দক্ষিন এশিয়ায় হাইড্রোপলিটিক্সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। আন্তর্জাতিক জল সংকট মেটাতে ভারতবর্ষের ভূমিকা
রাজেশ রায়:— আপনারা কী জানেন জল কে পরবর্তী তেল বলা হয়!! বিংশ শতকে যেখানে তেলই হচ্ছে এনার্জির প্রধান উৎস এবং এই তেল কে কেন্দ্র করে জিও পলিটিক্স আবর্তিত হচ্ছে কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে জলের গুরুত্ব যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। বিশ্বের জনসংখ্যা ও অর্থনীতি ক্রমশ বাড়ছে কিন্তু বিশুদ্ধ জলের পরিমান একই আছে বরং কমছে। জল শুধু বেঁচে থাকার জন্যই নয় বরং বানিজ্য, অর্থনীতি এমনকী অনেক দেশের সীমান্ত নির্ধারিত করতেও জরুরি। প্রাচীন মিশরের নীল নদ থেকে শুরু করে ব্রাজিলের রেন ফরেস্ট হয়ে যাওয়া অ্যামাজন নদী, এমন বহু দেশের মধ্যে একই নদী বা লেক রয়েছে ফলে সেই সব নদীর নিয়ন্ত্রন নিয়ে অনেক সময় দেশ গুলোর মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়। একেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হাইড্রো পলিটিক্স বলে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা আগামী দশকে জল সরবরাহকে কেন্দ্র করে জিও পলিটিক্স, কুটনীতি ও সংঘর্ষ হতে পারে। প্রাকৃতিক ভাবে ভারতকে জলের ভান্ডার বলা হয়। ভারতে প্রচুর নদী রয়েছে যার কারনে হাইড্রো পলিটিক্স ভারতের বিদেশ নীতির অন্যতম প্রধান ভাগ। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য ও শক্তিশালী দেশ হিসাবে দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী দেশ হচ্ছে ভারত। কিন্তু সীমান্ত নিয়ে চীন ও পাকিস্তানের সাথে বিরোধীতার জন্য প্রায়ই এলাকায় অস্থিরতা তৈরি হয়। ভারতকী হাইড্রো পলিটিক্সকে ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠতে পারবে?
একটি নদী কোনও উঁচু পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে যার জন্য জিও পলিটিক্যাল প্রভাব নদীর উপর পড়ে। যেমন ব্রহ্মপুত্র নদীর কথাই ধরা যাক। তিব্বতের আংশি গ্লেসিয়ার থেকে এই উৎপন্ন এই নদী অরনাচল প্রদেশ, আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্রের জলের উপর চীন, ভারত ও বাংলাদেশের অধিকার রয়েছে। এই সব নদী গুলো বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি, কৃষিকাজ, বিদ্যুত তৈরি, পানীয় জল সরবরাহ, মাছ চাষের ক্ষেত্রে যেমন প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জলের বন্টন নিয়ে দেশ গুলির মধ্যে বিতর্কও তৈরি হয়, দক্ষিন এশিয়ায় এই সংকট বেশী দেখা যায়। এশিয়াতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শহর অঞ্চলের বিস্তারের সাথে সাথে বিশুদ্ধ জলের ভান্ডার দ্রুত কমছে। একজন বিজ্ঞানী বলেছেন ভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে জলের জন্য। ভারতীয় উপমহাদেশ মানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানে জনসংখ্যার তুলনায় বিশুদ্ধ জলের অনুপাত ০.৩৮ শতাংশ। এটা হওয়া দরকার ছিল ১.১৬ শতাংশ। মানে বুঝতেই পারছেন কতটা কম! এই মান আরও কমছে। ভারতের বেশীরভাগ নদীই আন্তর্জাতিক সীমানায় যায় যার জন্য ভারতের জন্য হাইড্রো পলিটিক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিন এশিয়ায় অর্থনীতি কিংবা মিলিটারি দিক থেকে ভারত শক্তিশালী দেশ সেজন্য ভারত তার জলের নিয়ন্ত্রন রাখতে অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন হাইড্রো পাওয়ারের জন্য ড্যাম তৈরি। কিন্তু উত্তর পূর্ব ভারতের বেশীরভাগ নদীই ভারত হয়ে অন্যান্য দেশে গেছে। সুতরাং এসব নদীর জল নিয়ন্ত্রনে অনেক সময় চুক্তি করতে হয়। যদি ভারত ও চীনের কথা বলা হয় তাহলে এই দুই দেশেই জল সংকট বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়। অতিরিক্ত কৃষিকাজ বা বিশেষ কীছু এলাকায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এই দুই দেশেই বিশেষ কিছু এলাকায় জল সংকট দেখা যায়। এশিয়ান টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী চীন ইয়ারলাং জাংবো নদীর উপর একটি বিশাল ড্যাম তৈরি করছে। ব্রহ্মপুত্র নদীকেই চীনে ইয়ারলাং জাংবো বলে। চীনের দাবি এই ড্যাম থেকে ৬০ গিগাওয়াট ইলেকট্রিসিটি তৈরি হবে যা ২০৬০ এর মধ্যে চীনকে কার্বন ফ্রি দেশে পরিনত করতে সাহায্য করবে। কিন্তু নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসাবে এই ড্যাম ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই চিন্তার কারন। চীন ও ভারতের মধ্যে প্রায়ই সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা হয়। এক্ষেত্রে চীন এই ড্যামের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদীর জল নিয়ন্ত্রন করলে তা ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের জন্য চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা এই ড্যামের মাধ্যমে চীন জলকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। চীনের বহুদিন ধরেই লক্ষ অরুনাচল প্রদেশ যার জন্য অরুনাচল প্রদেশ সীমান্তের কাছে রেললাইন তৈরি করছে চীন। তবে চীনের এই ড্যামের কাউন্টারে ভারত অরুনাচল প্রদেশে ১০,০০০ মেগওয়াটের একটি রিজার্ভার তৈরি করছে। চীনের বেশীরভাগ নদীর উৎস তিব্বত যা ১৯৫০ সালে অবৈধ ভাবে চীন দখল করে নিয়েছিল। তিব্বত থেকে উৎপন্ন ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রবাহ এমনই যে চীন চাইলেও খুব বেশী জল নিয়ন্ত্রন করতে পারবে না৷ তবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে ভারত চাইলে পুরো উত্তর পূর্ব ভারতে অপ্রচলিত শক্তি উৎসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে, যার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হাইড্রোপাওয়ার। নর্থ ইস্ট ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশানের বক্তব্য অনুযায়ী পুরো উত্তর পূর্ব ভারতের ৫৮,৯৭১ মেগাওয়াট জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা আছে কিন্তু বর্তমানে উৎপন্ন হয় ১৭২৭ মেগাওয়াট যা মোট ক্ষমতার মাত্র ২.৯২ শতাংশ। ভারত ভুটান ও বাংলাদেশ কে নিয়ে একটি জোট গঠন করে ব্রহ্মপুত্র নদীর জল ব্যবহার করতে পারে যা চীনের এই ড্যামকে কাউন্টার করবে।
এবার আসা যাক ভারতের অন্যতম প্রধান শত্রু ও চীনের বন্ধু পাকিস্তানের কথায়। ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মত দুই শত্রু দেশের মধ্যে হওয়া সিন্ধু জল চুক্তিকে বিশ্বের সবচেয়ে ভাল জল চুুক্তি বলা হয়। আজ ৬২ বছর ধরে ভারত পাকিস্তানের এত যুদ্ধের পরও এই চুক্তি বজায় আছে। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত পূর্ব দিকের তিনটি নদী রবি, বায়াস ও সুতলজ নদীর জল ব্যবহার করতে পারে এবং পাকিস্তানকে পশ্চিম দিকের তিনটি নদী চেনাব, ঝিলাম ও সিন্ধু নদীর জল ব্যবহার করতে পারে। তবে প্রথম দিকে পাকিস্তান পূর্ব দিকের নদী গুলোই চাইছিল তবে চাপে পড়ে তাদের পশ্চিম দিকের নদীই নিতে হয়। ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল ভারত পাকিস্তানে জল সাপ্লাই বন্ধ করে দেয় যার জন্য রাতারাতি পাকিস্তান বাধ্য হয় ভারতের সাথে জল চুক্তি করতে রাজি হতে কারন না হলে পাকিস্তানে জল সংকট দেখা যেত। ২০১৬ সালে উরিতে আক্রমনের পর ভারত এটা বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানে জল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। বেশ কিছু হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট শুরু করলে এমনিতেই পাকিস্তানে জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। ২০১৮ সালে ভারত কিষান গঙ্গা পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করে যার ফলে বিশ্ব ব্যাঙ্কে তাদের প্রতিনিধি পাঠায় ভারতের বিরুদ্ধে কিন্তু সেখান থেকেও তাদের খালি হাতে ফিরতে হয়। ২০১৯ সালে ভারত পাকিস্তানকে সরাসরি জানায় তারা জল সরবরাহ বন্ধ করে দেবে কারন পাকিস্তানের মদতে জঙ্গিরা কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি বাসে বিস্ফোরন ঘটায় যাতে ৪০ জন সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয়। ভারত কাশ্মীরে ৫৮৪২ কোটি টাকার বিনিময়ে ৮৫০ মেগাওয়াটের একটি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট শুরু করছে। ন্যাশনাল হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশান বা এনএইচপিসি জম্মু কাশ্মীরে ২৩০০ কোটি টাকার বিনিময়ে একটি ৩৮০০ মেগাওয়াটের হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট শুরু করার লক্ষ নিয়েছে। গোটা বিশ্বের সামনে ভারত প্রমান করে দিয়েছে ভারত চাইলে তার হাইড্রো পলিটিক্সের মাধ্যমে পাকিস্তানের বড় ক্ষতি করতে পারে।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের কথায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি হবার পর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জল বন্টন নিয়ে কথা হয়ে আসছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এমন অন্তত ৫৪ টি নদী আছে যা দুই দেশেই রয়েছে। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নীচের ভূমি হওয়ার কারনে এই নদীর উপর ভারতের যে কোনও নির্মান কাজ বাংলাদেশে জল সরবরাহে সমস্যা করবে। ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা জল চুক্তি হয়। চীনের থেকে অর্থনৈতিল সাপোর্ট পাওয়ার পরও জলের জন্য ভারতের সহযোগিতা দরকারই বাংলাদেশের। ২০১৯ সালে এক চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক জল ব্যবহার করতে পারবে। এই জল ত্রিপুরার সাবরুম নামে এক ছোট জায়গায় পানীয় জল হিসাবে ব্যবহৃত হবে। এর বদলে ভারত এই নদীর উপর সম্পূর্ণ নিজের খরচে মৈত্রী সেতু তৈরি করে যা দুই দেশের সম্পর্ককে মজবুত করে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র ন্যাশানাল ওয়াটার ওয়ে ২ এর মত প্রজেক্টে ভারত বিনিয়োগ করে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দর থেকে বাংলাদেশের চিটাগং বন্দর অবধি একটি সরাসরি অর্থনৈতিক জোব তৈরি করা যেতে পারে যাতে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশ গুলোর সাথেও সম্পর্ক মজবুত হয় এই পথেই। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী ভারতের উচিৎ বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সাথে একটি গভীর কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির জন্য বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতন আরও একটি দেশ নেপাল ভারতের হাইড্রোপলিটিক্সের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯২০ সাল থেকেই ভারত ও নেপাল জল বন্টনে একসাথে কাজ করে আসছে। ভারতের সাহায্যে তৈরি বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য নেপালের ৩ লাখ হেক্টর জমি কৃষি উপযুক্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে নেপালে নদীর যেন ভান্ডার আছে। নেপালে প্রায় ৬০০০ নদী আছে যা ৮৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম। ভারতে বিদ্যুৎ এর অভাব মেটাতে নেপালের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি নেপালের একটি বড় হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট ভারত তৈরি করতে চলেছে। পশ্চিম সেতী এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রথমে চীন কাজ করছিল। ২০১৮ সালে চীন এই প্রজেক্ট থেকে বেরিয়ে যাবার পর এতে ভারত যুক্ত হয়। এসব দেখে একটা কথা স্পষ্ট যে হাইড্রো পলিটিক্সের ক্ষেত্রে ভারত দক্ষিন এশিয়ায় সত্যি একটি প্রভাবশালী দেশ।