ডিফেন্স

বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ ভারতবর্ষের নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট

রাজেশ রায়: যদি আপনারা যে কোন দেশের নৌবাহিনী সম্পর্কে জেনে থাকেন তাহলে ডেস্ট্রয়ার আর ফ্রিগেটের নাম অবশ্যই শুনে থাকবেন। যে কোন দেশের নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ তার সারফেস শিপ, আর এই ক্যাটেগরিতে ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ারের গুরুত্ব অনেক। ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেটের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে তাদের ফায়ার পাওয়ার ও সাইজ। একটি ডেস্ট্রয়ার সাধারণত ৭০০০ + টনের হয়ে থাকে যেখানে ফ্রিগেট সাধারণত ৪০০০ থেক ৬৫০০ টন পর্যন্ত হয়। এই মহূর্তে বিশ্বের ৫৫ টি দেশের নৌবাহিনীতে ফ্রিগেট এবং ১৩ টি দেশের নৌবাহিনীতে ডেস্ট্রয়ার রয়েছে। ভারতীয় নেভিতে এই মহূর্তে ১৩ টি ফ্রিগেট রয়েছে। ভবিষ্যতে ভারতীয় নৌবাহিনীতে সাতটি নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট ও ৪ টি তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট যুক্ত হবে। আজ আমরা আলোচনা করব ভবিষ্যতে ভারতীয় নৌবাহিনীগে যুক্ত হতে যাওয়া একটি শক্তিশালী ফ্রিগেট নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট সম্পর্কে।

নীলগিরি ক্লাস বা প্রজেক্ট ১৭ আলফা ক্লাস ফ্রিগেট ডিজাইন করা হয়েছে শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের উপর বেসড করে যাকে পি ১৭ ক্লাস ফ্রিগেট ও বলে। শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের থেকে নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটর ওয়েপনস সিস্টেম ও স্টেলথ ফিচার বেশী অ্যাডভান্সড। অ্যাডভান্সড স্টেলথ ফিচার যুক্ত নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের রেডার ক্রস সেকশন ও ইনফ্রারেড সিগনেচার কম। এই ফ্রিগেটের ডিজাইন তৈরির এমন ভাবে করা হয়েছে যাতে এর সারভাইভালবিলিটি ও ম্যানুভারবিলিটি বেশী হয়। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে টোটাল ১৫০ জন ক্রু থাকতে পারে। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের সুপার স্ট্রাকচার কামোরতা ক্লাস করভেটের মত বিশেষ ধাতু দিয়ে তৈরি। মোট সাতটি নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মুম্বাইয়ের মাজগাঁও ডক লিমিটেড ও কলকাতার গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং যৌথভাবে এই যুদ্ধজাহাজ গুলো তৈরি করছে। এই প্রজেক্টে মোট খরচ হচ্ছে ৪৫,০০০ কোটি টাকা বা প্রায় ৭.১ বিলিয়ন ডলার। এক একটি নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের খরচ ৪০০০ কোটি টাকা বা ৫৩১ মিলিয়ন ডলার। ইটালিয়ান জাহাজ নির্মান সংস্থা ফিনক্যান্টিয়েরি নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট ডিজাইনে সাহায্য করেছে। চারটি নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট তৈরি হচ্ছে মুম্বাইয়ের মাজগাঁও ডকে ও বাকী তিনটি কলকাতার গার্ডেনরিচে। ২০১৫ সালে এই দুটি শিপইয়ার্ডের সাথে চুক্তি হয়। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে ব্যবহৃত ৮০% উপাদান ভারতীয় হবে। ভারতের অন্তত ২০০০ টি কোম্পানি এই প্রজেক্টে যুক্ত আছে। যে সাতটি নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট তৈরি হচ্ছে তাদের নাম নীলগিরি, হিমগিরি, তারাগিরি, উদয়গিরি, দুনাগিরি, বিন্ধ্যগিরি ও মহেন্দ্রগিরি। ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের প্রথম ফ্রিগেটের স্টিল কাটিং শুরু হয় মুম্বাইয়ের মাজগাঁও ডকে,  এই বছর আগস্ট মাসে এটি ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হবে। ২০২২ থেকে ২০২৫ এর মধ্যে সমস্ত নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হবে।

নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে প্রধান রেডার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ইসরায়েলি এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এল্টার তৈরি ইএল/এম- ২২৪৮ এফস্টার এসা রেডার। এটি এস ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। এটি এয়ার ও সারফেসে টার্গেট উভয়কেই ট্রাক করতে সক্ষম, তাছাড়া এটি ফায়ার কন্ট্রোল গাইডেন্স ও করে। এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৩০০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার। ভারতের কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, আইএনএস বিক্রান্ত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে এই রেডার ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া স্পেনের ইন্দ্র এলটিআর ২৫ ল্যানজা রেডার ও ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি থ্রিডি লং রেঞ্জ সারভিলেন্স রেডার। এটি এল ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে সিএমএস -১৭এ অ্যাভান্সড কমব্যাট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। জলের গভীরে সাবমেরিন খোঁজার জন্য নীলগিরি ক্লাসে ব্যবহার করা হয়েছে ডিআরডিও এর তৈরি নেক্সট জেনারেশন হামসা সোনার। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে ডিফেন্স ইলেকট্রনিকস রিসার্চ ল্যাবরেটরির তৈরি শক্তি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ব্যবহার করা হয়েছে। শত্রুর যুদ্ধজাহাজের রেডার জ্যাম করতে এই টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়। রেডার গাইডেড মিসাইল প্রতিরোধের জন্য এতে ব্যবহার করা হয়েছে অরডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের তৈরি কবচ ডেকয় সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। এই কবচ সিস্টেমে তিনটি বিভিন্ন ধরনের চ্যাফ রকেট ব্যবহার করা হয়েছে। লং রেঞ্জ -১২ কিলোমিটার,  মিডিয়াম রেঞ্জ -৫ কিলোমিটার ও শর্ট রেঞ্জ – ১ কিলোমিটার। প্রতিটি নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে চারটি করে কবচ সিস্টেম রয়েছে। আগামী তিন বছরে ভারত অন্তত ৪০০০ কবচ সিস্টেম তৈরি করবে। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে দুটি মারিচ অ্যাডভান্সড টর্পেডো ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ইনকামিং টর্পেডোকে ডিটেক্ট করে ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি তৈরি করেছে কোচির নেভাল ফিজিক্যাল এন্ড ওশেনগ্রাফিক ল্যাবরেটরি ও বিশাখাপত্তনমের নেভাল সায়েন্স ও টেকনোলজিক্যাল ল্যারেটাররি। ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেড এটি লাইসেন্স নিয়ে তৈরি করেছে। ১৪৯ মিটার লম্বা নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের ডিসপ্লেসমেন্ট ৬,৫৬০ টন এবং এর সর্বোচ্চ গতি ৩২ কিলোনট বা ৫৯ কিলোমিটার /ঘন্টা। এতে ইন্জিন হিসাবে রয়েছে দুটি জার্মান ম্যান ডিজেল ১২ভি২৮/৩৩ডি এসটিসি ইন্জিন যার প্রতিটি ৬০০০ কিলোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে এবং আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিকের দুটি এলএম ২৫০০ ইঞ্জিন। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের সর্বোচ্চ রেঞ্জ ১০,২০০ কিলোমিটার। 

অস্ত্র হিসাবে নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে ব্যবহার করা হয়েছে ইটালিয়ান অটো মেলেরা ৭৬ মিলিমিটার গান। প্রথমে ভারতীয় নৌবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেইয়ি সিস্টেমের তৈরি মার্ক -৪৫ ১২৭ মিলিমিটার গান ব্যবহার করার। কিন্তু বাজেট সমস্যার কারনে শেষ পর্যন্ত এটা বাদ দিয়ে অটো মেলেরা গান ব্যবহার করা হয়। ক্লোজ রেঞ্জের জন্য এতে রয়েছে দুটি একে-৬৩০ গান ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৮ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ১.২৮ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮৩০ কোটি টাকার ওয়েপনস প্যাকেজ ঘোষনা করে প্রথম তিনটি নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের জন্য। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে ব্যবহার করা হয়েছে ৩২ টি এক্সটেন্ডেড রেঞ্জ বারাক ৮ এয়ারডিফেন্স মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছে, যার রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটার। ২০১৮ সালে এই মিসাইলের জন্য ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এল্টার সাথে ৭৭৭ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে ভারত। ল্যান্ড অ্যাটাক ও অ্যান্টিশিপ রোলের জন্য ৮ টি ব্রাহ্মস মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের জন্য এতে রয়েছে দুটি ট্রিপিল টর্পেডো টিউব যা ডিআরডিও এর তৈরি বরুনাস্ত্র টর্পেডো বহন করে। এর রেঞ্জ ৪০ কিমি। এখনও পর্যন্ত ১৫০ টি বরুনাস্ত্র টর্পেডো তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও দুটি আরবিইউ -৬০০০ রকেট লঞ্চার ও রয়েছে। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট দুটি হেলিকপ্টার বহন করতে সক্ষম।

শিভালিক ক্লাস ও নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের মধ্যে কীছু পার্থ্যক্য:—-

* শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের ডিসপ্লেসমেন্ট ৬২০০ টন কিন্তু নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের ডিসপ্লেসমেন্ট ৬৬৭০ টন।

* নীলগিরি ক্লাসের ইন্জিন তুলনামূলক বেশী শক্তিশালী শিভালিক ক্লাসের থেকে।

* নীলগিরি ক্লাস শিভালিক ক্লাসের থেকে আয়তন ও ডিসপ্লেসমেন্টে বড় হওয়া সত্বেও শিভালিক ক্লাসের থেকে কম ক্রু থাকে। শিভালিক ক্লাসে ২৫৭ জন ক্রু থাকে সেখানে নীলগিরি ক্লাসে ৬০% কম ১৫৫ জন ক্রু থাকে। যার একটাই অর্থ নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে ডিজিটাল টেকনোলজি বেশী ব্যবহার করা হয়েছে।

* নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের মেইটেন্যান্স খরচ শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের থেকে অন্তত ২০ শতাংশ কম।

* শিভালিক ক্লাস ইসারায়েলের ইএলএম ২২৩৮ রেডার ব্যবহার করে যার রেঞ্জ ৩০০ কিলোমিটার কিন্তু নীলগিরি ক্লাস এর আপগ্রেডেড ভার্সন ইএলএম ২২৪৮ রেডার ব্যবহার করে, যার রেঞ্জ ৪৫০+ কিলোমিটার।  এই ২২৩৮ পালস ডপলার রেডার কিন্তু ২২৪৮ এসা রেডার যারজন্য একে জ্যাম করা অনেক কঠিন।

* শিভালিক ক্লাসে বেলের ইলোরা ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু নীলগিরি ক্লাসে ডিআরডিও এর শক্তি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ব্যবহার করা হয়েছে।

* শিভালিক ক্লাসে বারাক -১ ও শ্টিল -১ স্যাম ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু নীলগিরি ক্লাসে আপগ্রেডেড বারাক -৮ স্যাম ব্যবহার করা হয়েছে। 

* শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটে ডবল টর্পেডো টিউব রয়েছে কিন্তু নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটে ট্রিপিল টর্পেডো টিউব রয়েছে। 

* নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেটের স্টেলথ টেকনোলজি শিভালিক ক্লাসের থেকে অ্যাডভান্সড। 

পৃথিবীর সেরা পাচটি ফ্রিগেটের লিস্টে নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট রয়েছে। মজার ব্যাপার কী জানেন দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ার থেকেও শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেট অ্যাডভান্সড কিন্তু তাও শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটকে ডেস্ট্রয়ার বলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *