সাবমেরিনের মধ্যেই ছিল সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম, ইনডোর খেলার জায়গা। কোন দেশের হাতে?
নিউজ ডেস্কঃ আধুনিক যুদ্ধে সাবমেরিন যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে তা সকলেরই জানা। কারন জলের তলায় কি হচ্ছে তা বলা খুব মুশকিল। পাশাপাশি এখনও পর্যন্ত জলের তলায় কত ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েগেছে তা এখনও পর্যন্ত প্রচুর মানুষের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। তার প্রধান কারন জলের তলায় গোপন অপারেশানে থাকে এই সাবমেরিন গুলি।
১৯৭১ এ ভারত-পাক যুদ্ধে সাবমেরিনের গুরুত্ত্ব সকলেরই জানা। শুধু তাই নয় প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আটলান্টিক জুড়ে ব্রিটিশ ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলির সাথে জার্মান সাবমেরিনের ভয়াবহ যুদ্ধগুলোর কথা অনেকেই মনে রেখেছেন। কাজেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই পরাশক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সাবমেরিনের পেছনে মরিয়া হয়ে টাকা ঢালবে তা বলাই বাহুল্য।
পৃথিবীতে বিভিন্ন গোত্রের সাবমেরিন দেখা যায়। এবং এক একটি সাবমেরিন এক একটি বিশেষ কারনের জন্য বিখ্যাত। তবে পৃথিবীতে বিশালাকার সাবমেরিন গুলির দাপট দেখে অনেকেই হতভম্ব হয়ে যায়। আকুলা নামের বিশালকায় এক সাবমেরিন। সোভিয়েত নৌবিদ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ এই নিদর্শন, যা আশি এবং নব্বইয়ের দশকে সমুদ্র রাজত্ব করে বেড়িয়েছে। বলে রাখা ভালো, আকুলা ক্লাস হিসেবে যে সাবমেরিনের কথা এখানে বলা হচ্ছে তার পোশাকী নাম প্রজেক্ট ৯৪১। আমেরিকানরা এই সাবমেরিনগুলিকে ‘টাইফুন ক্লাস’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকে। মূলত বিভিন্ন দেশে নৌযানের প্রকারভেদ করার ধরনে ভিন্নতা থাকার কারণেই নামের ক্ষেত্রে এ ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।
১৯৫০ এবং ১৯৬০ র দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা ব্যালিস্টিক মিসাইল বহন করতে সক্ষম এমন সাবমেরিন তৈরি করতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিল পরমাণু বোমা। সোভিয়েত ও মার্কিন কর্তারা ভাবতেন প্রতিপক্ষ সর্বদা কোনো ছুতোয় তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে, তাই হাতের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র থাকা প্রয়োজন। পরমাণু বোমার মতো বিদ্ধংসী অস্ত্রের হটাৎ হামলার শিকার হলে পাল্টা হামলা চালানোর জন্য অস্ত্র মজুত রাখাও খুব দরকার। এবং এই কাজের জন্য ডুবোজাহাজ বেশ উপযুক্ত। বিশেষ করে উত্তর মেরুর হীমশীতল বরফের নিচে ঘাপটি মেরে থাকা ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন যে মারাত্মক এবং ভয়ংকর নাম, তা দুই দেশই জানতো বেশ ভালো করে।
এসব সাবমেরিন যেহেতু বহুদিন জলের নিচে থাকে, তাই তাদের জ্বালানীও লাগে প্রচুর। তাই সাবমেরিন গুলিতে পরমাণু চুল্লী বসানো শুরু করা হলো। প্রথমাবস্থায় সফল হয় আমেরিকা। তাদের নটিলাস সাবমেরিন একবারে প্রায় ১৫ দিন জলের নীচে থাকতে পারতো। পরমাণু চুল্লীতে জ্বালানী লাগে খুবই সামান্য। ফুয়েল রডগুলো তেজষ্ক্রিয়তার কারণে প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়। উত্তপ্ত রডে জল ঢালা হলে তৈরি হয় বিপুল পরিমাণ বাষ্প। এই বাষ্পকেই বিশেষভাবে ব্যবহার করে চালানো হতো এই ডুবোজাহাজ গুলি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সবথেকে সমস্যার কারন ছিল তাদের সাবমেরিন গুলির শব্দ। সোভিয়েত কে-১৯ বা নভেম্বর ক্লাস সাবমেরিনগুলো ছিল বেশ নিম্নমানের। এর শব্দের কারনে অ্যামেরিকান সাবমেরিন গুলি তাদের সনার সিস্টেমের সাহায্যে সহজেই ধরে ফেলত সাবমেরিন গুলির অবস্থান।
১৯৭০। আমেরিকা ওহায়ো ক্লাস সাবমেরিন সার্ভিসে আনবে। এমনবস্থায় সাড়ে পাঁচশো ফুট লম্বা এই সাবমেরিনগুলো ছিল তখনকার দিনের বৃহত্তম সাবমেরিন। একনাগাড়ে জলের নীচে ২৪টি পরমাণু বোমাবাহী ট্রাইডেন্ট মিসাইল (পাল্লা প্রায় ৪,৬০০ মাইল) নিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াতে পারতো এই সাবমেরিনগুলো। এরই পাল্টা জবাব হিসেবে সত্তরের দশকেই এক বক্তৃতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান লিওনিড ব্রেজনেভ ঘোষণা করেন যে, খুব শীঘ্রই সোভিয়েত বিরাট এক পরমাণু বোমাবাহী নিউক্লিয়ার ইঞ্জিন সম্পন্ন সাবমেরিন তৈরি করতে চলেছে।
ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৮১ সালে জলে নামে আকুলা। রুশ ভাষায় এর অর্থ হাঙ্গর। মার্কিন ও ইউরোপীয়রা রীতিমত হতভম্ব হয়ে পড়ে, কারণ তাদের ধারণা ছিল এই ধরনের অত্যাধুনিক সাবমেরিন তৈরি করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরও এক দশক সময় লেগে যাবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌসীমা ছিল বিশালাকার। সেই কারনেই তাদের দরকার ছিল এক বিরাট আকারের সাবমেরিন। পাশাপাশি সোভিয়েতদের পরমাণু বোমাবাহী ব্যালিস্টিক মিসাইল আর-৩৯ এর ভর ছিল অনেক বেশি। ৫৭৪ ফুট লম্বা এই সাবমেরিনের ভর হলো ৪৮ হাজার টন। ২২ নট গতিসম্পন্ন আকুলা ছিল সে সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগামী সাবমেরিনগুলির মধ্যে একটি। জলের তলায় ডুবন্ত অবস্থায় এরা ২৭ নট গতিবেগে চলার ক্ষমতা ছিল।
জাপানি সাবমেরিনের মতো আকুলার দেহও কয়েক প্রস্থ আবরণ একটির ওপর আরেকটি দিয়ে বানানো হত। এবং এর প্রধান সুবিধা হল বাইরের আবরণটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও গোটা সাবমেরিন অচল হয়ে পড়ে না। আর সেই কারন বশত সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো অপেক্ষাকৃত চওড়া হতো। আকুলার সামনের মজবুত অংশ উত্তর মেরুর শীতল বরফ ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল।
আকুলাতে বসানো দুটি পরমাণু চুল্লী। যার প্রত্যেকটি ২ লক্ষ ৫৫ হাজার হর্স পাওয়ার শক্তি উৎপাদন করতো। এই পরিমাণ শক্তি দিয়ে ছোটখাট একটা শহরের বিদ্যুতের প্রয়োজন খুব সহজেই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। চার মাস অর্থাৎ ১২০ দিন ধরে অন্তত ১৫০ জন মানুষ আরাম আয়েশ করে থাকতে পারতো এখানে। ছিল বিশেষ সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম, ইনডোর খেলার জায়গা। এই সাবমেরিন ছিল সাগরের তলায় এক চলন্ত সামরিক ঘাঁটি। ১০টি ১০০ কিলোটন পরমাণু বোম (প্রত্যেকটি বোম হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত লিটল বয়-এর তুলনায় ছয়গুণ বেশি শক্তিশালী) এছাড়াও বহন করতে পারতো এই সাবমেরিনের আর-৩৯ মিসাইলগুলিকেও।
একেকটি আর-৩৯ মিসাইল লম্বায় ৫৩ ফুট, ওজনে ৮৪ টন। যার খুব সহজেই পার করতে পারতো ৮,৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব। অর্থাৎ আর-৩৯ মিসাইল উত্তর মেরুর যেকোনো অঞ্চল থেকে মূল মার্কিন ভূখন্ডে খুব সহজেই আক্রমণ করতে পারবে।
একইসাথে ২০টি মিসাইল মজুত করে রাখা থাকত একেকটি আকুলা সাবমেরিনে। এর বাইরেও থাকতো একাধিক টর্পেডো মিসাইল। প্রয়োজনে এতে বিমান বিধ্বংসী মিসাইলও বসানোর ব্যবস্থা ছিল। আকুলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এগুলি অন্য সোভিয়েত সাবমেরিনের তুলনায় বেশ উন্নত এবং নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারতো। সর্বশেষে বলা যায় ১৯৮০ র দিকে শ্রেষ্ঠ সাবমেরিন ছিল এই আকুলা ক্লাসের বিরাট ডুবোজাহাজ গুলি।