কীভাবে ধাপে ধাপে প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বের ও ভারতের মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে জানেন?
বিশ্বে ১৯৫টি দেশ রয়েছে, বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিটি দেশ একটি নির্দিষ্ট আকারে চিহ্নিত রয়েছে। আমাদের দেশ ভারতেরও নির্দিষ্ট মানচিত্র রয়েছে কিন্তু এসব মানচিত্র দেখলে প্রথমেই মাথায় আসে এভাবে বিশ্বের ও ভারতের মানচিত্র কে তৈরি করলো, কে প্রথম ভারতের নকশা তৈরি করেছে! বর্তমানে আমরা ভারতের যে মানচিত্র দেখি সেটা তৈরি করতে বহু বছর সময় লেগেছে। সুপ্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মানচিত্র ছিল ভারতবর্ষের। বিভিন্ন সময়ে ভারতের মানচিত্র তৈরিতে অনেক মহান ব্যক্তির অবদান রয়েছে। মানচিত্র শব্দটি দুটি শব্দ মান ও চিত্র নিয়ে গঠিত। মান শব্দের অর্থ পরিমাপ যা চিত্রাকারে দেখানো হয়। অর্থাৎ কোনও দেশের বড় ভূভাগকে ছোট প্রতিচ্ছবি আকারে দেখানোকেই মানচিত্র বলে। যদি মানচিত্র না থাকতো তাহলে আমাদের প্রিয় দেশ ভারতবর্ষ কেমন দেখতে তা জানতেও পারতাম না কখনও।
বিশ্বের ইতিহাসে অনেক ব্যক্তিই ভারতের মানচিত্র তৈরির দাবী করেছে কিন্তু ভারতের ইতিহাসে খুব কম ব্যক্তিরই উল্লেখ রয়েছে যারা বিভিন্ন সময়ে ভারতের মানচিত্র তৈরি করেছে। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে বহু ধর্মের, বহু জাতির মানুষ এসেছে তারাই সময় বিশেষে ভারতের মানচিত্র তৈরি করেছে। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্য যুগ হয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ধাপে ধাপে পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে ভারতের পরিপূর্ন মানচিত্র তৈরি করতে অনেক সময় লেগেছে।
প্রাচীন যুগে:—-
** ইমাগো মুন্ডি:– মানবজাতির ইতিহাসে বিশ্বের প্রথম মানচিত্র তৈরি করেছে ইমাগো মুন্ডি নামে এক ব্যক্তি। ইমাগো মুন্ডি ইতিহাসে ব্যাবিলোনিয়ান নামেও পরিচিত। প্রাচীন ব্যাবিলনের একজন মহান দার্শনিক ছিলেন এই ইমাগো মুন্ডি। ৬০০ বিসি বা আজ থেকে প্রায় ২,৬০০ বছর আগে ইমাগো মুন্ডি সর্বপ্রথম পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। ইমাগো মুন্ডির এই মানচিত্রে দেখা যায় পোড়ামাটির খন্ডের উপর একটি বৃত্ত এবং তার চারদিকে সাতটি ত্রিভুজ। এই সাতটি ত্রিভুজ পৃথিবীর সাতটি মহাদেশকে নির্দেশ করে। এই মানচিত্রে তৎকালীন ব্যাবিলন শহরকেও দেখানো হয়েছে। এই মানচিত্র কয়েক শতাব্দী আগে ইরাকের মরুভূমি থেকে পাওয়া গিয়েছিল। অতীতে ঐ স্থানে ব্যাবিলনের গাসুর নগরীর ধ্বংসাবশেষ ছিল। বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এই মানচিত্র রাখা হয়েছে।
** অ্যানাক্সিম্যান্ডার:—- গ্রীসের এক মহান দার্শনিক অ্যানাক্সিম্যান্ডার ৫৪০ বিসিতে বা আজ থেকে ২,৫৬৪ বছর আগে পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি করেছিল। সেসময় আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার না হওয়ায় অ্যানাক্সিম্যান্ডারের মানচিত্রে এশিয়া, ইউরোপ ও লিবিয়া বা আফ্রিকা রয়েছে শুধুমাত্র। অ্যানাক্ষিম্যান্ডার মনে করতো পৃথিবী গোলাকার ও চ্যাপ্টা।
** হেকাটেয়াস:—- ২,৫০০ বছর আগে হেকাটেয়াস অ্যানাক্সিম্যান্ডারের মানচিত্রকে সংশোধন করেন। হেকাটেয়াস তুরস্কের একজন বিখ্যাত ভূগোলবিদ ছিলেন। হেকাটেয়াসকে আধুনিক ভূগোলের জনক বলা হয়। অ্যানাক্সিম্যান্ডারের মানচিত্র দেখে পৃথিবীর মানচিত্র পরিষ্কার ভাবে বোঝা যেত না। হেকাটেয়াস এই মানচিত্রে তৎকালীন সময়ের চারটি বড় সভ্যতা মিশর, ভারতের সিন্ধু সভ্যতা, ব্যাবিলন এবং পারস্য সভ্যতাকে অঙ্কিত করেন। হেকাটেয়াসই প্রথম ব্যাক্তি যিনি বিশ্ব মানচিত্রে ভারতকে উল্লেখ করেন।
** ইরাটোসথেনিস :—- ২,৩০০ বছর আগে লিবিয়াতে জন্ম হয়েছিল ইরাটোসথেনিসের। পেশায় একজন গনিতজ্ঞ ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বের যে মানচিত্র তৈরি করেছিলেন তাতে ভারতের সিন্ধু সভ্যতা, গঙ্গা নদীকে দেখানো হয়েছে। ২,৩০০ বছর আগে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা করেছিল সেজন্য তিনি ইরাটোসথেনিসকে নির্দেশ দেন বিশ্বের মানচিত্র তৈরি করার জন্য।
** টলেমীর নাকশা:—- আজ থেকে ১,৯০০ বছর আগে মিশরে জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত গনিতজ্ঞ ও ভূগলবিদ টলেমীর। বিশ্বের মানচিত্র ও ভারতের মানচিত্র যথার্থ ভাবে সর্বপ্রথম টলেমীই তৈরি করেছিলেন। বলা হয় ১,৯০০ বছর আগে টলেমী ভারত সফর করেছিলেন এবং তারপর দেশে ফিরে গিয়েই ভূগোলের বই লেখেন এবং সেখানে ভারতের মানচিত্রে তিনি উত্তরে হিমালয় পর্বত থেকে দক্ষিন ভারত পর্যন্ত দেখিয়েছেন তিনি।
মধ্যযুগে:—-
** দশম শতকে মেসোপটোমিয়ার মহম্মদ আবু হকল পৃথিবীর একটি মানচিত্র তৈরি করেছিলেন।
** ১১৫৪ সালে মহম্মদ আল ইদ্রিশি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানচিত্র তৈরি করেন। তার তৈরি এই মানচিত্রেই ভারতবর্ষের সীমানা সর্বপ্রথম ঠিকঠাক দেখানো হয়। ক্রিস্টোফার কলম্বাস এবং ভাস্কো দা গামা মহম্মদ আল ইদ্রিশের মানচিত্র দেখেই আমেরিকা ও ভারতে পৌঁছেছিল। মহম্মদ আল ইদ্রিশের এই মানচিত্রকে ট্যাবুলা রোজেরিয়ানা বলা হয়।
** ১৫০৫ সালে ইতালির নিকোলাই ডি কাভেরী বিশ্বের একটি মানচিত্র তৈরি করেন। এটাই বিশ্বের প্রথম মানচিত্র যেখানে আমেরিকা ও কানাডার উল্লেখ রয়েছে কারন ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন।
** পনেরো শতকে আব্রাহাম অর্টিলিয়াসের তৈরি মানচিত্রকে মধ্যযুগের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানচিত্র বলা হয়। বেলজিয়ামের নাগরিক আব্রাহাম আর্টিলিসের তৈরি মানচিত্র অনেক বেশী নিখুঁত ছিল পূর্বের সমস্ত মানচিত্রের থেকে। তার তৈরি এই মানচিত্রে ভারত সহ আফ্রিকা মহাদেশকে অনেক ভালোভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তার এই মানচিত্রে আমেরিকা ও দক্ষিন আমেরিকাকে সঠিক ভাবে দেখনো হয়নি কারন ১৪৯২ সালে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের পর পনেরো শতকে আমেরিকার মূল ভূভাগ সম্পর্কে পূর্ন ধারনা পাওয়া যায়নি তখনও।
** ১৬৩০ সালে নেদারল্যান্ডসের নাগরিক হেনড্রিক হনডিয়াসের মানচিত্রে সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়াকে দেখানো হয় কারন ১৬২৩ সালেই অস্ট্রলিয়া আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তবে মাত্র সাত বছর আগেই অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার হওয়ায় এই মানচিত্রে অস্ট্রেলিয়ার সঠিক আকার দেখানো সম্ভব হয়নি।
আধুনিক যুগ:—-
সতেরো শতক থেকে ইউরোপীয়ান দেশগুলো নতুন ভূমি আবিষ্কার ও সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় মেতে ওঠে। ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। এসময়েই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসে। বানিজ্যের উদ্দেশ্যে সংস্থাটি ভারতে আসলেও ভারতের ঐশ্বর্য, প্রাচুর্য দেখে অবাক হয়ে যায় ব্রিটিশরা এবং ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য ভারতের পূর্নাঙ্গ মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করে ব্রিটিশরা। ১৭৬৪ সালে জেমস রেনেল ভারতের গাঙ্গেয় ও হিমালয় অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভেয়ার ছিল এই জেমস রেনেল।
১৭৭৯ সালে জেমস রেনেল ভারতের পূর্নাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করে কিন্ত এই মানচিত্রে বেশ কিছু সমস্যা ছিল, ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ন স্থান এই মানচিত্রে ছিলনা।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে জেতার পর ব্রিটিশরা ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার ও কর আদায় শুরু করে। তখন উইলিয়াম ল্যাম্বটনকে ভারতের মানচিত্র তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ল্যাম্বটন একজন বিশিষ্ট গনিতজ্ঞ ও ভূগোলবিদ ছিলেন। ১৮০২ সালের ১০ এপ্রিল মাদ্রাজ থেকে ভারতের মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করেন উইলিয়াম ল্যাম্বটন। মনে করা হয়েছিল পাঁচ বছরের মধ্যে এই কাজ সম্পূর্ন হয়ে যাবে কিন্তু ব্রিটিশদের ভারতের মানচিত্র তৈরি করতে সত্তর বছর সময় লেগে যায়।
১৮০২ সাল থেকে পরবর্তী আঠারো বছর ধরে ভারতের এক তৃতীয়াংশ মানচিত্রই তৈরি করতে পারেনি উইলিয়াম ল্যাম্বটন এবং তিনি অবসরে চলে যান। এরপর জর্জ এভারেস্ট ১৮৩০ সাল থেকে ভারতের মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৮৪১ সালের মধ্যে উত্তরে হিমালয় পর্বত থেকে দক্ষিনে কন্যাকুমারী পর্যন্ত তিনি জরিপ করে ফেলেছিলেন কিন্ত হিমালয় পর্বতমালার পূর্ন সমীক্ষা করা তার পক্ষেও সম্ভব হয়নি। ১৮৪৩ সালে তিনি অবসরে চলে যান এবং অ্যান্ড্রু স্কট ওয়াঘ আসেন তার জায়গায়। অ্যান্ড্রু স্কট পুরো হিমালয় পর্বতমালার সমীক্ষা করেন, এইসময়েই কারাকোরাম পর্বতমালা আবিষ্কার করা হয় এবং হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ উচ্চতম অংশ মাউন্ট এভারেস্টের খোঁজ পাওয়া যায়। জর্জ এভারেস্টের নামেই হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ উচ্চতার নাম হয় মাউন্ট এভারেস্ট কিন্তু বলা হয় মাউন্ট এভারেস্ট খুঁজে বের করেন জর্জ এভারেস্টের দলেরই এক সদস্য বিখ্যাত গনিতজ্ঞ রাধানাথ শিকদার কিন্ত ব্রিটিশরা জর্জ এভারেস্টের নামে হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ উচ্চতার নাম রাখে। সেসময় তিব্বত একটি রহস্যময় দেশ ছিল, সেখানে ইউরোপীয়ানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু ভারতীয়দের যাওয়ার অনুমতি ছিল। এই জন্য ব্রিটিশরা পন্ডিত নাইন সিং ও পন্ডিত কিষেন সিং নামে দুই ভাইকে গোপনে তিব্বত পাঠান। এই দুই ভাই নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা যায় এবং পরে মঙ্গোলিয়া যায়।
১৮৬৫ থেকে ১৮৯২ পর্যন্ত তিব্বতে গোপনে পূর্ন সমীক্ষা করে তারা এবং বহু গুরুত্বপূর্ন নদীর উৎসস্থলও খুঁজে পায় তারা। তাদের জন্যই রহস্যময় তিব্বতের অনেক তথ্যই জানা যায়। তিব্বত, মঙ্গোলিয়ার পূর্ন সমীক্ষার পর তারা ভারতে ফিরে এসে আরও মানুষকে সমীক্ষা করবার প্রশিক্ষন দেয়। এভাবে ৭০ বছর ধরে বহু মানুষের প্রচেষ্টার পর আধুনিক ভারতের মানচিত্র তৈরি হয়।