ডিফেন্স

মিসাইল কে বিভ্রান্ত করে দেয়। ভারতীয় নেভির সবচেয়ে শক্তিশালী ডেস্ট্রয়ার বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার যা চীন ও পাকিস্তানের চিন্তার কারন

রাজেশ রায়:– ভারতীয় নেভির সার্ভিসে থাকা সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী ডেস্ট্রয়ার হচ্ছে বিশালপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার। ২০১১ সালে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি কলকাতা ক্লাসের থেকেও একটি শক্তিশালী ডেস্ট্রয়ার প্রজেক্ট শুরু করে যার নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট পি-১৫ বি বা প্রজেক্ট ১৫ ব্রাভো। মোট চারটে এই ধরনের ডেস্ট্রয়ার তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদের নাম দেওয়া হয় আইএনএস বিশাখাপত্তনম, আইএনএস মর্মগাও, আইএনএস ইম্ফল ও আইএনএস সুরাট। প্রথমে এই প্রজেক্টের খরচ ধরা হয় প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৯,৩৪০ কোটি টাকা। গত জানুয়ারি, ২০২০ তে এর জন্য যুদ্ধাস্ত্র ও সেন্সর প্যাকেজ অনুমোদন করা হয়। সব মিলিয়ে এই প্রজেক্টের খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩৫,৮০০ কোটি টাকা। এক একটি বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের খরচ হয় ১.২ বিলিয়ন ডলার বা ৮,৯৫০ কোটি টাকা। 

চারটি বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের চুক্তি সাক্ষর হয় ২০১১ সালের জানুয়ারী মাসে। প্রথম বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার আইএনএস বিশাখাপত্তনমের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে, ২০১৫ সালের এপ্রিলে এটি লঞ্চ করা হয়। বিশাখাপত্তনম ক্লাসের দ্বিতীয় জাহাজ আইএনএস মর্মগাও লঞ্চ হয় সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তে, তৃতীয় জাহাজ আইএনএস ইম্ফল লঞ্চ হয় এপ্রিল, ২০১৯ এ এবং সর্বশেষ বিশাখাপত্তনম ক্লাস যুদ্ধজাহাজ আইএনএস সুরাট লঞ্চ হয় জুলাই, ২০১৮ তে। ২০২৫ এর মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনী তে সমস্ত বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার যুক্ত হয়ে যাবে। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের মতই বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরি হয়েছে মুম্বাইয়ের মাইজগাঁও ডকে। বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে স্টীল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (SAIL) এর তৈরি বিশেষ “ডিএমআর ২৪৯ এ” লো কার্বন মাইক্রো অ্যালয়েড গ্রেড স্টীল ব্যবহার করা হয়েছে। 

বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ইঞ্জিন হিসাবে রয়েছে ইউক্রেনের তৈরি দুটি জোরিয়া এম৩৬ই গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন, যার মধ্যে রয়েছে চারটি ডিটি ৫৯ রিভার্সেবল গ্যাস টার্বাইন ও দুটি আরজি ৫৪ গিয়ারবক্স। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারেও এই একই ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের সর্বোচ্চ গতি ৩০ নট বা ৫৬ কিমি/ঘন্টা। এই ডেস্ট্রয়ার ৪০০০ নটিক্যাল মাইল বা ৭৪০০ কিমি এলাকা জুড়ে নজরদারি করতে পারে। বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের সর্বোচ্চ ডিসপ্লেসমেন্ট ৮৪০০ টন, কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের মতই। ১৬৩ মিটার লম্বা ও ১৭.৪ মিটার প্রস্থের এই বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার একটানা ৪৫ দিন অপারেশনাল থাকতে পারে। বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ৩০০ জন ক্রু থাকতে পারে, ৫০ জন অফিসার ও ২৫০ জন নাবিক।

বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে প্রধান রেডার হিসাবে রয়েছে ইসরায়েলের ইল/এম – ২২৪৮ এমএফ স্টার এসব্যান্ড এসা রেডার। হাই অল্টিটিউড যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে এই রেডারের ট্রাকিং রেঞ্জ ২৫০+ কিমি, সী স্কিমিং মিসাইলের ক্ষেত্রে এর রেঞ্জ ২৫ কিলোমিটার। এর ইলেকট্রনিক কাউন্টার মেজার সিস্টেম ব্যাপক শক্তিশালী যারজন্য একে জ্যাম করা খুবই কঠিন। এয়ার ও সারফেসে একসাথে ১০০+ টার্গেট কে শনাক্ত করতে সক্ষম এই এম এফ স্টার রেডার। এছাড়াও ফ্রান্সের থ্যালসের তৈরি একটি এক ডব্লিউ – ০৮ ডি ব্যান্ড এয়ারসার্চ রেডার রয়েছে কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের মতনই। ছোট মিসাইলের ক্ষেত্রে এর শনাক্তকরন রেঞ্জ হচ্ছে ১০০ কিমি এবং যুদ্ধবিমানের জন্য ২৩০ কিমি এবং ম্যাক ৪ এর টার্গেটের জন্যও এর সর্বনিম্ন ডিটেকশন রেঞ্জ ২ কিমি। এই রেডার ৪০০ টার্গেট কে ডিটেক্ট করতে সক্ষম। সোনার হিসাবে ভারত ডায়নামিক লিমিটেডের তৈরি হামসা এনজি বা নেক্সট জেনারেশন সোনার ইনস্টল করা হয়েছে কলকাতা ক্লাসের মতনই। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম হিসাবে রয়েছে ডিআরডিও এর তৈরি “শক্তি” ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম। এছাড়াও রয়েছে “কভচ” ডেকয় সিস্টেম মূলত রেডার গাইডেড মিসাইল কে অবাক করার জন্য এই সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। এই সিস্টেম চ্যাফ ফায়ার করে যা তৈরি হয়েছে সিলভার কোটেড গ্লাস ফাইভার দিয়ে। এই চ্যাফ বাতাসে গিয়ে মিশে গিয়ে একটি আস্তরন তৈরি করে গাইডেড মিসাইল কে বিভ্রান্ত করে দেয়। মিসাইল আসল টার্গেট কে ছেড়ে ভুল করে একে হিট করে বসে। এই চ্যাফ রকেটের তিনটি ভার্সন রয়েছে প্রথম হচ্ছে লং রেঞ্জ যার এরিয়া ১২ কিলোমিটার,  দ্বিতীয় হচ্ছে মিডিাম রেঞ্জ যার এরিয়া ৫ কিলোমিটার, তৃতীয় হচ্ছে শর্ট রেঞ্জ যার এরিয়া হচ্ছে ১ কিলোমিটার। পরিস্থিতি বুঝে এগুলো ব্যবহার করা হয়।

বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে মোট ৪৮ টি ভিএলএস সিস্টেম বা ভারটিক্যাল লঞ্চ সিস্টেম রয়েছে। এর মধ্যে ৩২ টি নরম্যাল ভিএলএস সিস্টেম ও ১৬ টি ইউনিভার্সাল ভিএলএস সিস্টেম। ৩২ টি ভিএলএস সিস্টেম থেকে ৩২ টি ইসরায়লি অ্যান্টি এয়ার বারাক-৮ এক্সটেন্ডেড রেঞ্জ মিসাইল ফায়ার করা যায় যার রেঞ্জ ৫০০ মিটার থেকে শুরু করে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত, গাইডেন্স সিস্টেম হিসাবে বারাক-৮ এ রেয়েছে টু ওয়ে ডাটা লিংক এবং অ্যাক্টিভ রেডার সিকার যার জন্য এই মিসাইল অত্যন্ত ঘাতক। ১৬ টি ইউনিভার্সাল ভিএলএস সিস্টেম থেকে ১৬ টি ব্রাহ্মস মিসাইল ফায়ার করা সম্ভব, ভবিষ্যতে ব্রাহ্মস এনজি মিসাইল আসবে যা বর্তমান ব্রাহ্মস মিসাইল কে রিপ্লেস করবে, তাছাড়া নির্ভয় ক্রুজ মিসাইলও ইনস্টল হতে পারে। ব্রাহ্মস এনজির রেঞ্জ হবে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার যা বর্তমান ব্রাহ্মস মিসাইলের (২৯০ কিমি) রেঞ্জের দ্বিগুন। শর্ট রেঞ্জের জন্য রয়েছে ৪ টি একে-৬৩০.  একটি ইটালিয়ান অটো মেলেরা ৭৬ মিলিমিটার গান রয়েছে যার রেঞ্জ ১৬-২০ কিমি এবং ২ টি ওএফটি ১২.৭ মিলিমিটার এম২ স্টেবিলাইজড রিমোট কন্ট্রোল গান রয়েছে। অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের জন্য রয়েছে ৪ টি ৫৩৩ মিলিমিটার টর্পেডো টিউব এবং দুটি আরবিইউ-৬০০০ রকেট লঞ্চার রয়েছে। বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ২ টি হ্যাল ধ্রুব হেলিকপ্টার থাকতে পারে।

এবার যেটা সবথেকে বেশী কৌতূহল জাগে সবার মধ্যে তা হচ্ছে কলকাতা ক্লাস ও বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের মধ্যে পার্থক্যা কী কী?

দেখুন বিশাখাপত্তনম ক্লাস কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের আপগ্রেডেড ভার্সন তাই এই দুটি ক্লাসের ডেস্ট্রয়ারেরই ডিজাইন, ইন্জিন, সোনার এমনকী অস্ত্র সম্ভার সহ অনেক কিছু একই। তবুও কিছু পার্থক্য আছে। 

* প্রজেক্ট পি-১৫ আলফা বা,কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের ৫৯% কম্পোনেন্ট ভারতীয় কিন্তু বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের ৭২% কম্পোনেন্ট ভারতীয়। 

* বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে সোনার পজিশন কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের মতন হ্যালে না রেখে জাহাজের সামনের ভাগে রাখা হয়েছে। 

* বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের সেন্সর ও স্টেলথ ফিচার আরও অ্যাডভান্সড। 

* বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে মোট ক্রু ৩০০ জন, কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে মোট ক্রু ৩৩০ জন। অর্থাৎ বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ডিজিটাল ও অটোমেশন টেকনোলজি বেশী যার জন্য অন্তত ৩০ জন ক্রু কম লাগে। 

* বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রেল লেস হেলিকপ্টার ট্রাভ্যেরসিং সিস্টেম। ডেস্ট্রয়ার সমুদ্রে থাকে, সমুদ্রের উচ্চ জোয়ারে ডেস্ট্রয়ারের হেভি মুভমেন্টের জন্য হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং এ সমস্যা হয়, যার জন্য হেলিকপ্টার কে রেল ব্যবহার করে হ্যাংগারে নিয়ে যাওয়া হয় এই পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে একটি আলাদা পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে।

* নেটওয়ার্ক সেন্ট্রিক ওয়ারফেয়ার ক্যাপেবিলিটি থাকবে।

* কমব্যাট ব্যাটেল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও ডিজিটাল পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম রয়েছে। 

* বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের রেডার ক্রশ সেকশন বা আরসিএস কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের থেকে কম, যার জন্য এটি আরও বেশী স্টেলথ।

** বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে প্রথমে ঠিক ছিল BAE সিস্টেমের তৈরি ৫ ইঞ্চি ৬২ ক্যালিবারের মার্ক -৪৫ নেভাল গান ইনস্টল করা হবে, যা ১২৭ মিলিমিটার রাউন্ড ফায়ার করে। এর জন্য আমেরিকার সাথে চুক্তি ও হয়ে গেছিল। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ব্যবহার করা হয় ৭৬ মিলিমিটার এর ইটালিয়ান অটো মেলেরা গান। মার্ক ৪৫ গান প্রতি মিনিটে ১৬-২০ রাইন্ড ফায়ার করতে পারে এবং এর রেঞ্জ ২৪-৩৭ কিমি। কিন্তু অতিরিক্ত দামের জন্য এই গানের বদলে ইটালিয়ান অটো মেলেরা গান ই ব্যবহার করা হচ্ছে, এই গান ভারতে ভেল তৈরি করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *