ডিফেন্স

কোনওদিন ভাগ না হলে অখণ্ড ভারতবর্ষ কতোটা শক্তিশালী দেশ হত?

রাজেশ রায়:—ভারত পাকিস্তান এই দুই দেশের নাম শুনলে মাথায় কী আসে! ২০০৩ এর ক্রিকেট বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকারের পয়েন্টের ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে মারা ছয় নাকী আটারি সীমান্তে দুই দেশের পতাকা প্রদর্শন যাতে ভারতবাসীর গর্বে বুক ফুলে ওঠে! তবে সত্যি কথা বলতে কী ভারত পাকিস্তান শুনলে আমাদের প্রথমেই মাথায় আসে যুদ্ধের কালো স্মৃতি যেখানে ভারত মায়ের বীর সন্তানরা তাদের প্রানের বলিদান দিয়েও অসাধারন বীরত্বে দেখিয়েছিল। তাছাড়া এখনও পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই লড়াই করতে হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। ইতিহাসে ১৯৪৭ সালটা সেই সময় যখন দক্ষিন এশিয়ার ভবিষ্যত পুরো পাল্টে যায়, এই বছর দুটো এমন দেশে স্বাধীনতা লাভ করে যারা অতীতে একই দেশ ভারতবর্ষ হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৯৪৭ সালের আগে কিছু বছর এমন কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে যাতে বাধ্য হয়ে ভারত পাকিস্তান দুই দেশ তৈরি হয়। যে দেশ দুটির এক থাকার কথা ছিল তারা আজ ৩৩২৩ কিলোমিটারের লম্বা সীমান্ত দ্বারা বিভক্ত। কিন্তু কখনও কী ভেবে দেখেছেন যদি ভারতবর্ষ কোনওদিন ভাগই না হত তাহলে কী হত?? এবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

ধরুন আপনার কাছে এক বিঘা জমি আছে। এবার কোন কারনে জমির মাঝ বরাবর আল দিয়ে জমিটাকে দুভাগে ভাগ করে দেওয়া হল। তাহলে কী জমির চরিত্র বদলে যাবে? নাকী মাটি বদলে যাবে? ভারত পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবার আগে নিজেদের স্বার্থে এবং ধর্মকে কাজে লাগিয়ে ভারতবর্ষকে ভাগ করে দিয়ে যায়। যার জন্য আজ ৭৫ বছর ধরে দক্ষিন এশিয়াতে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু আজও দুই দেশের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে, কারন ৭৫ বছর আগে দেশ ভাগ হলেও তারও পূর্বে হাজার বছর ধরে দুই দেশ একই দেশ অখন্ড ভারত হিসাবে ছিল। যেখানে সংস্কৃতি, সভ্যতা একই ছিল। প্রথমে দুই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে একটু বলা যাক। হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার কথা সবাই জানেন। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা গুলোর মধ্যে একটি এটি। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা এটিই। আজ হরপ্পা সভ্যতার বেশীরভাগ অংশ পাকিস্তানের পাঞ্জাবে রয়েছে। এই পাঞ্জাবেরই পূর্ব দিকের বেশীরভাগ অংশ ভারতীয় পাঞ্জাব হিসাবে রয়েছে। এই সিন্ধু সভ্যতার কিছু অংশ ভারতে এবং কিছু অংশ পাকিস্তানে রয়েছে। যা প্রমান করে প্রায় ৪০০০ বছর ধরে এই দুই দেশেই একই সভ্যতা ছিল। তাছাড়া আর্যরা বৈদিক সভ্যতা প্রথম উত্তর পশ্চিম ভারতের এই ভারত পাকিস্তান সীমান্তেই শুরু করেছিল। এরপর মৌর্য সাম্রাজ্য, কুষান সাম্রাজ্য, গুপ্তা সাম্রাজ্যের সময় পর্যন্ত ভারতের অখন্ডতা বজায় ছিল। কিন্ত পরে এগারো শতকের দিকে আরব ও আফগান ও মুঘলদের একের পর এক ভারত  আক্রমনে এলাকা ও উত্তর পশ্চিম ভারতে ধর্মীয় সংস্কৃতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। তবুও রাজপুত, শিখরা ভারতীয় অখন্ডতা বজায় রেখেছিল। 

কিন্তু বিংশ শতকের প্রথম থেকেই ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ তৈরির মতো চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এর জন্য প্রধান দায়ী। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করা অনেক ভারতীয় সেনা, অনেক ভারতীয় আঞ্চলিক নেতা, ভারতীয় মানুষ যাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দু ছিলেন, শেষ মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল যা মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। তখনই ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে ভারতবর্ষে ক্ষমতা টিকে থাকতে গেলে হিন্দু মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরাতে হবে। এর জন্য ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম জাতির শিক্ষার প্রসারের জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের আলিগড় আন্দোলনকে সমর্থন করে। ব্রিটিশ সরকার একটি মহা পরিকল্পনা তৈরি করে। আলিগড় আন্দোলন হচ্ছিল ব্রিটিশ সরকারের সময়ে কারন মুসলিমদের শিক্ষার মান উন্নতি হচ্ছে না দাবি ছিল সৈয়দ আহমেদ খানের। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বোঝায় ব্রিটিশ সরকার নয় বরং হিন্দুরাই দায়ী মুসলিমদের পিছিয়ে পড়ার জন্য, সেজন্য মুসলিমদের হিন্দুদের থেকে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া দরকার। এভাবে ভারতে ভবিষ্যতে হিন্দু মুসলিম ফাটলের বীজ বপন করে ব্রিটিশ সরকার। ঠিক এই কারনে ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম লীগ গঠন করে। 

১৯০৯ সালে মোরলে মিন্টো রিফর্ম এর মাধ্যমে ব্রিটেন মুসলিমদের জন্য আলাদা ভোটাধিকার শুরু করে যাতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যে আরও বড় ফাটল ধরে। এভাবে ব্রিটিশ সরকার দুটো উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে প্রথমত ভারতের প্রধান শক্তি হিন্দু মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরায় দ্বিতীয়ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বিক্ষ রপন করে যা ভবিষ্যতে ভয়ানক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জন্ম দেয় এবং এখনও এর ফল দুই দেশ ভোগ করছে। ১৯৪৭ সালে এই কারনেরই ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হয়। ১৯৩৩ সালে চৌধুরী রেহমত আলি নামে এক রাজনীতিবিদ পাকিস্তান নাম ঠিক করে যা মুসলিমদের একটি আলাদা দেশ হবে, এর আগে পাকিস্তান নামের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তানের জন্মই হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে যেখানে ইসলাম ধর্মালম্বীদের প্রধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু সেসময়ও কীছু মানুষ ছিল যাদের বক্তব্য ছিল ধর্মের ভিত্তিতে কারও দেশ নির্বাচন অনুচিত। যে যেখানে জন্ম নিয়েছে সেটাই তার মা। এজন্য তখন বিশাল সংখ্যায় মুসলিম জনসংখ্যা ভারতকে নিজের দেশ মনে করে এখানে থেকে যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া, দ্বিতীয় স্থানে আছে পাকিস্তান এবং তৃতীয় স্থানেই আছে ভারত। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ভারত দ্বিতীয় স্থানেই ছিল।

আচ্ছা যদি ভারত পাকিস্তান কোনওদিন বিভক্ত না হত তাহলে কী হত??? আজ যদি দুই দেশ এক থাকত তাহলে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হবার সময় কোটি কোটি মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হত না, এত মানুষের মৃত্যু হত না কীংবা অনেক লোককে তার পরিবার থেকে আলাদা হতে হত না। যদি পাঞ্জাবের মানুষদের সাথে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেদের তুলনা করি তাহল তাদের তুুলনায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মানুষদের সাথে বেশী মিল পাওয়া যাবে। কারন ধর্ম গত ভাবে আলাদা হলেও সভ্যাতা ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে এই দুই প্রদেশের মানুষ একই। ঠিক তেমনি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ও মুসলিমদের গুজরাটের হিন্দু মুসলিমদের তুলনায় বাংলাদেশের হিন্দু মুসলিমদের সাথে বেশী মিল পাওয়া যাবে। কারন দেশ আলাদা হলেও ভাষা, সংস্কৃতি কয়েকশো বছরের পুরোনো। ক্রিকেটের দিক দিয়ে দেখতে গেলে শচীন টেন্ডুলকর ও ওয়াসিম আক্রম একই দলে খেলত। পাকিস্তানের উস্তাদ ফাতে আলি খান, নুরজাহান এবং ভারতের কিশোর কুমার একই দেশের হত। দিল্লি, লখনৌ, ভোপাল, হায়দ্রাবাদের মুঘলাই ক্রুসিন ও লাহোর, করাচির খাবার একসাথে মিশে যেত। দুই দিকে আলাদা হয়ে পড়া মানুষদের পরিবারের সাথে দেখা করবার জন্য আলাদা ভিসা করতে হত না। সবচেয়ে বড় কথা কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে ৭৫ বছর ধরে রক্তাক্ষয়ী সংঘর্ষ হত না যাতে ভূস্বর্গ কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছে। 

আজ অখন্ড ভারত থাকলে ভারতকে প্রতিরক্ষা খাতে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচা করতে হত না। এই টাকায় ভারতের অর্থনৈতিক আরও উন্নতি ঘটত। এসব কথা ভাবলে হয়ত মনে খুশি জাগে কিন্তু এর বিপরীত দিকটাও দেখা দরকার। আজ ভারত কোন জায়গায়, পাকিস্তান কোন জায়গায়। আগেই বলেছি একটি জমিকে যদি আল দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হয় তাহলে হয়ত তার মাটির চরিত্র পরিবর্তন হয় না কিন্তু যদি জমির একদিকে ফসল চাষ করা হয় এবং অন্যদিকে জংলি ঘাস বসানো হয় তাহলে সেই ঘাস থেকে শস্য পাওয়া যাবে না। পাকিস্তানের অবস্তা আজ ঠিক তাই হয়েছে। যেখানে ভারত প্রতিদিন কোনও না কোনও রেকর্ড তৈরি করছে সেখানে পাকিস্তান ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে তার সন্ত্রাসবাদের জন্য। ভারত আজ বিশ্বের ষষ্ঠ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ, ২০২০ সালে ভারতের পার ক্যাপিটা জিডিপি ছিল ১৯০০ ডলার, সেখানে পাকিস্তান অর্থনৈতিক ভাবে দেওলিয়া হয়ে গেছে। যেখানে ভারত শিক্ষা, টেকনোলজি, মেডিক্যাল, ইনফ্রাস্ট্রাকচার সমস্ত সেক্টরে অভূতপূর্ব উন্নতি করছে সেখানে দুর্নীতির কারনে আর্থিকভাবে লোনের বোঝায় জর্জরিত পাকিস্তান। যেখানে জাতিসংঘের নিরপত্তা সংস্থায় ভারতের অন্তর্ভুক্তির কথা হচ্ছে এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় ভারতের প্রভাব যথেষ্ট সেখানে বিশ্বে পাকিস্তানের পরিচয় সন্ত্রাসের জনক হিসাবে। 

পাকিস্তানের মহাকাশ সংস্থা সুপারকো তৈরি হয়েছে ইসরোর আগে কিন্তু আজ ইসরো কোথায় আর সুপারকো কোথায়! ভারতের প্রভাব এতটাই যে বিশ্বে যে ভারত আমেরিকা ও রাশিয়ার মত সুপার পাওয়ার দুজনের সাথেই সমান ভাব রেখে ব্যাবসা করছে। সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকার অনুরোধ সত্বেও ভারত রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি বরং রাশিয়ার থেকে তেল কিনছে ভারত। অন্যদিকে আমেরিকার থেকেও প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনে ভারত। আমেরিকার ফেসবুক, গুগল সহ একাধিক বড় বড় কোম্পানির বড় পজিসনে আজ ভারতীয়রা রয়েছে কিন্তু আজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশের কাছে হাত পাতছে লোনের জন্য। পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামো এতটাই ব্যার্থ যে আজ পর্যন্ত কোনও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদকাল সম্পূর্ণ করতে পারে নি। আজ ভারতীয় গনতন্ত্র এতটাই শক্তিশালী যে ভারতে কোনওদিন সেনা অভ্যুত্থান হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানে তিনবার সামরিক শাসন এসেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রন করে। পাকিস্তান আজ চীনের হাতের পুতুলে পরিনত হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, চীন এবং উগ্রবাদীদের মাঝে পড়ে সাধারন পাকিস্তানি জনগনের জীবন ওষ্ঠাগত আজ। এমন অবস্থায় যদি ভারত পাকিস্তান এক দেশ হবার কল্পনা মাত্র অত্মরাত্মা কেঁপে ওঠে। পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদ তাহলে গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ত। দেখুন আমরা আমাদের ইতিহাস পাল্টাতে পারি না। অতীতে যা হয়ে গেছে তা বদলানো সম্ভব নয়। কিন্তু ভবিষ্যতে কী হতে পারে সেটা ভাবা দরকার। অটল বিহারী বাজপেয়ীজি একবার বলেছিলেন কেউ তার বন্ধু বদলাতে পারো কিন্তু প্রতিবেশী নয়। সেজন্য পাকিস্তানের মত পরমানু ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে ভারত তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা যথেষ্ট মজবুত করেছে। বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ ভারত। আজ পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়েছে সব কটিতেই চূড়ান্ত ভাবে পরাজিত হয়েছে পাকিস্তান। ভবিষ্যতেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত নিজেকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *