ডিফেন্স

ইউক্রেনের পর আরও একাধিক ইউরোপীয়ান দেশ রাশিয়ান আক্রমনের আশঙ্কায়

রাজেশ রায়:– গত ফেব্রুয়ারী মাসে শুরু হয়েছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। তখন থেকেই বিশ্ব তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল রাশিয়ার পক্ষে, রাশিয়ার বিপক্ষে এবং নিরপেক্ষ। ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বের প্রায় বেশীরভাগ দেশই রাশিয়ার বিপক্ষে রয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই সামরিক বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধের সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অনেক মতই দিয়েছিলেন কিন্তু সময়ের সাথে দেখা গেছো সেসব অনুমানই ভুল। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রায় সাত মাস হতে চলল কিন্তু এখনও রাশিয়া ইউক্রেন দখল করতে পারেনি কিংবা ন্যাটো, আমেরিকা রাশিয়াকে আটকাতে পারেনি। যুদ্ধের শেষ কোথায় কেউ জানে না তবে এই যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়া পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের আভাস দিয়ে রেখেছে এবং পশ্চিমা বিশ্বকে রাশিয়া সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। এই পরিস্থিতে এরপর কোন দেশে রাশিয়া আক্রমন করতে পারে সেই নিয়ে রীতিমতো বিশ্লেষন চলছে এখন। বলা হচ্ছে ইউক্রেন হয়ে জর্জিয়া ও মলডোভার মতন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশে রাশিয়া আক্রমন করতে পারে। এছাড়াও ইউরোপের একাধিক দেশ রাশিয়ার আক্রমনের আশঙ্কায় আছে। গত কয়েকমাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ স্ট্রাটেজি দেখে অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন রাশিয়ার ইউক্রেন দখলের কোন পরিকল্পনাই নেই। রাশিয়া বিশ্বে নিজের প্রভাব বাড়াতে চায়। যেখানে আমেরিকা ও ন্যাটো পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে ভয় খাচ্ছে সেখানে এই যুদ্ধের গতি প্রকৃতি কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।

আমেরিকা ও ন্যাটো একটা সময় রাশিয়ার সীমানা পর্যন্ত নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছিল যার অনেক আপত্তি করেছিল রাশিয়া। কিন্তু বহুদিন ধরে চুপ থাকা রাশিয়াকে দুর্বল ভেবেছিল ন্যাটো যার কারনে প্রায় সাত মাস ধরে ইউরোপে বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ ২০১৪ সালেই শুরু হয়ে গিয়েছিল কারন সেবছরই ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস এলাকায় ডনেস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশে অনেক রাশিয়ার সমর্থক আছে যারা সরাসরি ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখল করতে ব্যার্থ হওয়ার পর রাশিয়া এখন পূর্ব ও দক্ষিন ইউক্রেন নিয়েই ব্যাস্ত আছে। এখানে সবচেয়ে বেশী চিন্তায় রয়েছে মলডোভা ও জর্জিয়া কারন এই অঞ্চলের সাথেই তাদের সীমানা রয়েছে। ইউক্রেনের মতই মলডোভা ও জর্জিয়া প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশ যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ১৯৯১ সালে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। গনতান্ত্রিক মলডোভার পূর্বে ট্রান্স ড্যানিয়েস্টার প্রদেশে রাশিয়ার সমর্থক প্রচুর আছে। বলা হয় এখানে রাশিয়ার ১৫০০ সেনা ছদ্মনবেশে আছে। ড্যানিস্টার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ট্রান্স ড্যানিয়েস্টারের আয়তন ৪০০০ স্কোয়ার কিলোমিটার যা ইউক্রেন সীমান্ত অবধি বিস্তৃত। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় এই অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেনা ঘাঁটি ছিল। ১৯৯১ সাল থেকেই এখানে রাশিয়ার শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন আছে। মলডোভা ইউরোপের সবচেয়ে গরীব দেশ গুলোর মধ্যে একটি। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই মলডোভা ইউক্রেনকে সমর্থন করছে। যুদ্ধের শুরুতেই ইউক্রেন শরনার্থীদের জন্য সীমান খুলে দিয়েছে মলডোভা। মলডোভা দেশটি ন্যাটোর সদস্য নয় কিন্তু অতীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। মনে করা হচ্ছে রাশিয়া দক্ষিন ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ ওডেসা বন্দর থেকে মলডোভার ট্রন্স ড্যানিয়েস্টার পর্যন্ত দখল করতে চাইছে যাতে ভবিষ্যতে মলডোভা দখল করে রোমানিয়ার সীমানা অবধি পৌঁছানো যায়। রোমানিয়া একটি ন্যাটো সদস্য দেশ। ন্যাটো যেমন ইউক্রেনের বাহানায় রাশিয়ার সীমানায় পৌঁছাতে চেয়েছিল তেমনি রাশিয়াও রোমানিয়ার মাধ্যমে ন্যাটোর দরজায় পৌঁছাতে চাইছে। 

মলডোভার মতই চিন্তায় আছে জর্জিয়া। ২০০৮ এ রাশিয়া জর্জিয়া যুদ্ধের পরই জর্জিয়ার আবখাজিয়া ও দক্ষিন ওসেটিয়া শহর দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। বারো দিনের এই যুদ্ধে প্রচুর জর্জিয়ার সেনা মারা গেছিল। তারপর থেকেই জর্জিয়ার এই দুই স্বাধীন প্রদেশে রাশিয়ান মিলিটারি রয়েছে। ২০২২ সালের মার্চে ইউক্রেনের পাশাপাশি জর্জিয়া ও মলডোভাও ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার জন্য আবেদন করেছিল। এছাড়া জর্জিয়া ও ইউক্রেনের মতো ন্যাটোর সদস্য হতে চাইছিল যারপর থেকেই জর্জিয়ায় রাশিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জর্জিয়া রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের বিরোধীতা করলেও সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলে নি, এমনকী জর্জিয়া তার নাগরিকদেরও সরাসরি ইউক্রেনে গিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যার করনে জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসিতে স্থানীয় মানুষরা ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু ২০০৮ সালের স্মৃতি জর্জিয়া এখনও ভোলেনি তাই বাধ্য হয়ে তারা রাশিয়ার বিপক্ষে যাচ্ছে না। এই একই ধরনের ভয়ে আছে পূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশ লাটাভিয়া, এস্তোনিয়া ও লিথুয়ানিয়া। এই তিনটি দেশ ২০০৪ থেকেই ন্যাটোর সদস্য। যদিও রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমনের পর এইসব দেশ গুলোতে নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিয়েছে ন্যাটো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জোসেফ স্তালিনের নেতৃত্বে রাশিয়া এই তিনটি দেশ দখল করেছিল। ন্যাটো ও আমেরিকার সাহায্য সত্বেও এই দেশগুলো রাশিয়ার আক্রমনের ভয়ে আছে। স্লোভানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনেগ্রো, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ার মতন বল্কান দেশগুলোও রাশিয়ার আক্রমনের আশঙ্কায় আছে। যদিও এইসব দেশ গুলোতে পৌঁছাতে হলে রাশিয়াকে কোনওনা কোনও ন্যাটো দেশের সাথে যুদ্ধ করতেই হবে।

ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ এ লেখা আছে যদি কোনও ন্যাটো দেশের উপর আক্রমন হয় তাহলে ন্যাটোর প্রত্যেকটি সদস্য দেশ যুদ্ধ করবে, সেক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভবনা হয়ে যাবে, তাই এর সম্ভবনা কম। কিন্তু পশ্চিম বল্কান দেশ সার্বিয়ার মাধ্যমে এসব দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে রাশিয়া। সার্বিয়া দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ দেশ। সার্বিয়াকে আধুনিক ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, এয়ারডিফেন্স সিস্টেম সহ একাধিক প্রতিরক্ষা সামগ্রী দিয়েছে রাশিয়া তাই সার্বিয়া রাশিয়ার উপর কোনও নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেয়নি। সার্বিয়ার প্রতিবেশী দেশ বসনিয়াও ন্যাটোকে অনুরোধ করেছে তাদের সাহায্য করার জন্য। বসনিয়া ন্যাটো দেশ নয় কিন্তু তারা ন্যাটো সদস্য হবার জন্য অনুরোধ করেছে যার জন্য গত বছর বসিনিয়ার রাজধানী সারজেভাতে রাশিয়ান অ্যামবাসি জানায় যদি বসিনিয়া ন্যাটোতে যোগ দেবার চেষ্টা করে তাহলে রাশিয়া ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। এছাড়া সার্বিয়ার প্রতিবেশী হওয়ার জন্য বসিনিয়াতে অনেক সার্ব লোক বাস করে যার জন্য বসিনিয়াতে রাশিয়ার প্রভাব রয়েছে ভালই। ২০০৮ সালে সার্বিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষনা করে কোসোভো নামে একটি অঞ্চল যদিও একে স্বাধীন দেশ হিসাবে মানেনা রাশিয়া ও সার্বিয়া। কোসোভো আমেরিকাকে অনুরোধ করেছে তাদের মিলিটারি বেস সেখানে স্থাপন করতে এবং ন্যাটোতে সদস্য হবারও অনুরোধ করেছে যার সরাসরি বিরোধীতা করেছে রাশিয়া ও সার্বিয়া। মন্টেনাগ্রো দেশটি রাশিয়ার সমর্থক, সার্বিয়ার সমর্থক ও পশ্চিমা সমর্থকে বিভক্ত। দেশটিতে পশ্চিমা ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি মিলা দুকানোভিচের সরকার পরিবর্তনের জন্যে রাশিয়া কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

৯ মে, ২০২২ মস্কোর রেড স্কোয়ারে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বার্ষিক বিজয় দিবস প্যারেডে রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়েছিলেন ইউক্রেনে রাশিয়ার অপারেশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি বাহিনীর বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের মতন। তার বক্তব্য রাশিয়া ইউক্রেনে তিনি নাজি সরকার পরিবর্তন করতে চায়। তবে সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে ভ্লাদিমির পুতিন কৌশলে আসল কথা এড়িয়ে গেছে। ভ্লাদিমির পুতিনের আসল লক্ষ ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি কর এবং পুনরায় সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করা, যার জন্য প্রাক্তন সোভিয়েত দেশ গুলোর সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে সেখানকার মানুষের মনে সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরব গাঁথা প্রচার করার চেষ্টা করছে রাশিয়া। রাশিয়ার সরকার, মিডিয়া নাশে দেলো প্রাভো নামক বানী প্রচার করছে। ১৯৪১ সালে হিটলারের নাজি বাহিনী যখন রাশিয়া আক্রমন করেছিল তখন রাশিয়ান প্রসিডেন্ট জোসেফ স্তালিন এই স্লোগানই প্রচার করছিল যার অর্থ নাজি বাহিনীকে প্রতিরোধ করাই আমাদের লক্ষ্য। আসলে ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়াকে কখনও মেনে নিতে পারেনি। তার একটাই স্বপ্ন পুনরায় সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন। এরজন্য ১৯৪৫ -৫০ অবধি জোসেফ স্তালিন জার্মানির ডিনাজিফিকেশনের জন্য যা যা করেছিল পুতিনও এখন তাই করছে্ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি। পূর্ব জার্মানি আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে এবং পশ্চিম জার্মানি আসে আমেরিকার অধীনে। পূর্ব জার্মানি সহ পূর্ব ইউরোপে জোসেফ স্তালিন তখন নাজি বিরোধী শিক্ষা দিতে শুরু করে, ঠিক সেটাই করছে এখন পুতিন। কারন পুতিন মনে করে ইউক্রেন পশ্চিমাদের হাতের পুতুল, সেজন্য তাদের সঠিক শিক্ষা দরকার। এখন দেখার এটাই যে ভ্লাদিমির পুতিন কী সত্যিই কখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবেন নাকী যুদ্ধের কারনে অর্থনৈতিক সংকটে চলা রাশিয়ার অবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানির মতন হবে। ভবিষ্যতের গর্ভে কী লুকিয়ে আছে তা সময়ই বলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *