অফবিট

প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগ। কিভাবে দেওয়া হত মৃত্যুদণ্ড?

ছোটখাটো অপরাধ করলে অপরাধীকে শাস্তি স্বরূপ কয়েক বছর যাবত জেলে বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু শাস্তি গুরুতর হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া কোন নতুন বিষয় নয়। প্রাচীনকালে একাধিক দন্ডের মধ্যে এই মৃত্যুদণ্ড হলো বহু পুরনো একটি শাস্তি। তবে বহু পূর্বে মৃত্যুদণ্ড ছিল বিভিন্ন প্রকারের। কোন দেশে শিরচ্ছেদ করা তো কোন দেশে লোকসমক্ষে দন্ড দেওয়াই ছিল মৃত্যুদণ্ড। অথচ কালের পরিবর্তনে সমাজ যত উন্নত হয়েছে ততই পরিবর্তন ঘটেছে মৃত্যুদণ্ডের। বর্তমান যুগে মৃত্যুদণ্ড বলতে শুধুমাত্র ফাঁসি দেওয়াকে বোঝায়। মৃত্যুদণ্ডের রেওয়ার ছিল, কিন্তু এখন মাত্র ৫৮টি দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। খুব বেশি দিনের কথা নয় এই কয়েক বছর আগেই মৃত্যুদণ্ডের বেড়াজাল থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ইউরোপ। এই প্রতিবেদনে মৃত্যুদণ্ডর কিভাবে প্রচলন ঘটল এবং সেটা কালের পরিবর্তনে কিভাবে বদলালো সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রাচীন, মধ্য, বর্তমান যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে বদলেছে মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতি। তবে এই মৃত্যুদণ্ডের উৎপত্তি ঘটেছিল ১৮০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের প্রথমার্ধে ব্যবিলনের রাজা হাম্বুরাবির কোডে। সেই সময় আইনি নিয়ম অনুযায়ী অর্থাৎ হাম্বুরাবি কোড ছিল চোখের বদলে চোখ। অর্থাৎ কেউ কাউকে খুন করলে সেই অপরাধীর শাস্তি স্বরূপ তাকে খুন করা হত, সেরকমই কোন ব্যক্তি একজনের হাত ভাঙলে তার কেউ হাত ভেঙে শাস্তি দেওয়া হত। এই হাম্মুরাবি করছিল একটি লিপি। যেই লিপিতে প্রায় ২৮০ টি অপরাধের শাস্তি লেখা ছিল। এতগুলি অপরাধের মধ্যে মাত্র ২০ টি অপরাধ ছিল, যার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড। তবে এই লিপিতে শাস্তির নিবন্ধ থাকার পাশাপাশি এখানে জাতিভেদের অনেক উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে অভিজাতরা কোন অপরাধ করলে তাদের শাস্তি ছিল সিমিত এবং দাস ও দরিদ্র মানুষেরা কোন দোষ করলে তাদের কড়া শাস্তি দেওয়া হত। শুধুমাত্র হাম্বুরাবি কোড নয় তার পাশাপাশি আরও একটি কোড ছিল যার নাম হিট্টোহাইট কোড এই কোডটি মূলত চালু হয়েছিল ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে। হাম্বুরাবি আইনের থেকে হিট্টোহাইট কিছুটা হলেও নমনীয় ছিল। তবে ধর্ষণের মত ঘটনার জন্য কোন আইনই নমনীয় নয়। মনে করা হয় মৃত্যু হয় আইনের, সময়কালে প্রথম ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল এবং প্রথম মৃত্যুদণ্ডের উৎপত্তি হয়েছিল। এবার আসা যাক কোন যুগে কিরকম আইন ছিল !

প্রাচীন যুগ – মূলত সপ্তম শতাব্দী জুড়ে প্রাচীন যুগ বিস্তার ছিল। সেই সময়ে এথেন্সের ড্রাকোনিয়ান কোড অর্থাৎ আইনের প্রচলন ছিল। সবথেকে ভয়ংকর বলে মানা হত এই আইনকে। কারণ সেই সময় ছোট খাট কোন দোষ করলেই তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। ড্রাকোনিয়ান শব্দ ব্যবহার করা হত শাস্তির উদ্দেশ্যে। সেইক্ষেত্রে যথারিতি ছিল এই কোডের শাস্তি। এই কোডের শাস্তিগুলি ছিল অপরাধীকে উঁচু থেকে ফেলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা, দোষীকে একটি তক্তায় বেঁধে রেখে জলখাবার না দিয়ে অনাহারে মারা, এমনকি বিষাক্ত হেমলক গাছের বিষ পান করিয়ে অপরাধীকে নিজে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা। সেই সময় আত্মহত্যা করা বা মৃত্যু নির্ধারণ করার একটি বিশেষ পন্থা ছিল হেমলক গাছ। যুবকদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়ানো এবং দুর্নীতির অভিযোগের শাস্তি হিসেবে ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসকে হেমলক বিষ পান করতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্রাচীন রোমেও গুরুতর শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ডকে বেছে নিয়েছিল। প্রাচীন রোমে অবশ্য মৃত্যু কার্যকর করতে অন্ধকার জেল, আগুনে পুড়িয়ে, জলে ডুবিয়ে বা কারোর শিরচ্ছেদ করে এমনকি ক্রুশবিদ্ধ কর হত। ১ম শতাব্দীতে প্রাচীন রোমানরা যে ক্রুশবিদ্ধ করে যীশু খ্রীষ্টকে হত্যা করা হয়েছিল আজ সেই ক্রুশ খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেই শেষ নয় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অপরাধীদের মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ পরিবারের হাতে দেওয়া হত না। শুধুমাত্র অভিজাত ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ছিল কিছু ব্যাতিক্রম।

মধ্য যুগ –  কালের পরিবর্তনে এরপর আসে মধ্যযুগ। সমাজের যেমন পরিবর্তন হচ্ছে সেরকমই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেখা দিচ্ছে অপরাধ ও অপরাধীদের। ইউরোপীয় ছোটখাটো অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দিতে দেখা গিয়েছিল। তবে ১০ম শতাব্দীতে ল ব্রিটেনে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিষয়টা সকলের কাছে সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শুধুমাত্র ফাঁসি নয় শিরচ্ছেদ সহ অপরাধীর দেহ কয়েক টুকরো করেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। সেই সময় অর্থাৎ মধ্যযুগী ইউরোপ জুড়ে চলছিল খ্রীষ্ট ধর্মের প্রচার এবং প্রসার। সেই কারণে তখন ধর্মগুরুরাই অপরাধের বিচার করতেন। তখন অবশ্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা করার জন্য এবং ধর্ম লঙ্ঘন করার জন্য বেশি অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই যাজকেরা অধিকারে থাকার কারণে তারা এক ধরনের নিয়ম করেছিলেন, যে খ্রিস্টান ধর্মের মানুষেরা ইহুদিদের বিবাহ করলে যদি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তার শাস্তি স্বরূপ দেওয়া হবে মৃত্যুদণ্ড। এছাড়াও ১৩ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল সন্দেহজনক নারীদের ডাইনিরূপে সম্মোধন করে লোকসমক্ষে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার নীতি। এছাড়াও পরবর্তীকালে যখন ইউরোপে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল তখন খালিফারা যৌনতা এবং ব্যভিচারের অপরাধে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বেছে নিয়েছিলেন। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে অপরাধীকে পাথর মেরে আহত করা হত এবং শেষে তাকে হত্যা করা হত। 

আধুনিক যুগ – আধুনিক যুগে আমেরিকা সহ বিশ্বের বহু দেশে মৃত্যুদণ্ডের প্রবর্তন এনেছিল ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা। উপনিবেশ অনুসারে পুজির অপরাধের শাস্তি ভিন্ন ভিন্ন হতো। তবে আধুনিক যুগে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা দেখা গিয়েছিল এক বিবাহ অস্বীকার এবং ভারতীয়দের সঙ্গে ব্যবসা করার ক্ষেত্রেও। পরবর্তীকালে আনুমানিক ১৯৭২ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট কিছু বৈষম্যমূলক ব্যবধান এবং অসাংবিধানিক কারণে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করে দিয়েছিলেন। তবে একেবারেই মৃত্যুদণ্ড বন্ধ হয়ে যায়নি। ১৯৭৬ সালে এটি পুনঃস্থাপিত হলে মৃত্যুদণ্ডের তালিকাটি ছোট করে দেওয়া হয়েছিল। এরকম নিয়ম পরিবর্তনের পর বিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ কিংবা ক্ষমতাসীন দলকে চ্যালেঞ্জ করা অথবা জার্মানির নাৎসি বাহিনীতে অবাধ্যতা এবং পরিত্যাগ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। এরপর যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র যখন সচল হয়ে উঠল তখন থেকে মৃত্যুদণ্ড হিসেবে এগুলিকে ব্যবহার করা হত। হিটলার, স্ট্যালিন এবং মুসোলিনির মতো স্বৈরাচারী নেতারা, বহু সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছেন এই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই। আরো উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে জোসেফ স্তালিনের সময় শুদ্ধিকরণের কারণে প্রায় এক মিলিয়ন এবং চীনের বিপ্লব চলাকালীন মাও সেতুং-এর শাসনে প্রায় ৮ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এরকম ভাবে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণে সে সময় বহু সংস্থা এই আইনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। যাতে চিরতরে মৃত্যুদণ্ড বন্ধ হয়ে যায়।

বর্তমান যুগ -মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত হতে হতে এখন পৃথিবীতে প্রায় ১০৯ টি দেশে এই প্রথা উঠে গিয়েছে। এমনকি দশটি দেশ মৃত্যুদণ্ড তোলার পদ্ধতিতে রয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই চিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ড প্রায় বাতিল করে দিয়েছে বা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। রাশিয়াও মৃত্যুদণ্ডের পথ থেকে সরে গিয়েছে। তবে ইউরোপের অন্যতম দেশ বেলারুশে এখনো পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে। অথচ এখন হিউম্যান রাইটস কোড সহ একাধিক সংস্থার জন্য এবং জনসমর্থের অভাবে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি অনেক অংশে হ্রাস পেয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন ভারত ও বাংলার ক্ষেত্রে কোন টেররিস্ট বা যুদ্ধ অপরাধীর জন্য এই মৃত্যুদণ্ড এখনো বহাল আছে। সঠিকভাবে এখনও পর্যন্ত যে সকল দেশগুলি মৃত্যুদণ্ডের রেওয়াজ চালিয়ে যাচ্ছে সেগুলি হল ইরাক, মিশর, চীন ,সৌদি আরব এবং ইরান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *