ডিফেন্স

বিশ্বের সবথেকে ভয়ানক গুপ্তচর সংস্থা ইসরায়েলের। মোসাদের টার্গেট লিস্টে যদি কেউ একবার এসে যায় তাহলে তাকে একমাত্র ঈশ্বরই বাঁচাতে পারে

রাজেশ রায়ঃ বাস্তব জীবনে আমরা সবাই কম বেশী গোয়েন্দা কাহিনী,  ডিটেকটিভ নোভেল,  স্পাই সিরিজ দেখেই থাকি। বিশেষ করে বোমক্যেশ বক্সি থেকে শুরু করে শার্লক হোমস এর গল্প পড়েননি এমন বাঙালি বোধহয় কমই আছেন। আর সিনেমা হলে কাকাবাবুর বিভিন্ন অভিযানের সিনেমা তো দেখতে কম বেশী অনেক মানুষই জানেন। আচ্ছা এতো গেল গল্প,সিনেমার কথা কিন্তু বাস্তব জীবনে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এর সত্যি ঘটনা কতজন জানেন? আপনারা হয়ত শুনে থাকবেন পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের একটি করে নিজস্ব টপ সিক্রেট গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আছে, যার কার্যকালাপ, কর্মচারীর সংখ্যা সহ সমস্ত সবই খুব গোপনীয়। আজ তেমনই একটি দেশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এর কথা আলোচনা করব।

আজ এমন এক সংস্থার কথা আলোচনা করব যারা নিজের দায়িত্বে ইরানের পরমানু প্রজেক্ট ধ্বংস করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ু যুদ্ধের সময়। এই সংস্থাটি এমন এমন কাজ করে দেখিয়েছে যা বিশ্বের বড় বড় দেশের গোয়েন্দা সংস্থা গুলো করে দেখাতে পারে নি। লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যানস আজ আমরা আলোচনা করব পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ ও ভারতের সবচেয়ে বড় বন্ধু দেশ ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা “মোসাদ” সম্পর্কে। এই সংস্থার কাজকর্ম যতটা ভয়ানক ততটাই রহস্যময়। মোসাদের সফলতার হার প্রায় ৯৯% এবং মোসাদের এত এত সফলতার গল্প আছে যে পুরো একটা মহাকাব্য লেখা হয়ে যাবে। বলা হয়ে থাকে মোসাদের টার্গেট লিস্টে যদি কেউ একবার এসে যায় তাহলে তাকে তারপর শুধু একমাত্র ভগবানই বাচাতে পারে। মোসাদ তাদের শত্রুদের সে তারা পৃথিবীর যেকোন দেশেই লুকিয়ে থাকুক না কেন সেখানে গিয়ে মেরে আসে। মোসাদের থিওরি হচ্ছে “কিল এন্ড ফ্লি” মানে শত্রুকে খতম করে পুরো অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। মোসাদ কে কিল মেশিন,  ম্যাসেন্জার অফ ডেথ বা মৃত্যুর দূত ও বলা হয়। আজকে আমরা আলোচনা করব কেন মোসাদের মত এজেন্সির দরকার পড়ল ইসরায়েলের, মোসাদের ইতিহাস ও কিছু সফল অভিযান সম্পর্কে। 

মোসাদ সম্পর্কে জানার আগে প্রথমে আপনাকে ইসরায়েল তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট একটি দেশ ইসরায়েল জনসংখ্যা মাত্র ৯৫ লাখের মতন। কিন্তু হলে কী হবে এইটুকু দেশের সামনে ভয়ে কাপে মধ্যপ্রাচ্যের বাকী দেশ গুলো। ইসরায়েল মূলত ইহুদী ধর্মালম্বীদের দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বহু ইহুদীদের নৃশংস ভাবে হত্যা করে, তারপরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ইহুদীরা নিজেদের জন্য একটি নিজস্ব দেশ তৈরির পরিকল্পনা করে। সেইমত ১৯৪৮ সালে তৈরি হয় ইসরায়েল নামক দেশটি। কিন্ত আশেপাশের সমস্ত আরব দেশগুলি মেনে নিতে পারেনি। ইসরায়েলের আশেপাশের দেশগুলো সিরিয়া, ইরাক, জর্ডন, লেবানন, মিশর একযোগে বারবার আক্রমণ করে ইসরায়েল করে। ১৯৪৮-২০০৬ পর্যন্ত আরবদেশ গুলো ও ইসরায়েলের মধ্যে ৬ টি যুদ্ধ হয়েছে, প্রত্যেকবার ইসরায়েল আরবদেশ গুলো কে লজ্জাজনক ভাবে হারিয়েছে। আরব দেশ গুলোর সাথে ইসরায়েলের প্রধানত যুদ্ধের কারন ধর্ম, যার জন্য এত অশান্তি। ইহুদীরা প্রধানত শান্তিপ্রিয়, বুদ্ধিমান জাতি তাদের সামনে মরুভূমির আরবরা টিকতেই পারে নি। এতবার হারার পর এখন মোটামুটি বুঝতে পেরেছে তাদের দ্বারা আর হবে না, সেই জন্য তারা মোটামুটি ইসরায়েল কে বন্ধু হিসাবে মেনে নিয়েছে। ইসরায়েল কে বলা হয় “দি লায়ন অফ মিডলইস্ট” বা মধ্যপ্রাচ্যের সিংহ। 

আজ থেকে ৭২ বছর আগে ১৯৪৯ সালে ১৩ ডিসেম্বর মোসাদ তৈরি হয়, ততকালীন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরুন। তখন এর নাম ছিল “সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউশন ফর কো-অর্ডিনেশন” ছিল। ১৯৫১ সালে এর নাম মোসাদ হয়, যা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। সত্যি কথা বলতে মোসাদ তৈরির কাজ ইসরায়েলের আগেই শুরু হয়। ১৯৩০-৪০ সালে হিটলারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বিভিন্ন ইহুদী গ্রুপ মিলে এক একটি ছোট খাটো সেনাবাহিনী তৈরি করে। এমনই একটি সংস্থা “হাগানা”, এই সংস্থাটির গুপ্তচর সংস্থার নাম ছিল  “সাহি”. মোসাদ তৈরি তে এদেরই অবদান ছিল, বলাভাল সাহির লোকজনই মোসাদে কাজ করত। ইসরায়েলের সিকিউরিটি এর জন্য এই সংস্থা তৈরি করা হয়। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর গুপ্তচর সংস্থা “আমান” ও আভ্যন্তরীণ সিকিউরিটি এজেন্সি “সীন বেটের” মধ্যে  সমন্বয় করারও আরেকটি কারন মোসাদ তৈরির। মোসাদের হেড কোয়ার্টার তেল আভিভ। মোসাদের একটি অংশের নাম হচ্ছে “মেটসাদা”, মূলত শত্রু কে হত্যা করার দায়িত্ব এদেরকেই দেওয়া হয়। মোসাদের আর একটি রহস্যময় ইউনিট “কিডন” এদের সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না এতটাই গোপন। এমনিতেও মোসাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না, টপ সিক্রেট সংস্থা। মোসাদের বার্ষিক বাজেট ২.৭৩ বিলিয়ন ডলার বা ১৭,০০০ কোটি টাকা। মোসাদের বর্তমান ডিরেক্টর ইয়োসি কোহেন।

মোসাদ তাদের ইতিহাসে ৭৩ টি গোপন অপারেশন করেছে

** অপারেশন থান্ডারবোল্ট —- সময়টা ১৯৭৬ সালের ২৬ জুন, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে একটি বিমান গ্রীসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গ্রীসের এথেন্স থেকে পপুলার ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন নামক একটি টেরোরিস্ট গ্রুপের ৪ জন সদস্য বিমনাটিকে হাইজ্যাক করে নেয়। বিমানে ইসরায়েলের ৯৪ জন নাগরিক ছিল। এরপর তারা বিমানটিকে লিবিয়া নিয়ে যায় সেখানে ফুয়েল ভরার পর হাইজ্যাকাররা বিমানটিকে উগান্ডার অ্যান্টাবে এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়। হাইজ্যাকারা উগান্ডায় নিয়ে গেছিল বিমানটিকে কারন উগান্ডা ইসরায়েল থেকে ৪০০০ কিমি দূরে ছিল এবং উগাণ্ডার সামরিক শাসক ইতি আমিন ইসরায়েল বিরোধী ছিল। হাইজ্যাকাররা ইসরায়েলের নাগরিকদের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপন দাবি করে এবং নিজেদের কিছু সাথী কে মুক্তি দিতে নির্দেশ দেয় ইসরায়েল কে। কিন্তু মোসাদ কেন টেরোরিস্টদের সাথে আলোচনা করে না, মোসাদ নিজেদের স্পেশাল অপারেশন করে মাত্র ৯০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত যাত্রী কে মুক্ত করে তারা। এরপরেই গোটা বিশ্বে মোসাদের নাম আরও ছড়িয়ে পড়ে। 

** অপারেশন ডায়মন্ড:—- ১৯৬০ এর দিকে আকাশে রীতিমতো রাজত্ব করত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ বিমান,  ততকালীন সময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী এই বিমানকে আমেরিকা ও ভয় খেত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা সংস্থা আমেরিকার সিআইএ বহুবার চেষ্টা করেও এই বিমান চুরি করতে পারে নি। আমেরিকার লক্ষ্য ছিল কোনও রকমে একটি মিগ-২১ চুরি করে এনে বিমান সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করা। আমেরিকা অসফল হবার পর মোসাদ কে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। মোসাদ নিজেও দুবার ব্যার্থ হয়, অবশেষে ১৯৬৪ সালে মোসাদের একজন মহিলা এজেন্ট ইরাক এয়ারফোর্স এর একজন পাইলট কে প্রেমের জালে ফাঁসায়, প্রেমের মোহে ও টাকার লোভে ইরাকের সেই পাইলট একটি মিগ-২১ ইসরায়েলে নিয়ে আসে। এটাই অপারেশন ডায়মন্ড। 

** অপারেশন ওয়ার্থ অফ গড:—- ১৯৭২ সালে জার্মানি তে মিউনিখে অলিম্পিকেট আয়োজন করা হয়েছিল। সমস্ত দেশের মত ইসরায়েল থেকেও খেলোয়াড়রা এসে এখানে যোগ দিয়েছিল কিন্তু প্যালেস্টাইন এর এক টেরোরিস্ট সংস্থা “ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর” ইসরায়েলের ১১ জন খেলোয়াড় কে হত্যা করে। এই ঘটনা ইতিহাসে “মিউনিখ ম্যাসাকার” নামে পরিচিত। এরপর মোসাদ এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকা বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে থাকা অপরাধীদের খুজে খুজে হত্যা করে ২০ বছর ধরে।

** এই ঘটনা একদম এখনকার। ইরানের রাজধানী তেহরানের রাস্তায় দিনের বেলায় ইরানের এক নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট মোসেন ফাহরিজাদে কে গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। মোসেন ফাহরিজাদে কে ইরানের পরমাণু পোগ্রামের জনক বলা হত। এত  বড় ভিআইপি ব্যক্তিকে নিজের দেশের রাজধানী তে ভর দুপুরে সবার সামনে হত্যা করে কিছু অজানা ব্যাক্তি, যদিও মোসাদ এই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি তবুও সবাই জানে এটা মোসাদেরই কাজ বিশেষজ্ঞদের মতে।

** হিটলারের ইহুদি নিধনের সহযোগী অ্যাডলফ আইখম্যান কে মোসাদ আর্জেন্টিনা থেকে তুলে এনে ইসরায়েলে এসে হত্যা করে। মোসাদের এই অপারেশনের ব্যাপারে আর্জেন্টিনা জানতেও পারেনি।

** ইসরায়েল ও আরবদেশ গুলোর মধ্যে ৬ বার যুদ্ধ হয়েছিল প্রতিটি যুদ্ধে মোসাদের বুদ্ধিমত্তার কাছে শোচনীয় পরাস্ত হয়েছিল আরবদেশ গুলো।

** এছাড়াও ইসরায়েল সিরিয়া, ইরানে নিয়মিত এয়ারস্ট্রাইক করে, সাইবার অ্যাটাক করে যায়। 

ভারতের মিজোরাম রাজ্যটির সমান একটি দেশ অ্যাডভান্সড হাইলি অ্যাডভান্সড ওয়েপনস এর সাহায্যে কীভাবে শত্রুদের বুকে কাপ ধরিয়ে দেয় তা দেখার মতন। একটা ডাটা অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মোসাদ বাকী সব দেশের সিক্রেট সার্ভিসের তুলনায় বেশী হত্যা করেছে। মোসাদ শত্রু কোন স্টেপ নেবার আগেই তাদের গিয়ে হত্যা করে সে জন্য মোসাদ কোনও আইনের ধার ধারে না। এখন আরব দেশগুলো বুঝতে পেরেছে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ করে লাভ নেই,  সেইজন্য সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, ওমান, মিশর এখন ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আক্ষরিক অর্থে সুপার পাওয়ার ইসরায়েল, যার জন্য মোসাদের অবদান অনস্বীকার্য। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *