুয়ারি কী এবার জানা যাক। অক্টোবর, ২০২১ এ লাদাখ প্রশাসন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রো ফিজিক্সেরের সহায়তায় অ্যাস্ট্রো টুরিজমের প্রচার করতে হ্যানলেকে ডার্ক স্কাই স্যাংচুয়ারি ঘোষনা করে। ভারতের যে কোন উঁচু পার্বত্য অঞ্চল থেকে রাতের বেলায় আকাশে প্রচুর তারা অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে দেখা যায় যা অ্যাস্ট্রো ফিজিক্সকের অন্তর্ভুক্ত, অপূর্ব লাগে এই দৃশ্য দেখতে।  যেসমস্ত মানুষ এই সব দৃশ্য দেখার জন্য শুধু লাদাখ সহ উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রমন করে তাকে অ্যাস্ট্রো টুরিজম বলে। যেসব সরকারী বা ব্যাক্তিগত জায়গা থেকে রাতের বেলায় এই অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায় তাকেই ডার্ক স্কাই স্যাংচুয়ারি বলা হয়। এখানে মহাকাশ বিজ্ঞানে উৎসাহী পড়ুয়ারা রিসার্চের উদ্দেশ্যে যায় এবং অতিউৎসাহী মানুষ ভ্রমনেও যায়, তাই এরকম জায়গা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। ডার্ক স্কাই স্যাংচুয়ারি এমন জায়গায় হয় যেখানে কোন শক্তি খরচ না করেই প্রাকৃতিক ভাবে রাতের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখা যায়। লাদাখের হ্যানলে অবজারভেটরি এমনই এক জায়গা। হ্যানলে অবজারভেটরি সম্পর্কে একটু বলা যাক। হ্যানলে নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন লাদাখ তিব্বত ব্যাবসায়িক রুটের এই ভ্যালি বিশ্বের অন্যতম উঁচু মহাকাশ বিজ্ঞান অবজারভেটরি। সমুদ্রপিষ্ঠ থেকে ৪,৫০০ মিটার বা ১৪,৭৬৪ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হ্যানলে বিশ্বের দশম উচ্চ মহাকাশ বিজ্ঞান কেন্দ্র। এখানে অপটিক্যাল, ইনফ্রারেড ও গামা রে টেলিস্কোপের সাহায্যে অ্যাস্ট্রো ফিজিক্সের গবেষণা করা হয় যা ২০০১ সালে তৈরি হয়। ব্যাঙ্গালোর বেসড ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স এটি পরিচালনা করে। চীনের সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই জায়গায় পৌঁছাতে লে থেকে দশ ঘন্টা লাগে। ১৯৮০ সালে প্রফেসর বি ভি শ্রীকান্তনের নেতৃত্বে এখানে একটি অপটিক্যাল টেলিস্কোপ প্রজেক্টের শুরু করা হয় যা এবং ২৯ আগস্ট, ২০০১ এ এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হয়। অদূর ভবিষ্যতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স এবং আমেরিকার সেন্ট লুইসে অবস্থিত ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ম্যাকডোনেল সেন্টার ফর স্পেস সায়েন্স যৌথভাবে এখানে আরও অ্যাডভান্সড টেলিস্কোপ বসাতে চলেছে। এছাড়াও টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার এবং কলকাতার সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিস্ক ও এখানে যুক্ত হতে চলেছে।

হ্যানলে তে হিমালিয়ান চন্দ্র টেলিস্কোপ, গ্রোথ ইন্ডিয়া টেলিস্কোপ ও হাই অল্টিটিউড গামা রে টেলিস্কোপ রয়েছে। টেলিস্কোপের প্রধান কাজই হচ্ছে দূর কোন বস্ত থেকে  আসা আলোকে ফোকাস করে আমাদের চোখের সামনে আনা যাতে আমরা সেই বস্তটিকে দেখতে পাই। কোন বস্ততে যখন আলো পড়ে তখন সেই বস্ত থেকে প্রতিফলিত আলো যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে তখন সেই বস্তটিকে আমরা দেখতে পাই। অন্ধকার ঘরে আলো না থাকার কারনে আমরা কোন বস্তকে দেখতে পাইনা। এবার বহু দূর কোন বস্তকে আমরা সহজে স্পষ্ট দেখতে পাইনা কারন, বহুদূরের বস্ত থেকে আসা আলো আমাদের চোখে পৌঁছানোর আগেই বিভিন্ন দিকে প্রতিফলিত হয়ে যায়। এখানেই টেলিস্কোপের দরকার টেলিস্কোপ তার লেন্সের সাহায্যে চারিদিকে ছড়িয়ে যাওয়া আলো সংগ্রহ করে আমাদের চোখে এনে ফেলে। এবার ইনফ্রারেড, গামা রে ও অপটিক্যাল টেলিস্কোপ সম্পর্কে জানা যাক। পৃথিবীতে আলোর সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে সূর্য। সূর্য থেকে বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো নির্গত হয় কিন্তু অপটিক্যাল আলো নির্গত হয় না। এই ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো দেখবার জন্য বিভিন্ন টেলিস্কোপ দরকার হয়। এই সমস্ত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে মিলিত হয়ে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম তৈরি করে। সূর্য থেকে আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি, এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি বেরোয়। এই সব রশ্মি তরঙ্গ আকারে বের হয় কারন আলোক রশ্মি কখনও সরলরেখায় যায় না, ঢেউ বা তরঙ্গ আকারে যায়। তরঙ্গ কী হয় কখনও একদম উপরে ওঠে আবার নীচে নেমে যায়। এই তরঙ্গের শীর্ষকে বলে ক্রাস্ট এবং তলদেশ কে বলে থ্রু। এভাবে কখনও ক্রাস্ট তো আবার কখনও থ্রু এইভাবে আলো যায়। একটি ক্রাস্ট থেকে পরবর্তী ক্রাস্ট বা একটি থ্রু থেকে পরবর্তী থ্রু অবস্থায় আসার মধ্যবর্তী অবস্থাকেই বলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। এভাবে সূর্য থেকে বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো নির্গত হয়। এদের মধ্যে সাতটি রঙ আমরা চোখে দেখতে পাই যাকে ভিজিবল লাইট বলা হয় এগুলো ৭০০ ন্যানোমিটার থেকে ৪০০ ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। এসব আলোর জন্যই আমাদের টেলিস্কোপ দরকার। হ্যানলে অবজারভেটরির বর্তমান ইনচার্জ দোরজে ওয়াংচুক, ইনি পেশায় অস্ট্রো ফটোগ্রাফার। দোরজে ওয়াংচুক প্রথম কোন ভারতীয় ব্যাক্তি যাকে সেপ্টেম্বর, ২০২১ এ আন্তর্জাতিক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের সদস্য পদ দেওয়া হয়েছে।

এবার জানা যাক হ্যানলে অবজারভেটরিতে থাকা টেলিস্কোপ গুলো সম্পর্কে :—

১) হিমালিয়ান চন্দ্র টেলিস্কোপ :— এটি একটি অপটিক্যাল ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ যার ব্যাস ২.০১ মিটার। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ভারতীয় সাহিত্যক সুব্রহ্মনিয়ম চন্দ্রশেখরের নাম অনুসারে এই টেলিস্কোপের নাম রাখা হয়েছে। আমেরিকার অ্যারিজোনাতে অবস্থিত ইলকট্রো অপটিক্যাল সিস্টেম টেকনোলজি এই টেলিস্কোপটি তৈরি করেছে। ইসরোর ইনস্যাট -৩বি স্যাটেলাইট লিংকের সাহায্যে এটি পটিচালনা করা হয়।

২) গ্রোথ ইন্ডিয়া টেলিস্কোপ :– ২০১৮ সালে স্থাপিত ০.৭ মিটার ব্যাসের এই অপটিক্যাল টেলিস্কোপটি আইআইটি বোম্বে ও ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স যৌথভাবে পরিচালনা করে। এটি ভারতের প্রথম পুরোপুরি রোবোটিক রিসার্চ টেলিস্কোপ। 

৩) হাই অল্টিটিউড গামা রে টেলিস্কোপ :—  ২০০৮ সালে এই ধরনের সাতটি টেলিস্কোপ ইনস্টল করা হয় এখানে যার প্রতিটিতে ৭ টি আয়না রয়েছে এবং প্রতিট টেলিস্কোপের আয়তন ৪.৪ স্কোয়ার মিটার।

হ্যানলে অবজারভেটরির পাশাপাশি রাজস্থান ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে ৩৩ টি জেলায় রাতের আকাশ দেখার বা অ্যাস্ট্রো টুরিজমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন রাজস্থানের বিখ্যাত যন্তর-মন্তর, আম্বার ফোর্ট, মহারাজা বিশ্ববিদ্যালয়, জওহর কলা কেন্দ্রের মত বিশেষ জনপ্রিয় জায়গায় এই ব্যবস্থা থাকবে। নতুন দিল্লির বিকানের হাউস এও একটি টেলিস্কোপ বসানো হয়েছে। ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারী এটি চালু করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *