অফবিট

ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠনের উত্থান কিভাবে হয়েছিল? পতনের পেছনেই বা কারণ কি?

আইএস আইএস বা ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক এন্ড সিরিয়া বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন একটা সময় গোটা বিশ্বে তাদের সন্ত্রাসী কাজকর্মের জন্য মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। গনহত্যা হোক, জীবন্ত মানুষের মাথা কেটে নেওয়া হোক কিংবা মানুষের ভিড়ের মধ্যে ট্রাক চালিয়ে দেওয়া হোক এমন অনেক ভাবে তারা বহু মানুষকে হত্যা করেছে। ২০১৫ সালে আইএস আইএস সিরিয়ার এক তৃতীয়াংশ এবং ইরাকের চল্লিশ শতাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছিল। আমেরিকা সহ ন্যাটোর বিভিন্ন দেশের বিশেষ বাহিনী পর্যন্ত প্রথম দিকে আইএস আইএসকে আটকাতে পারেনি। কিন্তু ২০১৭ সাল আসতে আসতে আইএস আইএসের আতঙ্কের পরিমান কমে আসতে শুরু করে, তাদের অধিকৃত ৯৫ শতাংশ জায়গা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। বছরে এক বিলিয়ন ডলার উপার্জন করা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একটা সময় মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হয় তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে। কী এমন হল যে আইএস আইএসের মতো কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন আজ শুধুমাত্র একটি সাধারন সংগঠন হয়ে রয়ে গেছে।

আইএস আইএসের উত্থান হয় ২০০৩ সালের দিকে আমেরিকা ইরাক যুদ্ধের সময়। আমেরিকা সাদ্দাম হোসেন সরকারের পতন ঘটিয়ে ইরাকে একটি রাজনৈতিক শূন্যস্থান তৈরি করে। ফলে একাধিক আঞ্চলিক দল এর সুযোগ নেয়। এই সময়ে ইরাকে উত্থসন হয় আবু মুসাব আল জারকাওয়ি নামে এক ব্যাক্তির। জারকাওয়ি আফগানিস্তানে আল কায়দার একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিল যে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষন দিত। ইরাকের রাজনৈতিক শূন্যস্থানের সুযোগ নিয়ে ২০০৪ সালে ইরাকে আল কায়দার একটি শাখা আল কায়দা ইন ইরাক বা একিউআই তৈরি করে। পরে এই সংগঠনই আইএস আইএস নামে পরিচিত হয়। একিউআই ইরাকে সমস্ত সন্ত্রাসী সংগঠনকে একত্রিত করে আমেরিকার বিরুদ্ধে গোরিলা যুদ্ধ শুরু করে। বোম্ব তৈরি ও যুদ্ধ নীতি তৈরিতে পারদর্শী আবু মুসাব আল জারকাওয়ি আত্মঘাতী বোম্বিং ও গোরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে আমেরিকান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। আমেরিকান সেনা অনেক চেষ্টা করেও তাকে ধরতে পারেনি। তবে ২০০৬ সালে আমেরিকান বায়ুসেনার বোম্বিংএ মারা যায় আবু মুসাব আল জারকাওয়ি। এরপর আবু আয়ুব আল মাসরি এবং আবু ওমর আল বাগদাদি একিউআই এর নেতৃত্বভার গ্রহন করে। এরাই একিউআই এর নাম পরিবর্তন করে ইসলামিল স্টেট ইন ইরাক বা আইএসআই রাখে।

২০০৭ আসতে আসতে আইএসআই ইরাকের একটি শক্তিশালী সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিনত হয়, আল কায়দার মতোন কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে তাদের তুলনা হতে থাকে। ইরাকে গৃহযুদ্ধের সুযোগে আইএসআই তাদের ক্ষমতা বাড়াতে থাকে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে থাকে। তবে আমেরিকার বায়ুসেনার একের পর এয়ার স্ট্রাইকে প্রচুর ক্ষতি হতে থাকে আইএসআই এর। ২০০৮ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনী ও বায়ুসেনা প্রায় আট হাজার আইএসআই সদস্যকে হত্যা করে। ২০১০ সালে আমেরিকা ও ইরাক সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে আইএসআই এর দুই প্রধান আবু আয়ুব ও আবু ওমরকে হত্যা করা হয়। এরপর আইএসআই এর নতুন প্রধান হয় আবু বকর আল বাগদাদি। বর্তমানের নিষ্ঠুর আইএস আইএস গড়ে গোলার পেছনে এই বাগদাদিই জড়িত। যৌনদাসী, ধর্ষন, ইয়াজেদিদের গনহত্যা, পাথর ছুঁড়ে হত্যা, ইন্টারনেটে জীবন্ত ব্যাক্তির মাথা কেটে দেবার ভিডিও প্রকাশ মতোন আরও অনেক নারকীয় ঘটনার মাস্টারমাইন্ড এই আবু বকর আল বাগদাদি। নৃশংসতার বিচারে বিশ্বের সমস্ত সন্ত্রাসী সংগঠনকে ছাপিয়ে যায় আইএসআই। 

২০১১ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকান সেনাবাহিনীর ইরাক ছেড়ে চলে যাবার পরই ইরাকের পাশাপাশি সিরিয়াতেও প্রভাব বিস্তার শুরু করে আইএস আইএস। এপ্রিল, ২০১৩ তে বাগদাদি তার আইএসআই সদস্যদের সিরিয়া পাঠায়। সেখানে স্থানীয় সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যৌথভাবে আইএস আইএস বা ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক এন্ড সিরিয়া গঠন করে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে উত্তর সিরিয়ার রাক্কা শহরে ব্যাপক গনহত্যা চালিয়ে পুরো শহর নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ইরাক ও সিরিয়া এই দুটি দেশে দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক সংকটের কারনে এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের উত্থান হয়। এই দুটি দেশে আমেরিকার সমর্থিত সরকার ছিল যাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল। সরকারের পতন ঘটানোর জন্যই এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের উত্থান হয়। যারা ইরাক ও সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সাথেও যুদ্ধ করে। আইএস আইএস ইরাক ও সিরিয়াতে জেল ভেঙে সমস্ত কয়েদিদের মুক্ত করে তাদের সদস্য করে। রাক্কা দখল করে আইএস আইএস রাক্কাকে তাদের রাজধানী ঘোষনা করে এবং আল বাগদাদিকে খলিফা ঘোষনা করে। 

জুন, ২০১৪ আইএস আইএস ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয়। মসুল ড্যামকে দখল করে নেয় এইসময় আইএস আইএস। এই ড্যামের উপর প্রায় পাঁচ লাখ ইরাকি মানুষ নির্ভরশীল ছিল। ২০১৪-১৫ সালে আইএস আইএসের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশী ছিল। তারা সিরিয়া ও ইরাকের তেল উত্তোলন কেন্দ্র গুলোকে দখল করে নিয়ে তেলের কালোবাজারি শুরু করে। ২০১৬ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় ১২০০ লোককে হত্যা করে বিভিন্ন ভাবে আইএস আইএস। এদের মধ্যে বিদেশী নাগরিক থেকে শুরু করে, শিয়া আরবীয় মানুষও ছিল। তুরস্কের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোম্বিং, আমেরিকার ফ্লোরিডাতে গুলি চালানো ও ফ্রান্সে মানুষের উপরে ট্রাক চালানোর মতোন একাধিক নৃশংস কাজ করে আইএস আইএস। তবে এত শক্তিশালী হওয়া সত্বেও ধীরে ধীরে আইএস আইএসের পতন শুরু হয়। 

জুলাই, ২০১৭ তে ইরাকি সেনাবাহিনী আইএস আইএসকে হটিয়ে দেয় মসুল শহর থেকে। এর কিছুদিন পর ইরাকি সেনাবাহিনী রাক্কা থেকেও আইএস আইএসকে হটিয়ে দেয়। ডিসেম্বর, ২০১৭ আসতে আসতে আইএস আইএস তাদের ৯৫ শতাংশ জায়গা হারিয়ে ফেলে। অপহরন, জুয়া ও তেলের কালোবাজারির মতোন সমস্ত ব্যাবসা আইএস আইএসের হাত থেকে বেড়িয়ে যায়। বাধ্য হয়ে মাছ বিক্রি করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে শুরু করে আইএস আইএস। 

মার্চ, ২০১৯ আসতে আসতে আইএস আইএসের শেষ অবলম্বন ইরাকের আল বাগহুজ ফাওকোয়ানি শহর হাতছাড়া হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আইএস আইএস এর বেঁচে যাওয়া কিছু সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে থাকতে শুরু করে। কারন আল বাগহুজ শহরের লড়াইয়ে বেশীরভাগ আইএস আইএস সদস্য মারা যায় এবং অনেকে আত্মসমর্পন করে। কিন্ত ২০১৫ সালে সবচেয়ে শক্তিশালী এই সংগঠনের হঠাৎ করে কেন পতন হল!! এর পেছনে একাধিক কারন ছিল।

আইএস আইএসের একাধিক নৃশংস হত্যাকান্ড দেখে স্থানীয় মানুষজন আইএস আইএসের প্রতি কোন সমর্থন দেখায়নি। একাধিক শহর দখল করার পরও সেখানকার মানুষের চাহিদা পূরনে ব্যার্থ হয় আইএস আইএস। মানুষ তার খাদ্য, জল ও বিদ্যুৎ এর মতো অত্যাবশকীয় উপাদান পায়নি ফলে ধীরে ধীরে আইএস আইএস স্থানীয় মানুষের সমর্থন হারাতে শুরু করে। বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী দেশ আমেরিকা, ফ্রান্স সহ ন্যাটোর সেনা যৌথভাবে আইএস আইএসের উপর একাধিক আক্রমন করতে শুরু করে, ড্রোন হামলা ও এয়ার স্ট্রাইক ও মিলিটারি আক্রমন শুরু হয়, সাথে ইরাকি ও সিরিয়া সেনাবাহিনীর অভিযানে একের পর এক আক্রমন করতে শুরু করে যাতে আইএস আইএসের বহু সদস্য মারা যায়। এয়ারস্ট্রাইকে আইএস আইএসের নেতা আবু বকর আল বাগদাদি মারা যায়, এরপর সংগঠন দুর্বল হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংগঠন গুলো আইএস আইএসের সমস্ত অর্থ উপার্জনের উৎসকে বন্ধ করে দেয়। আইএস আইএসের নিয়ন্ত্রনে থাকা সমস্ত তেলের কেন্দ্র গুলো উদ্ধার করে নেয় ইরাক ও সিরিয়া সেনা। ফলে নতুন সদস্য ও পুরোনো সদস্যদের দেওয়ার মতো অর্থ ছিলনা আইএস আইএসের কাছে। আইএস আইএস বিভিন্ন অনলাইন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে তরুনদের ব্রেনওয়াশ করে তাদের সংগঠনে যুক্ত করতো। বিশ্বের সমস্ত দেশ একত্রিত হয়ে এসব অনলাইন ওয়েবসাইট গুলোকে বন্ধ করে দেয়৷ বিশ্বের বহু  সংগঠন ব্রেনওয়াশ হওয়া তরুনদের আইএস আইএসের হিংসার বিরুদ্ধে প্রকৃত শিক্ষা ও মানবতা সম্পর্কে বোঝাতে শুরু করে। সিরিয়া ও ইরাকের সরকার তাদের সীমানায় নজরদারি আরও বাড়িয়ে দেয় যার কারনে অন্যান্য দেশ থেকে আসা নতুন সদস্যরা আইএস আইএসে যোগ দিতে পারেনি। এসব কারনে আইএস আইএসের কোমড় ভেঙে যায়। সিরিয়ার কিছু অংশে বেশ কিছু আইএস আইএস সদস্য এখনও আত্মগোপনে রয়েছে তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *