পুনরায় যুদ্ধের ইঙ্গিত। ইউক্রেনকে ঘিরে এত সংঘাত কেন রাশিয়ার?
ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়া ও ইউরোপের উত্তেজনার ঘটনা কিছু নতুন নয়। তবে সম্প্রতি আবার সীমান্তবর্তী এ স্থানটিকে কেন্দ্র করে আবার যুদ্ধ হবে? এই নিয়েই চলছে গুঞ্জন। এছাড়াও উঠেছে একাধিক প্রশ্ন। তাই এই সকল চাপা গুঞ্জন এর মধ্যেই এবার যুদ্ধ হওয়ার একটা সম্ভাবনা কথা জানিয়েছেন নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল।
বিগত কয়েক দশক আগে ইউরোপে বিশালাকৃতির যুদ্ধ ঘটনা ঘটলেও বেশ কিছু বছর বন্ধ ছিল সেই পর্ব। কিন্তু সম্প্রতি ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে রণসজ্জা। কার্যত সেই কারণে এবার ইউরোপ, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সকলে সরব হয়েছে।
ইউক্রেনকে ঘিরে যে হবু যুদ্ধ সংঘটিত হতে চলেছে সেক্ষেত্রে রাশিয়া কি সত্যিই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে! ! এই প্রসঙ্গের উত্তরে সেনাবাহিনী আধিকারিকদের সূত্রের খবর রাশিয়া বরাবরই গলা ফাটিয়ে বলে এসেছে যে ইউক্রেনের সঙ্গে কোনো রকম দুর্যোগ প্রস্তুতি নিতে নিজেদের ব্যাতি রেখেছে সরকার। তবে এটা অস্বীকার করা যায় না যে রাশিয়া আগেও ইউক্রেনের সীমানা দখল করেছে। এবং বর্তমানে সে সীমান্তবর্তী এলাকায় মোতায়েন করা রয়েছে প্রায় এক লাখ সেনা। রাশিয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি হলো তারা যুদ্ধ চায় না কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনকে যেতে দিতে নারাজ রাশিয়া। এছাড়াও দ্বিতীয় কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে রাশিয়ার বিপুল আপত্তি রয়েছে নেটো জোট নিয়ে। কারণ ইউক্রেন নেটো জোটের সদস্য না হলেও পূর্ব ইউরোপের আরও অনেক সাবেক কমিউনিস্ট দেশের মতো ইউক্রেন সেই পথে চলছে বলে অনুমান করছে তারা। যদিও এই বিষয়ে এক একধিক মতামত রয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ পশ্চিমা দেশগুলো যদি রাশিয়ার প্রতি আক্রমনাত্মক দৃষ্টি না বদলায় সেই ক্ষেত্রে রাশিয়ার পক্ষ থেকেও পাল্টা সামরিক কারিগরি ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। একই প্রসঙ্গে নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, ‘ একটা সংঘাতে সম্ভাবনা রয়েছে’। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজের মন্তব্য দিয়ে বলেছেন, ‘ রাশিয়া কেন ইউক্রেন সীমান্তের কাছে এত সৈন্য পাঠিয়েছে? তার ব্যাখ্যা দেয়নি। এমনকি বেলারুশেও রাশিয়ার সৈন্যরা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে এটাই মনে করা হচ্ছে বছরের প্রথম দিকেই রাশিয়া ইউক্রেনের প্রথমভাগে ঢোকার সম্ভবনা রয়েছে’। এমনকি এই প্রসঙ্গে রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসন্ন সংকটকে ১৯৬২ সালের কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
ইউক্রেনকে ঘিরে এত সংঘাত কেন?
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের সংঘাত বলতে গেলে বেশ কয়েক বছর পূর্বে যেতে হবে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অংশ ছিল। কার্যত সেই সময় কালে পূর্ব ইউরোপের বেশকিছু কমিউনিস্টদের এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মত ইউক্রেনে অদূরে রাজনৈতিক ধারা স্পষ্ট ছিল। তবে ১৯৯৭ সালের পর থেকে বদলে যায় । সেই সময় পূর্ব ইউরোপীয় দেশে গড়ে ওঠে একাংশ নেটোদের সদস্য। পাশাপাশি পশ্চিম ইউরোপে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করে নেটো সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। তবে দেশের একাংশে নেটোদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অন্যদিকের অংশ ছিল রুশ সংস্কৃতির প্রভাবে ভরপুর। যদিও ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট বিক্ষোভ কালীন সময়ে ক্ষমতা চ্যুত হয়ে পড়েছিলেন। কারণ প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সত্ত্বেও মস্কোকেও অন্য হাতে রেখেছিলেন। যদিও এই দ্বিচারিতা করার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক বিশাল চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পুতিন ইউক্রেনের উপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় লাভের লাভ কিছু হয়নি। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ইংরেজি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসায় তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে গণবিক্ষোভে ডাক দিয়েছিল সাধারণ জনগণ। এই বিদ্রোহীদের সমর্থন তাদের পাশে দাঁড়ায় রুশ সৈন্যরা। কার্যত দীর্ঘ লড়াইয়ের পর এক পর্যায়ে রাশিয়া অঞ্চল দখল করতে সমর্থ হয়। কিভাবে দখলদারির পরে অঞ্চলটিকে নিজেদের দেশের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে রাশিয়া।
অন্যদিকে আবার প্রশ্ন উঠছে রাশিয়া কেন ক্রিমিয়াকে নিজের সীমানায় ভুক্ত করল?
সকলের মনেই এই প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক। কারন রাশিয়া হলো বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম দেশ। যার এগারটি টাইম জোন রয়েছে। সেক্ষেত্রে রাশিয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ এবং ভারতের পাঁচ গুণ। পাশাপাশি ব্রিটেনের চেয়ে ১০ গুণ বড়। কিন্তু দেশটির বৃহত্তম তার প্রথম স্থান অধিকার করল এখানের জনসংখ্যা মাত্র ১৪ কোটা ৪০ লাখ। যেটা বাংলাদেশ নাইজেরিয়া বা পাকিস্তানের চেয়ে অত্যন্ত কম। যে দেশে জনসংখ্যা এত সামান্য সেখানে অধিক জায়গা দখল করার কারণ কি! এরও একটি যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। এখানে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে রাশিয়া যত বড় দেশ হোক না কেন সারাবছর সচল রাখা যায় উষ্ন জলে এমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বন্দর নেই তাদের কাছে। রাশিয়ার ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌ ঘাঁটি রয়েছে সেটাও দেশের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার ঢোকার একমাত্র পথ হচ্ছে এই বন্দরটি। তাই ক্রিমিয়া নিজেদের দেশের অন্তর্গত বলে ঘোষণা করেছে রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটোর কাছে রাশিয়ার দাবি কি?
বর্তমানে ইউক্রেন নেটোর সদস্য না হলেও তার সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে যদি কোনদিন নেটোর সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয় সেই হিসেবেই ইউক্রেন নেটোর সঙ্গে এখন কিছুটা সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু সেই সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। যদিও রাশিয়ার এই বিষয়ে সম্মতি দিতে নারাজ পশ্চিমা দেশগুলো। রাশিয়ার এই কর্মকাণ্ডকে ঘিরে এক একজন এক এক রকম মতামত পেশ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ‘ পশ্চিমা শক্তি আসলে নেটওয়ার্কে ব্যবহার করে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলে যায়। সেই কারণে রাশিয়ান যতই কৌশলগতভাবে ইউক্রেনকে তাদের বাড়ির পেছনে আঙ্গিনা বলে আখ্যায়িত করুক না কেন পশ্চিমা দেশ রাশিয়া সঙ্গে কোনদিনই একমত হবে না। তাছাড়া ১৯৯০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র নেটো জোটকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয় বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পরবর্তীতে তারা সেটা রাখেনি। সেক্ষেত্রে আগামী দিনে নেটো পূর্ব ইউরোপের সামরিক তৎপরতা ক্রোমিয়াম এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এমনকি যাকে নিয়ে এত তর্ক-বিতর্ক সেই নেটোই রাশিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে’।
আবার লাতভিয়ার নেটো সৈন্যদের সামরিক মহড়া নিজেদের মন্তব্য প্রকাশ করে জানিয়েছেন, ‘নেটো জুটির মাত্র অল্প করে দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত রয়েছে। তবে এই সংখ্যা অল্প হলেও এটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। সেক্ষেত্রে অনেকে মনে করছেন রাশিয়া-ইউক্রেনকে ঘিরে যে বিরাট সৈন্য সমাবেশ তৈরি করতে যাচ্ছে সেটা শুধুমাত্র পশ্চিমারা যাতে রাশিয়ান নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয় গুলির দিকে গুরুত্ব দেয় সেই জন্য পশ্চিমা দেশকে বাধ্য করতেন রাশিয়ার এই ছক কষার পরিকল্পনা।
আবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন জানান, ‘ইউক্রেনকে নেটোর সামরিক জোটে প্রবেশ করার যে দাবী রাশিয়া জানিয়েছে সেটা ঝড়ের মূল্য প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র’।
অন্যদিকে আবার নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলেন বার্গ বলেন,’ রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয় গুলো মস্কোর কাছে তুলে ধরা হয়েছিল এবং উদ্বেগের বিষয় গুলি মস্কোর সরকার শুনতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে এটাও বুঝতে হবে যে প্রত্যেকটি দেশের অধিকার আছে নিজের মতন করে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঠিক করার ‘।
রাশিয়ার মতো শক্তিশালি দেশ কেন নিরাপত্তা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন!
রাশিয়ার ভয়ের কারণ সম্পূর্ণভাবে জানা যাবে ব্রিটিশ সাংবাদিক টিম মার্শালের লেখা বেস্টসেলার ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’ বইতে।
বর্তমানে রাশিয়া শক্তিশালী দেশ হিসেবে পরিচিত থাকলেও একসময় বহু প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে উপহারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল রাশিয়াকে। এর যথেষ্ট ভিত্তিও আছে। গত পাঁচশো’ বছরে রাশিয়ায় বহু বিদেশি শক্তির আক্রমণের মুখে পড়েছে, আর এই সবগুলো আক্রমণই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে। ইতিহাস মতে ১৬০৫ সালে পোলিশরা আক্রমণ চালিয়েছিল এই পথ ধরে। এর পরে ১৮১২ সালে সুইডিশরা নেপোলিয়নের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফরাসীরা। জার্মানরা রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছে দুবার – ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, আবার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
আবার ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের সময় হতে হিসেব করলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে প্রতি ৩৩ বছরে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপের সমতলভূমিতে একবার করে যুদ্ধ হয়েছে। কাজেই সেই থেকে রাশিয়ার একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে তাদের দেশের জন্য কোন নিরাপত্তা হুমকি যদি থেকে থাকে, সেটি এই পথেই আসবে।
১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙ্গে গিয়েছিল, সেটিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন রাশিয়ার জন্য এক ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন। এরপর থেকেই শুরু হয় রাশিয়া উদ্বেগের পর্ব। তাই রাশিয়া সরকারের প্রতিনিয়ত মনে হয় কিভাবে এবং কোন পথে ধীরে ধীরে সামরিক জোট নেটো চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে।
পাশাপাশি ১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড যোগ দিল নেটোতে। ২০০৪ সালে তাদের পথ অনুসরণ করেছে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়েনিয়া, রোমানিয়া এবং স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দিল আলবেনিয়া।
১৯৪৯ সালে নেটো চুক্তিতে সই করছেন তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান এই দেশগুলো এক সময় হয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য। জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেনও পারলে নেটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়, কিন্তু এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার কারণেই তাদের যোগ দেওয়া হয়নি। কারণ এই তিনটি দেশেই রুশ-পন্থী মিলিশিয়াদের শক্ত অবস্থান আছে। এই দেশগুলোর যে কোন একটি যদি নেটোতে যোগ দেয়, তা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করবে।
এই প্রসঙ্গে টিম মার্শাল লিখেছেন, গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতেকে ভাবতে পেরেছিল মস্কো হতে মাত্র কয়েকশো’ মাইল দূরে পোল্যান্ডের মাটিতে বা বাল্টিক দেশগুলোতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা থাকবে। অর্থাৎ ইউক্রেনের নেটোতে যোগ দেওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র বা নেটোর সামরিক বাহিনী একেবারে রাশিয়ার পেটের ভেতরে এসে অবস্থান নেওয়া। নিজের দোরগোড়ায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া সঙ্গত কারণেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ার প্রবেশ দ্বার। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপ লাইনগুলো ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে গেছে। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ হয় এই পাইপলাইনের মাধ্যমে।
সেক্ষেত্রে একাংশের অনুমান ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে বলে আশংকা করে।
তবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া বাল্টিক সাগরের নীচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম-২ নামে নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া যদি ইউক্রেনে অভিযান চালায়, তাহলে এই নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প আর সামনে আগাবে না বলে এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
২০০২ সালে এক রুশ-নেটো শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ এবং সিলভিও বারলুসকোনির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউরোপ যেভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে করে রাশিয়া অন্যান্য দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
রাশিয়া চাইলে যে কোন সময় এসব গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে, সামনের দিনগুলোতে এই জ্বালানিকে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বার বার ব্যবহার করতে পারে এই বিষয়টিও উল্লেখ করেছে রাশিয়া।
……….. ইউক্রেনের বিষয়ে নেটো কি ঐক্যবদ্ধ !
এই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছে, ‘ ইউক্রেন বিষয়ে ইউরোপীয় নেতারা সবাই একমত। তবে সেক্ষেত্রে বাদবাকি দেশগুলোর সমর্থন করার কথা বললেও তাদের সকলের সমর্থনের পথ ভিন্ন।
আবার যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছেন, ‘ আপাতত ইউক্রেনে করে ৭০ টনের মতো মরণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে যাতে রণাঙ্গনের সামনের কাতারে পুতির তৈরি করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ এক কথায় স্বল্পমাত্রার ট্যাংক ও বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে যুক্তরাজ্য। তবে শুধুমাত্র যুক্তরাজ্য নয় বেশ কিছু নেটো দেশে যেমন ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ড তাদের যুদ্ধবিমান এবং যুদ্ধজাহাজ পূর্ব ইউরোপে পাঠাচ্ছে প্রতিরক্ষা জোরালো করতে। তবে এই সকল দেশ নিজেদের সাধ্যমত যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করলে জার্মানি অস্ত্র দিতে অস্বীকার করেছে। তার একটাই কারণ হচ্ছে দেশটির নীতি অনুযায়ী সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র তারা পাঠায় না। কিন্তু মেডিকেল ত্রান পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছে জার্মান। এছাড়াও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এই বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করছেন।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো কি অবস্থা নিতে পারে !
যেহেতু বরাবরই রাশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে একটি সংঘাতের চিত্র প্রকাশ এসেছে সে ক্ষেত্রে মূলত মারাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাই বলছে পশ্চিমা দেশগুলো। যদিও তারা খোলাখুলি স্পষ্ট করে বলছে না এই নিষেধাজ্ঞা ঠিক কেমন হবে। যে একটি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে, সেটি হলো একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক বার্তা লেনদেন সার্ভিস ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়াকে বাইরে রাখা। বিশ্বে দুশো’র বেশি দেশের ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো এটি ব্যবহার করে।
পশ্চিমা দেশগুলোর এরকম পরিকল্পনার প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন,’ এটি একটি মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে রাশিয়ার ব্যাঙ্কগুলোর পক্ষে কোন ধরণের আন্তর্জাতিক লেনদেন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে’।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে এটি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে এরকম নিষেধাজ্ঞায় উল্টো ফলও হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মান ব্যাঙ্কগুলোর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। তাই যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাশিয়াকে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। কিন্ত এর ফলে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একেবারে সীমিত হয়ে পরবে। আর তার বিরাট প্রভাব পরতে পারে রুশ অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক ঋণ বাজার থেকে যাতে রাশিয়া ঋণ করতে না পারে, সেরকম নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে। সেই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হতে পারে প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে।
পশ্চিম ইউরোপে রাশিয়া যে জ্বালানি বিক্রি করে, সেটি বন্ধ করার কথাও আলোচনায় শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এর কোন বিকল্প এখনও পর্যন্ত জার্মানি বা অন্যদেশগুলোর কাছে নেই। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেই মতবিরোধ চলছে একমাত্র রাশিয়াকে শাস্তি দিতে কতদূর পর্যন্ত যাবে তারা।