অফবিট

আমেরিকার বহু গোপন তথ্য রাশিয়ার গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দিয়েছিল মার্কিন যে এজেন্ট

মানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়ানক যুদ্ধ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে সত্তর থেকে আশি মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়াও কত কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল তার সঠিক কোন হিসাব নেই। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল গুলির মধ্যে একটি এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন সহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশ গুলো বুঝতে পারে যুদ্ধ কোন সঠিক পথ নয়, এরপরেই শুরু তৎকালীন বিশ্বের দুটি সর্বাধিক শক্তিশালী দেশ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ, যা শেষ হয় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মাধ্যমে। স্নায়ুযুদ্ধে দুটি দেশের মধ্যে সরাসরি কোন মিলিটারি সংঘর্ষ হয়নি বরং দুই দেশ তাদের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে একে অপরের উপর নজরদারি করত যাতে অন্য দেশের তুলনায় নিজে সর্বশ্রেষ্ঠ হতে পারে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআই এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল এই সময়। কিন্তু এরই মধ্যে উভয় সংস্থার কিছু এজেন্ট অর্থের জন্য শত্রু দেশের হয়ে কাজ করতো এদের ডবল এজেন্ট বলা হত। সিআইএর এমনই এক ডবল এজেন্ট হচ্ছে অলড্রিচ এমস যে সিআইএর বহু গোপন তথ্য কেজিবির হাতে তুলে দিয়েছিল।

১৯৪১ সালের ২৬ মে আমেরিকার উইসকনসিনের রিভার ফলসে জন্ম হয়েছিল অলড্রিচ এমসের। তার বাবা কলেজের প্রফেসর ছিলেন এবং মা ছিলেন একজন ইংরেজির শিক্ষিকা। ১৯৫২ সালে তার বাব কার্টার এমস সিআইএতে যোগ দেয়। ১৯৫৩ সালে তাকে দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে পাঠানো হয়। তিন বছর দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে থাকার পরেও তার কাজে খুশি ছিলনা সিআইএ। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর অলড্রিচ এমস সিআইএতে যোগ দেয়। ১৯৬২ সালে তাকে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয় এবং পাঁচ বছর মন দিয়ে কাজ করে সিআইএর হয়ে। ১৯৬৯ সালে তার সাথে পরিচয় হয় তারই এক সহকর্মী ন্যান্সির। সেই বছরই উভয়ে বিবাহ করেন। বিয়ের পর ন্যান্সি সিআইএ ছেড়ে দেয়, কারন সেসময় সিআইএর নিয়ম ছিল বিবাহিত দম্পতির মধ্যে যে কোনও একজন কাজ করতে পারবে। কিছুদিন পর অলড্রিচ এমসকে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারাতে পাঠানো হয়৷ যেখানে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কেজিবি এজেন্টদের খুঁজে বার করার। সেসময় তুরস্কে দেভ জানিক নামে একটি সোভিয়েত পন্থী সংগঠন সক্রিয় ছিল। ১৯৬৫ সালে তৈরি এই সংগঠন বহুদিন ধরেই সিআইএর নজরে ছিল। অলড্রিচ এমস অত্যন্ত কৌশলে এই সংগঠনে প্রবেশ করে এবং সমস্ত গোপন তথ্য সিআইএকে পাঠাতে থাকে। ১৯৭১ সালে এই সংগঠন বন্ধ হয়ে যায়। অলড্রিচ এমসের এই অসাধারন দক্ষতার কারনে যেখানে তাকে পুরস্কৃত করার কথা সেখানে সিআইএ তার এই কাজকে ততটা গুরুত্বই দেয়নি, এই ঘটনায় অলড্রিচ এমস এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে সে সিআইএ ছেড়ে দেবার কথা পর্যন্ত ভেবেছিল। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল অবধি অলড্রিচ এমস সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব ইউরোপীয়ান বিভাগের উপর নজরদারি করতে অসম্ভব পরিশ্রম করে। যার ফলস্বরূপ সিআইএ তাকে নিউইয়র্কে ডাকে এবং কেজিবির গুরুত্বপূর্ন দুজন গুপ্তচরের জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। অলড্রিচ এই কাজ এতটা সফল ভাবে করেছিল যে সিআইএ তাকে প্রোমোশন দেবার পাশাপাশি প্রচুর বোনাস দেয়। তবে সিআইএ এটাও নজর রেখেছিল যে অলড্রিচ এমস প্রচুর অ্যালকোহল খায়। অলড্রিচ এমসের সাফল্য দিনের পর দিন বেড়েই চলেছিল। অবশেষে আসে ১৯৮১ সাল, এই বছর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ন পরিবর্তন নিয়ে আসে। ১৯৮১ সালে তাকে মেক্সিকো পাঠানো হয়। সেখানে সে কাজ ভালো করছিলো কিন্তু ধীরে ধীরে মেক্সিকোর রঙিন জীবনে আসক্ত হয়ে পড়ে। এই সময় একাধিক নারীর সাথে তার সম্পর্ক তৈরি হয় এবং কলম্বিয়ার দূতাবাসে কাজ করা সিআইএ এজেন্ট মারিয়া ডেল রোজারিও এর সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেক্সিকোতে থাকার সময়ই তার অ্যালকোহল আসক্তি আরও বৃদ্ধি পায় এবং একাধিক সিনিয়র অফিসারের সাথে বাজে ব্যাবহারের জন্য তাকে ১৯৮৩ সালে ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে অলড্রিচ এমসকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কেজিবি ও সোভিয়েত মিলিটারির উপর তথ্য বিশ্লেষনের। এইসময় তার স্ত্রী ন্যান্সি তার বিরুদ্ধে ডিভোর্সের দাবি করে কিন্তু ডিভোর্সের জন্য এমন সব শর্ত দাবী করা হয় যার করনে অলড্রিচ এমস চমকে যায়। ন্যান্সি ডিভোর্সে জন্য দাবী করে পরবর্তী সাড়ে তিনবছর অবধি প্রতি বছর অলড্রিচ এমসকে ছেচল্লিশ হাজার ডলার করে দিতে হবে ন্যান্সিকে, যা একটি বিশাল অর্থ। এছাড়া মারিয়া ডেল রোজারিওর জন্যও অলড্রিচ মাসে একটি বড় অর্থ খরচ করতো। সব মিলিয়ে অলড্রিচের দেওলিয়ার মতো অবস্থা হয়। এদিকে অলড্রিচ গোপনে ১৯৮৫ সালে মারিয়াকে বিয়েও করেছিল, তাদের একটি পুত্র সন্তানও ছিল যার নাম পল। সিআইএ অলড্রিচের এই দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানতো না। দেওলিয়ার হাত থেকে বাঁচতে অলড্রিচ সোভিয়েত দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ শুরু করে এবং তাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাঠায়। 

সোভিয়েত অলড্রিচকে প্রথমেই পঞ্চাশ হাজার ডলার দেয়। এই বিশাল অর্থ পেয়ে ব্যাপক লোভ বেড়ে যায় তার। এরপর অর্থের জন্য অলড্রিচ এমস সিআইএর গুরুত্বপূর্ন অফিসারদের নাম কেজিবিকে পাঠাতে শুরু করে, যাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করে কেজিবি। কেজিবির যেসব ডবল এজেন্ট সিআইএর হয়ে কাজ করছিলো তাদের নামও অলড্রিচ কেজিবিকে জানায় তাদেরও হত্যা করা হয়। এর বদলে ব্যাপক অর্থ পেতে থাকে অলড্রিচ এমস। সিআইএর একের পর এক গুরুত্বপূর্ন এজেন্টদের মৃত্যুর পর ১৯৮৬ সালে সিআইএ একটি তদন্ত দল গঠন করে কারন সিআইএ সন্দেহ করছিলো তাদের ভিতরেই কোন এজেন্ট আছে যে কেজিবির সাথে যুক্ত। সিআইএ প্রথমে সন্দেহ করে এডওয়ার্ড লি নামে এক এজেন্টকে কিন্তু আরও তিনজন এজেন্টের মৃত্যুর পর সিআইএ বুঝতে পারে এডওয়ার্ড লি নির্দোষ কারন ওই সব এজেন্টদের ব্যাপারে জানতোই না এডওয়ার্ড লি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এডওয়ার্ড লি একজন ডবল এজেন্ট ছিল, তার রহস্যময় মৃত্যুর পর এই তথ্য জানতে পারে সিআইএ। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে প্রায় ৪.৬ মিলিয়ন ডলারের বিশাল অর্থ পায় কয়েক বছরে অলড্রিচ। সিআইএ যাতে তাকে সন্দেহ না করে সেজন্য সে একটি নিখুঁত পরিকল্পনা করে। অলড্রিচ তার দ্বিতীয় বিয়ে এবং স্ত্রী মারিয়ার কথা সিআইএকে জানায়। অলড্রিচ সিআইএকে জানায় মারিয়া কলম্বিয়ার একটি ব্যাবসায়িক পরিবারের মেয়ে যাতে সিআইএ অর্থের ব্যাপারে সন্দেহ না করে। সিআইএ অলড্রিচকে রোমে পাঠায় নতুন মিশনে। সেখানে গিয়েও অলড্রিচ সিআইএ এবং কেজিবি উভয়ের হয়েই কাজ করতে থাকে। এদিকে তদন্তকারী দলও কাউকে দোষী খুঁজে পাচ্ছিলনা। কিন্তু এমন একটি ঘটনা ঘটে যা অলড্রিচ এমসের পতনের সূচনা করে। 

১৯৮৬ সালে ওলেক গোর্দেভিস্কিনামে এক কেজিবি এজেন্ট ব্রিটেনের এমআইসিক্সের হয়ে কাজ করতে শুরু করে। ওলেক এমআইসিক্সকে বেশ কয়েকজন ডবল এজেন্টের নাম পাঠায় যার মধ্যে একটি নাম ছিল এই অলড্রিচ এমস। এমআইসিক্স সাথে সাথে এই তথ্য সিআইএকে জানায়। এদিকে কেজিবিও বুঝতে পারে অলড্রিচ এমসের নাম জেনে গেছে সিআইএ। কেজিবির থেকে সব শুনে ভেঙে পড়ে অলড্রিচ এমস, কারন সিআইএ তার পলিগ্রাফিক টেস্ট করবে আর তা থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে অলড্রিচ পলিগ্রাফিক টেস্টে পাশ করে যায়, যাতে সে নিজেও অবাক হয়ে যায়। পরে জানা যায় পলিগ্রাফিক টেস্টের পরীক্ষক কেজিবির এজেন্ট ছিল। এর থেকে বোঝা যায় সেসময় সিআইএর উপর কেজিবির কতটা আধিপত্য ছিল। পলিগ্রাফিক টেস্ট পাশ করার পর অলড্রিচ এমস পূর্ন উদ্যমে পুনরায় তথ্য পাচার শুরু করে কেজিবিকে। 

১৯৯১ সাল আসতে আসতে অলড্রিচের কাছে এতটা অর্থ এসে যায় যে ভার্জিনিয়াতে সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের বিলাসবহুল বাড়ি কেনে সে এবং বাড়ি সাজাতে এক লাখ ডলার খরচ হয়। পঞ্চাশ হাজার ডলারের জাগুয়ার গাড়িও কেনে সে। অলড্রিচ এমসের সিআইএতে বার্ষিক আয় ছিল ষাট হাজার ডলার। সুতরাং অলড্রিচ এমসের এত বিলাসবহুল জীবনযাপনে সন্দেহ জাগে সিআইএর। ১৯৯৩ সালে সিআইএ জানত অলড্রিচ তার স্ত্রী মারিয়ার ব্যাপারে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে তার উপর আরও নজরদারি বাড়িয়ে দেয় সিআইএ। তার গাড়তে ট্রাকার লাগিয়ে দেয় সিআইএ। ১৯৯৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সিআইএ জানতে পারে গুরুত্বপূর্ন বৈঠকের জন্য অলড্রিচ মস্কো যাবে। সাথে সাথে সেই দিনই অলড্রিচ এমস ও তার স্ত্রী মারিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। ২৮ এপ্রিল আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয় অলড্রিচ এমস এবং সে তার সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে নেয়। দেশ বিরোধী কাজকর্মের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় অলড্রিচ এমসের। মারিয়া ডেল রোজারিওর পাঁচ বছরের সাজা হয়। সিআইএর ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত ডবল এজেন্ট ছিল এই অলড্রিচ এমস যাকে গ্রেফতার করতে সিআইএর বহু বছর লেগে যায়। অলড্রিচ এমসের কারনে সিআইএর প্রচুর গুরুত্বপূর্ন এজেন্ট প্রান হারিয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *