অফবিট

পৃথিবীর নির্দিষ্ট জায়গা পুড়িয়ে ফেলতে টেকনোলোজি তৈরি করতে চেয়েছিল জার্মান বিজ্ঞানীরা

২০০২ সালে মুক্তি পেয়েছিল বিখ্যাত জেমস বন্ড সিরিজের একটি সিনেমা ডাই এনাদার ডে। ওই সিনেমার ভিলেন একটি নতুন প্রযুক্তির কথা ঘোষনা করে যার নাম ইকারাস। এই ইকারাস একবার মহাকাশে পৌঁছে গেলে এটি তার প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে সূর্যের রশ্মিকে প্রতিফলন করাতে পারবে, যার ফলে পৃথিবীর অনেক সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এই সিনেমায় ইকারাসকে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের কথা বলা হয় যাতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গা পুড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। ইকারাস একটি সিনেমার কাল্পনিক গল্পের অংশ হলেও বাস্তবে এধরনের প্রযুক্তি তৈরি করারা চেষ্টা করেছিল জার্মান ইঞ্জিনিয়াররা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।

জার্মানির জন্য এই প্রজেক্টের শুরু করেন হার্মান ওবার্থ নামে এক পদার্থবিদ ও ইঞ্জিনিয়ার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও হার্মান ওবার্থ অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের হয়ে যুদ্ধ করেছিল এবং যুদ্ধের শেষে পদার্থবিদ হিসাবে অধ্যায়ন শুরু করেন। 

১৯২০ সালে রকেট প্রযুক্তিতে পিএইচডি করেন হার্মান। তাঁর সঙ্গিরা বলেন সেসময় হার্মান এমন এমন প্রযুক্তির কথা বলতেন যেগুলো বাস্তবে কোনওদিন সম্ভব নয়। হার্মান ওবার্থ মহাকাশে রকেট পাঠানোর চিন্তা করতেন সেসময়৷ তিনি বলতেন এমন রকেট বানানো সম্ভব যা মুক্তিবেগে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বলের প্রভাব অতিক্রম করে মহাকাশে পৌঁছাতে সক্ষম। পৃথিবীর মুক্তিবেগ ১১.২ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড অর্থাৎ কোন বস্ত ১১.২ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বল অতিক্রম করে মহাশূন্যে যেতে সক্ষম। 

১৯২৯ সালে তিনি এই বিষয়ে ওয়েস টু স্পেস ফ্লাইট নামে একটি বইও লেখেন৷ তাঁর এই বই সেসময় ইউরোপে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় বিশেষ করে জার্মানির তরুনদের কাছে তিনি নায়ক হয়ে যান। জার্মানির লোকও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মহাকাশ যাত্রার। এমনই এক ব্যাক্তি হলেন ওয়ার্নার ভন ব্রাউন যিনি নিজে হার্মান ওবার্থের একজন বড় ভক্ত ছিলেন, তিনি সরাসরি হার্মান ওবার্থের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর সহযোগী হিসাবে কাজ করা শুরু করেন। এরপর আসে ১৯৩৯ সাল যখন বিশ্বে আরও একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। 

১৯৪১ সাল আসতে আসতে জার্মানি ব্রিটেন ছাড়া প্রায় পুরো ইউরোপ দখল করে ফেলেছিল। এইসময় হার্মান ওবার্থ জার্মানির একটি অস্ত্র কারখানায় কাজ করছিলে, সেসময় তাঁর বস ছিল ওয়ার্নার ভন ব্রাউন অর্থাৎ এক সময়ের শিষ্যের অধীনেই তিনি কাজ করতেন। হার্মান ওবার্থ ও ওয়ার্নার ভন ব্রাউন দুজনে যৌথ ভাবে ভি ২ ব্যালেস্টিক মিসাইল তৈরি করে যার রেঞ্জ ছিল ৩২০ কিলোমিটার। এই ভি ২ রকেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ব্যবহার শুরু করে জার্মানি। এই রকেটের কোন জবাব ছিলনা অ্যালায়েড ফোর্সের কাছে। যার কারনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সে যখন ব্রিটিশ ও আমেরিকান সেনা আসে তখন জার্মানির ভি ২ রকেট তৈরির কেন্দ্র আগে দখল করা হয় যাতে এই রকেট অ্যালায়েড ফোর্সের উপর ব্যবহার করতে না পারে জার্মানির নাজি সেনা। হার্মান ওবার্থ ভি ২ রকেট তৈরি ছাড়াও জার্মানিতে অ্যালবে নদীর তীরে ম্যাজবার্গে আরও একটি নাজি অস্ত্র তৈরির কেন্দ্রে কাজ করেছিল। ম্যাজবার্গের নাজি অস্ত্র তৈরির কেন্দ্রটি অনেক বড় এলাকা নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, এখানে একসাথে বহু নাজি ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন অস্ত্র তৈরিতে কাজ করত। যেমন এখানে এমন একটি আর্টিলারি তৈরি করা হয়েছিল যাকে ফ্রান্স থেকে ফায়ার করা হলে ব্রিটেনে গিয়ে আঘাত হানতো। এখানেই হার্মান ওবার্থ ও বেশ কিছু বিজ্ঞানী একটি নতুন ধরনের অস্ত্র তৈরিতে কাজ করছিল। এই রিসার্চ কেন্দ্রে বাকী সমস্ত অস্ত্রের থেকে এটি ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের। জার্মান ভাষায় এর নাম ছিল সনইঙ্গেওয়েহার, ইংরেজি ভাষায় এর অর্থ দি সান গান। এই প্রযুক্তিতে এমন একটি রকেট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যা পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার উপরে যাবে এবং পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্পেশ স্টেশন ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫৫ কিলোমিটার উপরে রয়েছে কিন্তু আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বিজ্ঞানীরা ভূপৃষ্ঠের এক হাজার কিলোমিটার উপরে রকেট পাঠানোর চিন্তাভাবনা করে ফেলেছিল। এই বিশেষ ধরনের রকেটে একশো মিটার ব্যাস বিশিষ্ট একটি বিশাল আয়না রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই আয়নার সাহায্যে জার্মানরা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে সূর্যরশ্মিকে ফোকাস করতে পারত। এই প্রযুক্তির অনেক সুবিধা ছিল যেমন যদি বিশ্বের কোন প্রান্তে বন্যা হয় তাহলে এই প্রযুক্তিতে সেই এলকায় ফোকাস করলে জল বাষ্পীভূত হয়ে যাবে, আবার কোনও প্রান্তে ফসলের জন্য সূর্যের আলোর দরকার পড়লে তারও ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু নাজি জার্মানি এই প্রযুক্তিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের কথা ভাবছিল। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে জার্মানি ইচ্ছে করলে শত্রুর জল সরবরাহ ব্যাবস্থা ধ্বংস করে দিতে পারত কিংবা শত্রু দেশের গুরুত্বপূর্ন শহর পুড়িয়ে দিতে পারতো। প্রথমে এই রকেটে ব্যবহৃত আয়নার ব্যাস একশো মিটার করা হবে বলে ঠিক থাকলেও পরে জার্মান বিজ্ঞানীরা এই আয়নার ব্যাস ১.৬ কিলোমিটার করবে বলে পরিকল্পনা করে যাতে এই সান গান আরও ঘাতক হয়। তবে নাজি বিজ্ঞানীরা জানতো ভূপৃষ্ঠের এক হাজার কিলোমিটার উপরে এত বিশাল পেলোড নিয়ে রকেট পাঠানো সোজা নয় যথেষ্ট সমস্যার। এই পুরো প্রজেক্ট সম্পূর্ন হতে অন্তত একশো বছর সময় লাগতো, তবে সেসময় জার্মানদের ধারনা ছিল তারা এত শক্তিশালী যে তাদের সরকার অন্তত এক হাজার বছর থাকবে। তবে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হবার আগেই ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হয় এবং অ্যালায়েড ফোর্স এই সান গান তৈরির কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়, এখানে থাকা সমস্ত তথ্য অ্যাালয়েড ফোর্স নিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি বিজ্ঞানীরা এত আধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র তৈরি করেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা অপারেশন পেপারক্লিফের মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ন নাজি বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ারদের আমেরিকায় নিয়ে আসে। 

ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও অনেক নাজি বিজ্ঞানীদের তাদের দেশে নিয়ে যায়। হার্মান ওবার্থ আমেরিকায় চলে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় যাতে গোটা বিশ্ব দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। এইসময় হার্মান ওবার্থ বারবার আমেরিকান সরকারকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যাবহারের জন্য সান গান প্রজেক্ট শুরু করতে বলছিলো কিন্তু আমেরিকা এই প্রজেক্ট শুরু করেনি কারন এই প্রজেক্টে বিশাল খরচ হত এবং এর প্রযুক্তি পুরোপুরি সম্পন্ন ছিলনা। ১৯৫৫ সালে হার্মান ওবার্থ এবং ওয়ার্নার ভন ব্রাউন আবারও একসাথে আমেরিকার মহাকাশ প্রজেক্টে কাজ শুরু করে এবং এই দুইজনে মিলে স্যাটরান ভি রকেট তৈরি করে যাতে করে আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠায়। নাসার যে অ্যাপোলো ১১ মহাকাশযান ১৯৬৯ সালের ১৪ জুলাই চাঁদে পৌঁছেছিল তাতে এই স্যাটরান ভি রকেটই ব্যাবহার করা হয়েছিল। 

১৯৫৮ সালে হার্মান ওবার্থ তাঁর দেশ পশ্চিম জার্মানি ফিরে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় পূর্ব জার্মানি যা সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকে এবং পশ্চিম জার্মানি যা আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের অধীনে ছিল। নাজি সান গান আজ পর্যন্ত কোনওদিন তৈরি করা হয়নি তবে বলা বাহুল্ল্য বহু বছর আগে বিখ্যাত গ্রীক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস এই ধরনের অস্ত্র তৈরি করেছিলেন তাঁর দেশকে রোমান আক্রমন থেকে বাঁচাতে। তিনি অনেক আয়না তৈরি করেছিলেন যেগুলো গ্রীক সেনাদের রোমান জাহাজের দিকে ফোকাস করতে বলা হয়। যখন সূর্যের আলো আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে রোমান জাহাজে পড়ত তখন বহু রোমান জাহাজ জ্বলে গিয়েছিল, তবে এই ঘটনার সুস্পষ্ট কোনও প্রমান নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *