পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নতুন প্রধানমন্ত্রীর সময়ে ভারত পাকিস্তানের সম্পর্ক কেমন হতে পারে?
রাজেশ রায় :— পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন ঘটেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনাস্থা ভোটে হেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইমরান খান প্রথম কোন প্রধানমন্ত্রী যাকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা ছাড়তে হল। কোন সরকারের যখন সংখ্যা গরিষ্ঠতা চলে যায় তখন অনাস্থা ভোট আনা হয়। শনিবার গভীর রাতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে হওয়া ভোটের ফলে ক্ষমতা ছাড়তে হয় ইমরান খান কে। তবে এটা কিন্তু এত সহজে হয়নি। ইমরান খান সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি। ইমরান খান পাকিস্তানের সংবিধান ও সুপ্রিমকোর্টের অনেক নিয়মের বিরোধীতা করেও ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছিল।
গত কয়েকমাস ধরেই ইমরান খানকে হটানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। আপনারা সবাই জানেন নামে গনতন্ত্র হলেও আসলে পাকিস্তানের সরকার নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেই সেনার সাথেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল ইমরান খান তাই তার ক্ষমতা যাওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। গত ২৮ মার্চ ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব রাখা হয়। গত ৩ এপ্রিল এই নিয়ে ভোট হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানের ন্যাশানাল অ্যাসেম্বলিতে। পাকিস্তানের পার্লামেন্টেও ভারতের মত দুটো কক্ষ আছে। আমাদের রাজ্যসভা ও লোকসভার মত ওখানে রয়েছে সেনেট ও ন্যাশানাল অ্যাসেম্বলি। ২০১৮ সালে যখন ইমরান খানের দল পিটিআই ক্ষমতায় আসে তখন পিটিআই ১৫৬ আসন পেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানে সরকার গঠনের জন্য ১৭২ আসন দরকার কারন পাকিস্তানে মোট আসন ৩৪২। সেজন্য ইমরান খান অন্যকীছু রাজনৈতিক দলের সাথে যৌথভাবে সরকার গঠন করেছিল।
পিটিআই এর সবচেয়ে বড় সমর্থনকারী দল এমকিউএম, যাদের কাছে সাতটি আসন ছিল, পিটিআই এর সাথে জোট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে বিরোধী পক্ষে যোগ দেয় ফলে বিরোধীরা সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে যায়। পাকিস্তানের সেনেটেও ১০০ আসনের মধ্যে পিটিআই জোট পেয়েছে ৪৮ টি আসন, এখানেও বিরোধীরা দলে ভারী, তাদের ৫২ টি আসন রয়েছে। তাই ২৮ মার্চ ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আনা হয়। মাত্র ১ আসনের জন্য সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চুপচাপ নিজের পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে আসেন তিনি। গত ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের ন্যাশানাল এসেম্বলিতে ভোট হওয়ার কথা ছিল, সবাই ভেবেছিল ইমরান খান হয়ত ইস্তফা দিয়ে বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু ন্যাশনাল এসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার ভোট সাসপেন্ড করে দেয় অর্থাৎ ভোটই বন্ধ! আর্টিকেল ৫ এর কারনে ভোটই বন্ধ করে দেওয়া হয়, বলা হয় এটা বিদেশি ষড়যন্ত্র। এরপর ইমরান খান ন্যাশনাল এসেম্বলি ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জানায় আাগামী ৯০ দিনের মধ্যে নতুন ভাবে অ্যাসেম্বলি তৈরি হবে। এবার বিরোধী দল গুলো বাধ্য হয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনকে ডেকে পাঠায়। নির্বাচন কমিশন জানায় ৯০ দিনের মধ্যে ভোট করা সম্ভব নয়, এর জন্য অন্তত ৬-৭ মাস লাগবে। সুপ্রিম কোর্ট এরপর ডেপুটি স্পিকারের অনাস্থা ভোট না করার সিদ্ধান্ত কে পুরোপুরি অসাংবিধানিক বলে জানায়, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি পুনরায় তৈরি করা হয়। অর্থাৎ ইমরান খানের নেওয়া সমস্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দেয় গত শনিবার অনাস্থা ভোট করাতেই হবে। কিন্তু গোটা শনিবার ধরে পাকিস্তানে ব্যাপক নাটক চলে। ইসলামাবাদে অবস্থিত পাকিস্তানের ন্যাশানাল এসেম্বলিতে সকাল থেকেই ভোটের জন্য সরব হয় বিরোধীরা কিন্ত ডেপুটি স্পিকার বারবার ভোট পিছিয়ে দিতে থাকে, ইমরান খান সরকারের চাপে। রাত ৯ টায় ইমরান খান ক্যাবিনেট মিটিং ডাকে। অর্থাৎ সকালে শুরু হওয়া অ্যাসেম্বলিতে রাত ৯ টা পর্যন্ত ভোট করা সম্ভব হয় নি। গোটা পাকিস্তান জুড়ে তীব্র সংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয়, সবাই আশঙ্কা করছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী বোধ হয় ক্ষমতা দখল করে নেবে। রাত ৯ টার সময় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট স্থানীয় পুলিশকে আদেশ দেয় ভোট না হলে ডেপুটি স্পিকার কে গ্রেফতার করার, কারন এটা সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করা। পাকিস্তানের সমস্ত বিমানবন্দরে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয় যাতে কোন সরকারী ব্যাক্তি দেশ ছেড়ে চলে যেতে না পারে। রাত ১২ টা পর্যন্ত সময় ছিল ভোটিং করানোর না হলে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারকে গ্রেফতার করা হত। কিন্তু নাটক এখানেই শেষ নয়। রাত ১২ টা বাজার ২০ মিনিট আগেই ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার ইস্তফা দিয়ে দেয়। ভারতের লোকসভাতে ও এরকম নিয়ম আছে যদি স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার ইস্তফা দিয়ে দেয় তাহলে একটি আলাদা প্যানেল আছে সেখান থেকে কেউ লোকসভা চালাবে। একই ব্যাপার পাকিস্তানেও আছে তাই শেষ পর্যন্ত প্যানেল থেকে একজন কে ন্যাশেনাল অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত করে ভোট শুরু করা হয়। ভোটিং ১৭৪ ভোট পায় বিরোধী দল। সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ১৭২ ভোট সুতরাং বিরোধীরা জিতল। তবে অ্যাসেম্বলিতে উপস্থিতই ছিলনা ইমরান খানের দল পিটিআই বা তেহেরক ই ইনসাফ। ইমরান খান ভোটিং এর আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন খালি করে দেয় অর্থাৎ রেজাল্ট কি হবে তা সে আগেই জানত। নতুন অধিবেশনে শাহবাজ শরীফকে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষনা করা হয়। এই শাহবাজ শরীফ আবার পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ভাই, যে এখন প্রচুর দুর্নীতি করে লন্ডনে রয়েছে।
পাকিস্তানের এত বছরের রাজনীতিতে কোন প্রধানমন্ত্রীই পূর্ন মেয়াদকাল শেষ করতে পারেনি, ইমরান খান ও তার ব্যাতিক্রম হল না। তবে শাহবাজ শরীফ এক বছর প্রধানমন্ত্রী থাকবে কারন আগামী ২০২৩ এর অক্টোবরে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। ততক্ষন অবধি শাহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী থাকবেন।
পার্লামেন্টে এই ভোটাভুটিতে শাহবাজ শরিফের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পিটিআইয়ের সহসভাপতি ও সদ্য বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি। কিন্তু পিটিআই ভোট বয়কট করায় বিরোধী পক্ষ জিতে যায়। নওয়াজ শরীফের ভাই ও পাকিস্তানের ২৩ তম প্রধানমন্ত্রী সত্তর বছর বয়সী শাহবাজ শরীফের জন্ম লাহোরের এক ধনী পরিবারে। পাকিস্তানেই পড়াশোনা শেষ করে পারিবারিক ব্যাবসায় যোগ দেওয়া শহবাজ শরীফ বর্তমানে একটি ইস্পাত কারখানার যৌথ মালিক। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৯৭ এ পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানে গ্রেফতার হওয়ার পর ২০০০ সালে তাকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন বাদ ২০০৭ সালে দেশে ফিরে এসে ২০০৮ সালে আবারও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয় এবং ২০১৩ সালে আবারও মুখ্যমন্ত্রী পদ ধরে রাখে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে শাহবাজ শরীফের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
এদিকে ইমরান খান ও তার দলের লোকেরা অভিযোগ করেছে রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকাকে সাপোর্ট না করায় আমেরিকা এসব করেছে। এই নিয়ে আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে স্থানীয় পিটিআই সমর্থকেরা বিক্ষোভও করছে। বিক্ষোভের নেতা স্থানীয় পিটিআই সমর্থক ও ব্যাবসায়ী খালিদ তানভীর বলে ইমরান খানকে সরাতে সুপ্রিম কোর্ট ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। ইসলামাবাদেও ইমরান খানের সমর্থকেরা বিক্ষোভ করছে।
এবার শাহবাজ শরীফের সরকারে ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক কেমন হতে পারে? ভারতকে নিয়ে শাহবাজ শরীফের মতাদর্শ কেমন সে ব্যাপারে জানা যাক। আজ থেকে ৪৯ বছর আগে ১৯৭৩ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নতুন সংবিধান গ্রহন করা হয়। পাকিস্তানের ইতিহাসে মোট তিনবার সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে, বর্তমান সংবিধান ১৯৭৩ সাল থেকে চলে আসছে। ভারতের প্রধান প্রতিবেশী ও সবচেয়ে বড় শত্রু দেশ পাকিস্তানের ব্যাপরে সব সময় খবর আমাদের রাখতেই হয়। দেখুন যতদিন ইমরান খানের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ভাল ছিল ততদিন ইমরান খান ক্ষমতায় ছিল, যেই একটু ঝামেলা শুরু হল তখনই সরকার পরিবর্তন হয়ে গেল। তাছাড়া বর্তমানে জিও পলিটিক্সে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারী যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমন করে সেইদিনই ইমরান খান রাশিয়া গিয়ে পৌঁছায়, আমেরিকা এই ঘটনায় যথেষ্ট বিরক্ত হয়, যার প্রভাব পড়ে বর্তমানে। কারন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও অনেক রাজনৈতিক দল এখনও আমেরিকাকে সমর্থন করে। যদি সম্প্রতি ইমরান খানের কিছু বক্তব্য শোনেন দেখবেন ইমরান খান ভারতের বিদেশনীতির যথেষ্ট প্রশংসা করছে এই ঘটনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোপে পড়ে ইমরান খান। আগেই বলেছি শাহবাজ শরীফ পাকিস্তানের পাঞ্জাবের তিনবার মুখ্যমন্ত্রী ছিল। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় পাঞ্জাবকে। পাকিস্তানের সবচয়ে বেশী প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনীর প্রধান এখান থেকেই এসেছে শাহবাজ শরীফ ভারতের ব্যাপারে কিছুটা হলেও শান্তির পক্ষে অন্তত তার আগের কিছু ঘটনায় তাই মনে হয়, বর্তমানে কি হবে সেটা পরের বিষয়।
২০১৮ সালে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের মধ্যে সিঙ্গাপুরে একটি বৈঠক হয় যা দেখে শাহবাজ শরীফ বলেছিল যদি আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বৈঠক হতে পারে, তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেও বৈঠক সম্ভব। শাহবাজ শরীফ বরাবরই ভারতের পক্ষে কথা বলতে একটু এড়িয়ে যায়। কারন শাহবাজ শরীফের দাদা নওয়াজ শরীফের সময় ভারতে মুম্বাইয়ে জঙ্গি আক্রমনে ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর জন্য অনেক চাপ পড়েছিল নওয়াজ শরীফের। একবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হঠাৎই পাকিস্তান সফরে চলে যান আফগানিস্তান থেকে ফেরার সময়। সেখানে নওয়াজ শরীফের সাথে দেখা করেন। এই ঘটনার তীব্র বিরোধিতা করেছিল ইমরান খান যার জন্য ২০১৮ সালে ভোটে জেতে ইমরান খান। সুতরাং শরীফরা কিছুটা হলেও শান্তি চায়। শাহবাজ শরীফ ২০১৩ সালে ভারত সফরেও এসেছিল তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর সাথে সাক্ষাৎ করে পাঞ্জাবে নিজের গ্রামে গিয়েছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে উত্তর ভারতে বায়ুদূষণ ক্রমশ বাড়ছিল তখন শাহবাজ শরীফ পাঞ্জাবের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিংকে চিঠি লিখে বায়ুদূষণ কম করার জন্য একসাথে কাজ করার ব্যাপারে বলেছিল। এসব দেখে মনে হয় শাহবাজ শরীফের সময় ভারত পাকিস্তান সম্পর্ক হয়ত স্বাভাবিক হতে পারে তবে শাহবাজ শরীফ আগে যা করেছে এখন কী তা করতে পারবে?? কারন একটা মুখ্যমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তারপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী রয়েছে।