ডিফেন্স

রাশিয়া ১টাকার জিনিস বেচে ১০টাকার স্পেয়ার পার্টসের দাম চাপায়। আমেরিকা ৭টাকার জিনিসে ১টাকার স্পেয়ার পার্টস লাগে। জানুন বিস্তারিত

নিজস্ব সংবাদদাতা:বিশ্ব রাজনীতিতে কেউ কারোর বন্ধু নয়। এক সময় ভারত রাশিয়ার খুব কাছের বন্ধু ছিল ঠিকই তবে, কালের নিয়মে ক্ষয় ধরেছে সেই বন্ধুত্ব। ভারত যে এখন রুশ যোগ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্টের ছত্রছায়ায় থাকতেই বেশি পছন্দ করে তার একমাত্র কারণ হলো ভারতের নিজের স্বার্থ। কিন্তু, কূটনীতি যে আবেগ দিয়ে চলে না সেটা ভুলে যাচ্ছেন অনেকেই। বর্তমানে রাশিয়া ছেড়ে ভারতের আমেরিকা প্রীতি দেশের অভ্যন্তরে ও অনেকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না। কিন্তু, মাথায় রাখতে হবে কূটনীতির জগতে কোনো বন্ধুত্বই চিরকালীন নয়। দেশের প্রয়োজনে নতুন বন্ধু যেমন বানাতে হয় তেমন মাঝে মাঝে কিছু বন্ধুত্ব খানিকটা ছাটতেও হয়। 

রুশ বনাম আমেরিকার কথা উঠলেই কিছু কিছু মানুষ সবার আগে তোলে ১৯৭১সালের কথা। সেক্ষেত্রে প্রধান দাবি হয়, আমেরিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে রাশিয়া সেই সময় ভারতকে সাহায্য করেছিল। কথাটা সত্য হলেও এই যুক্তিতে রয়েছে বেশ কিছু ত্রুটি। প্রথমত, সেই সময় যে দেশ সাহায্য করেছিল আমাদের সেটা রাশিয়া ছিল না, ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমানের রাশিয়ার মধ্যে যে আকাশ পাতালের পার্থক্য রয়েছে তা আলাদা করে বলে দেওয়ার নিশ্চয় প্রয়োজন পড়ে না।

দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত যে কেবল বন্ধুত্বের খাতিরে ভারতকে সাহায্য করেছিল তা কিন্তু নয়। এর পেছনে কাজ করেছে সোভিয়েতের নিজস্ব স্বার্থও। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল যাতে এর প্রতিদানে ভারত তাদের স্ট্যটেজিক অ্যালায়েন্সকে সাহায্য করে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকার একাধিপত্য রোধ করাই ছিলো সেই সময় সোভিয়েত এর মূল লক্ষ্য। 

কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে বদলেছে বিশ্ব রাজনীতি। বদলেছে মার্কিন ও রুশ বন্ধু শত্রু ও। তাছাড়া পুরনো রুশ প্রীতি মনে গেঁথে রেখে হা হতাশ করারও আর মানে হয় না কোনো। ভুলে গেলে চলবে না এই রাশিয়াই রাষ্ট্রসঙ্ঘে কাশ্মীর রেজোলিউশান এনেছিল। বার বার তালিবানদের সাথে আলোচনার সময় রাশিয়া যখন ভারতকে বের করে দিয়েছিলো তখন আমেরিকাই পুনরায় ভারতকে সেই টেবিলে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলো। 

ভারত চীনের বিরোধ সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া নির্দ্বিধায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অস্ত্র এস-৪০০, সু-৩৫ চীনকে বিক্রি করেছে।  এক্ষেত্রে আরেকটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন। ভারত আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র আমদানি করার অনেক আগে থেকেই কিন্তু রুশ চীনকে অস্ত্র সাহায্য করে আসছে। এছাড়া রাশিয়া পাকিস্তানকেও রুশ মি-৩৫ হেলিকপটার দিয়ে সাহায্য করেছে। ভারতের অনুরোধে আমল না দিয়ে রাশিয়া রুশ জেএফ-১৭ এর ইঞ্জিন আরডি-৩৩ পাকিস্তানকে সরবরাহ করেছিল এক সময়।

বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটের কথা মাথায় রেখে পুরনো আবেগ সরিয়ে রুশ প্রীতি বাদ দেওয়ার সময় এসেছে এখন। এক সময় রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত অফুরন্ত সাহায্য পেলেও এখন ঘটনা পাল্টে গেছে অনেকটাই। সাহায্য আসছে এবার আমেরিকা থেকে। ভারতের কথা মাথায় রেখে আমেরিকা বর্তমানে পাকিস্তানকে ঢেলে সাহায্য করা কমিয়েছে অনেকটাই। এমনকি ভারতের কথা অনুযায়ী মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ঘোষনা করতেও অনেক সাহায্য করেছিল আমেরিকা। আজ পাকিস্তান যে FATF এর ধূসর তালিকা আছে তার কৃতিত্বও অনেকটাই আমেরিকার।

হ্যাঁ। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, হঠাৎ ভারতের সাহায্যে এত নিঃস্বার্থ ভাবে কেনো এগিয়ে আসছে আমেরিকা? তাদের কি নিজস্ব কোনো স্বার্থ নেই? উত্তর হলো অবশ্যই আমেরিকার নিজস্ব স্বার্থ কাজ করছে এখানে। আগে রুশ পাকিস্তানের শত্রু ছিল। রাশিয়াকে আফগানিস্তান থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল তালিবান। কিন্তু, এখন পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক অনেকটাই ঠিক। আবার আজ যেই চীনকে অত্যাধুনিক ব্যলিস্টিক মিসাইল ট্র্যকিং রেডার দিচ্ছে রাশিয়া সেই রাশিয়ার সাথেই আগে ছিল চীনের তীব্র ঝামেলা। ভারতের মতোই এই চিন ও রাশিয়া বন্ধুত্ব উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে আমেরিকারও। ভারতীয় উপমাদেশে চীনের প্রভাব রুখতেই এখন আমেরিকা পাশে চায় ভারতকে।

এত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের আমেরিকার সাথে জোট বাঁধা টা কি খুব একটা ভুলের? একদিকে রাশিয়া চীনের সম্পর্ক যেখানে জোরদার হচ্ছে সেখানে অপরদিকে চীনের সাথে ভারতের মধ্যে চলছে রাজনৈতিক চড়ান উৎরান। এই অবস্থায় ভারত আমেরিকার সাথে সম্পর্ক না রেখে শুধু রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হলে তা জাতীয় সুরক্ষকেও প্রশ্নের মুখে ফেলত। ভারত চীনের যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া কি আদেও চীনের বিপক্ষে গিয়ে ভারত কে সাহায্য করতো?

এছাড়া রয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়ার সামরিক অস্ত্রের গুনমানের তফাৎ। রোলস্ রয়েস বা জেনারেল ইলেকট্রিক এর মত কোম্পানির তৈরি ইঞ্জিনের TBO বা টাইম বিটুইন ওভার হলিং যেখানে ৪০০০ ঘন্টা প্রর্যন্ত হয় সেখানে একটি রুশ ইঞ্জিনের টাইম বিটুইন ওভারহলিং কত জানেন? সামরিক অস্ত্র নিয়ে সামান্য নাড়াঘাটা আছে এমন যেকোনো মানুষ জানেন রুশ অস্ত্রের গুণমান ঠিক কতটা খারাপ।ভারত সু-৩০ এর লাইসেন্স প্রোডাক্সান করে তা সত্ত্বেও অনেক সময় সুখোই এর ফ্লিট অপরেশেনাল রেট মালয়শিয়া ও ভিয়েতনামে তৈরি স্পেয়ার পার্টস এর অভাবে নেমে আসে ৬০শতাংশে।

অপরদিকে, ভারতের থেকে প্রযুক্তিতে অনেকাংশে পিছিয়ে থাকা প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান আমেরিকা থেকে সাহায্য না পেয়েও স্পেয়ার পার্টসের এত অভাব সত্ত্বেও কিভাবে নিজেদের এফ-১৬ সচল রেখেছে, ভেবেছেন কখনো? আর কেনোই বা ২৭শে ফেব্রুয়ারি এফ-১৬ কে ফ্রন্ট লাইনে রেখে জেএফ-১৭ কে কেন এয়ার ডিফেন্স রোলে রাখে পাকিস্তান ভেবেছেন? ভারতই বা কেন বালাকোটে সুখোই না পাঠিয়ে সিঙ্গল ইঞ্জিন মিরাজ পাঠিয়েছিল?

রাশিয়ান অস্ত্রের মান এখন এখন খুবই জঘন্য আর এটাই কঠোর বাস্তব। রুশ অস্ত্র খাতায় কলমে সস্তা ঠিকই কিন্তু সমস্যা হল রাশিয়া ১টাকার জিনিস বেচে তার সাথে ১০টাকার স্পেয়ার পার্টসের দাম চাপায়। অপরদিকে আমেরিকা সহ পশ্চিমি দেশগুলির বিক্রি করা ৭টাকার জিনিসে ১টাকার স্পেয়ার পার্টস লাগে। সেই সঙ্গে রাশিয়ান যুদ্ধবিমানের খেয়াল রাখা ও অত্যন্ত কঠিন ও ব্যয়সাধ্য।  তবে, আজ রাশিয়ান অস্ত্রের গুণগত মান নিয়ে আলোচনা করতে বসা হয়নি । সহজ ব্যাপার হলো সময়ের সাথে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দরকারে পাল্টাতে হবে বন্ধু।এটাই বিশ্ব রাজনীতির নিয়ম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *