অফবিট

যত সময়ই নষ্ট হোক। ইসরায়েলে আক্রমনকারী ব্যক্তিদের ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা তাদের হত্যা করবেই

১৯৪৮ সালের ১৪মে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর থেকে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলো দ্বারা বারবার আক্রমনের স্বীকার হয়েছে ইসরায়েল কিন্তু ইসরায়েল আরব দেশগুলোকে প্রতিবারই যুদ্ধে পরাজিত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে অ্যাডলফ হিটলারের নাজি সেনার হলোকাস্ট বা ইহুদি গনহত্যার কারনে ইহুদিরা বুঝে গিয়েছিল তাদের নিজেদের দেশ ইসরায়েলকে রক্ষা করতে না পরলে হয়ত ভবিষ্যতে ইহুদি জাতির অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যাবে। এই কারনে ইসরায়েল সময়ের সাথে সাথে নিজেকে সামরিক ভাবে শক্তিশালী করে তোলে, যার জন্য আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে কখনও যুদ্ধে পরাজিত করতে পারেনি। সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত করতে না পেরে ইসরায়েলে গোরিলা আক্রমনের জন্য অনেক সংগঠন তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। এসব সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইসরায়েলে আক্রমনের চেষ্টাও করেছে কিন্তু ইসরায়েলের মোসাদ, শিনবেটের মতো ইনটেলিজেন্স সংস্থার কারনে ইসরায়েলের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। ইসরায়েলের একটি নীতি হচ্ছে শত্রুদের শেষ করে দেওয়া, ইসরায়েলে আক্রমনকারী ব্যক্তিদের যত সময়ই লাগুকনা কেন ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থাগুলি তাদের হত্যা করবেই। ইতিহাসে এরকম অজস্র উদাহারন রয়েছে যেখানে মোসাদ ইসরায়েলের শত্রুদের হত্যা করেছে অন্য দেশে ঢুকেও। ঠিক এমনভাবেই মোসাদ ১৯৮০ এর দশকে ইসরায়েলের এক শত্রু খালিল আল ওয়াজিরকে হত্যা করেছিল। 

১৯৩৫ সালে ফিলিস্তিনের রামলা শহরে জন্ম হয় খালিল আল ওয়াজিরের। সেসময় ফিলিস্তিন ব্রিটিশ অধীনে ছিল। ১৯৪৮ সালে রামলা ও লায়দা দুটি শহর থেকে অন্তত ৫০,০০০-৭০,০০০ ফিলিস্তিনিদের বের করে দেওয়া হয় কারন আরব ইসরায়েল যুদ্ধে এই দুটি শহর ইসরায়েল জিতে নেয়। খালিলের পরিবার গাজা উপত্যকার কাছে শরনার্থী শিবিরে চলে যায়। সেখানেই জাতিসংঘের শরনার্থী স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে খালিল। এইসময় থেকেই সে ইসরায়েল বিরোধী দলে যোগ দেয় এবং ইসরায়েল সেনাবাহিনীর উপর ছোটখাটো আক্রমন করা শুরু করে। ১৯৫৪ সালে খালিলের সাথে পরিচয় হয় ইয়াসির আরাফাতের সাথে। পরবর্তীকালে খালিল ইয়াসির আরাফাতের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সাথীতে পরিনত হয়েছিল। খালিল ১৯৫৪ সালে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেয়, এর জন্য তাকে জেলেও যেতে হয় কারন মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৫৬ সালে কায়রোতে সামরিক প্রশিক্ষন নেয় খালিল এবং মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতাত্ত্বের বিষয়ে শিক্ষা গ্রহন করে। 

১৯৫৭ সালে পুনরায় ইসরায়েল বিরোধী কাজকর্মের জন্য গ্রেফতার করা হয় তাকে। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর খালিল কুয়েত চলে যায় এবং শিক্ষকতার কাজ শুরু করে। কুয়েতে ইয়াসির আরাফাতের সাথে ফাতাহ সংগঠন তৈরি করে খালিল। এইসময় কুয়েতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথেও যোগাযোগ ছিল তার। কুয়েত থেকে কিছু সময় পর লেবাননের বেইরুটে চলে যায় খালিল এবং বেইরুট থেকে ফিলিস্তিনের সমর্থনে পত্রিকা প্রকাশ শুরু করে। 

১৯৬২ সালে খালিল আলজেরিয়ার চলে যায় এবং সেখানে ফাতাহর কার্যালয় ও প্রশিক্ষন কেন্দ্র তৈরি করে। ১৯৬৪ সালে খালিল বেজিং যায়, সেখানে চীনের সরকারকে ফাতাহর ব্যাপারে জানায়, চীন থেকে উত্তর কোরিয়াও যায় খালিল। চীনের সমর্থনে খালিল ফাতাহর সশস্ত্র বিভাগ আল আসিফা তৈরি করে। খালিল আবু আলিকে নিযুক্ত করে এইসময় যে পরবর্তীকালে জর্ডান ও সিরিয়াতে আল আসিফার উচ্চপদস্থ কম্যান্ডার হয়। 

১৯৬৫ সালে দামাস্কাসেও ফাতাহর সংগঠন তৈরি করে খালিল আল ওয়াজির। ১৯৬৭ সালে ছয়দিনের যুদ্ধে আরব দেশগুলোর ইসরায়েলের কাছে পরাজিত হওয়ার পর ফাতাহ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলওতে যোগ দেয়। পিএলওতে ১০৫ আসনের মধ্যে ৩৩টি আসন ফাতাহকে দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে ইয়াসির আরাফাত পিএলওর সভাপতি নির্বাচিত হয়। খালিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কারামার যুদ্ধে অংশ নেয় ১৯৬৮ সালে এবং পরবর্তীকালে লেবাননের গৃহযুদ্ধেও অংশ নেয়। খালিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে ১৯৭৫ সালে। 

১৯৭৫ সালের ৪-৫ মার্চ ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিভের হোটেল সেভয়ের উপর আক্রমন করায় খালিল। সন্ত্রাসীরা হোটেলে আটজন ব্যাক্তি সহ তিনজন ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করে। ৪ জুলাই, ১৯৭৫ সালে জেরুজালেমের একটি দোকানে খালিল আক্রমন করায় যাতে ১৫ জন ইসরায়েলি নাগরিকের মৃত্যু হয়। মার্চ, ১৯৭৮ সালে খালিলের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা একটি ইসরায়েলি বাস হাইজ্যাক করে ৩৫ জন ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা করে। ১৯৮০ সালে পশ্চিমব্যাঙ্কের হেব্রনে ছয়জন ইহুদিকে হত্যা করায় খালিল। এভাবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ইসরায়েলে একের পর এক আক্রমন করে মোসাদের হিট লিস্টে চলে আসে খালিল আল ওয়াজিরের নাম। 

১৯৮২ সালে ইসরায়েল সেনাবাহিনী বেইরুট ঘিরে ফেলে অভিযানের জন্য, তখন খালিল পিএলওকে নির্দেশ দেয় যে ভাবেই হোক বেইরুট ছেড়ে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু পিএলও হাইকম্যান্ড খালিলের কথা না শুনেই ইসরায়েল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষনা করে। এই যুদ্ধে পিএলও সার্বিকভাবে পারজিত হয়। খালিল এরপর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজাতে ফাতাহের সংগঠন তৈরি করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গোরিলা হামলার প্রস্তুতি শুরু করে। খালিলের নেতৃত্বেই ১৯৮৭ সাল থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় গাজা উপত্যকা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। ইতিহাসে এই ঘটনা প্রথম ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। আরবী শব্দ ইন্তিফাদার অর্থ উত্থান। 

১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যাপক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল যদিও শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল বিদ্রোহ থামিয়ে দিয়েছিল। প্রথম ইন্তিফাদার সময় খালিল আল ওয়াজির পিএলওতে ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ইয়াসির আরাফাতের পর পিএলওতে দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিই ছিল এই খালিল আল ওয়াজির। তবে ১৯৮৭ সাল থেকে খালিলের খারাপ সময় শুরু হয় কারন মোসাদ বুঝে যায় খালিলকে না সরালে ইসরায়েল আরও বেশী সঙ্কটে পড়বে। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে খালিল ইসরায়েলের একটি বাস হাইজ্যাক করায় যাতে এগারো জন যাত্রী ছিল। সন্ত্রাসীরা তিনজন ইসরায়েলি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইতজাক সমীর প্রতিরক্ষা দপ্তরের বৈঠক ডাকে এবং খালিল আল ওয়াজিরকে হত্যার নির্দেশ দেয়। ইসরায়েলের ক্যাবিনেটে খালিল আল ওয়াজিরকে হত্যার জন্য ভোট হয় যাতে দশটির মধ্যে ছয়টি ভোট পড়ে খালিলকে হত্যার উপরে। তবে খালিল আল ওয়াজিরকে হত্যা করা মোটেই সহজ ছিলনা কারন পিএলওর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে থাকতো খালিল। খালিলকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় মোসাদকে। প্রথম ইন্তিফাদার পর থেকেই মোসাদের নজর ছিল খালিলের উপর। খালিলকে হত্যার করার অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন ইন্ট্রোডাক্টরি ওয়েপন। মোসাদ খুঁজে পায় তিউনেসিয়াতে রয়েছে খালিল। মোসাদ খালিলের প্রত্যেকটি গতিবিধির উপর নজর রাখা শুরু করে, তার টেলিফোন পর্যন্ত ট্যাপ করে মোসাদ। এই অপারেশনের দায়িত্বে ছিল ইসরায়েল সেনাবাহিনীর প্রধান ইহুদ বারাক। ইহুদ বারাক পরবর্তীকালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন। ইহুদ বারাক ঠিক করেন তিউনেসিয়াতে অভিযানকে খালিল আল ওয়াজিরকে হত্যা করা হবে। 

ইসরায়েল নৌবাহিনীর একটি বিশেষ দল ফ্লোটিলা ১৩ এই মিশনে মোসাদকে সহায়তা করে। ১৯৮৮ সালের ১৪ এপ্রিল ইউরোপ থেকে ছয়জন মোসাদ এজেন্ট তিউনেসিয়া এসে পৌঁছায়। তিনজন এজেন্ট দুটি গাড়ি ভাড়া নেয় অভিযানের জন্য এবং বাকী তিনজন খালিলের গতিবিধির উপর নজর রাখা শুরু করে। মোসাদ খালিলের বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল তিউনেসিয়ার উপকূল থেকে ২৫ মাইল দূরে পাঁচটি মিসাইল বোটে ইসরায়েল নৌবাহিনীর ৩৩ জন কম্যান্ডো পৌঁছে যায়, ইসরায়েল বায়ুসেনার একটি বিশেষ বোয়িং ৭০৭ বিমান তিউনেসিয়ার সংযোগ ব্যবস্থার উপর নজর রাখছিলো যাতে জরুরী পরিস্থিতিতে তিউনেসিয়ার রেডার ও সংযোগ ব্যবস্থাকে জ্যাম দেওয়া যায়। ইসরায়েল বায়ুসেনার এফ ১৫ যুদ্ধবিমানও তিউনেসিয়ার উপকূল লক্ষ্য করে পেট্রোলিং শুরু করে। এর থেকেই বোঝা যায় ইসরায়েলের কাছে এই অভিযান কতটা গুরুত্বপূর্ন ছিল। ১৫ এপ্রিল মধ্যরাতে বোট থেকে সাতজন ফ্লোটিলা ১৩ কম্যান্ডো তিউনেসিয়ার উপকূলে এসে পোঁছায়। আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে উপস্থিত থাকা তিনজন মোসাদ এজেন্ট কম্যান্ডোরদের খালিলের ঘরের সামনে নিয়ে আসে যেখানে আগেই বাকী তিনজন মোসাদ এজেন্ট ছিল। খালিল তখন বাগদাদ যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছিল। ফ্লোটিলা ১৩ কম্যান্ডোরা খলিলের তিনজন দেহরক্ষীকে হত্যা করে খালিলের ঘরে প্রবেশ করে এবং গুলি করে সেখানেই হত্যা করে খালিলকে। বলা হয় খালিল আল ওয়াজিরকে তার স্ত্রী ও সন্তানের সামনেই হত্যা করা হয়। অপারেশনের পর ফ্লোটিলা ১৩ কম্যান্ডোরা গাড়ি করে উপকূলে ফিরে যায়। এই পুরো অপারেশনে সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। এভাবে ইসরায়েল আরও একবার মোসাদ ইসরায়েলের শত্রুকে অন্য দেশে গিয়ে হত্যা করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *