বিনোদন

চিরস্মরণীয় থাকার মত নাট্যধারা” ডেস্টিনেশন থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল

সায়ন ঘটক মুখোপাধ্যায়ঃ বেঙ্গল রেপার্টরি হাওড়ার আয়োজনে খুবই সম্প্রতি  বীরভূম সাতকানিয়ার তেপান্তর নাট্যগ্রামে অনুষ্ঠিত হলো নাট্যধারা নাট্যোৎসব। এখানে উল্লেখ্য তেপান্তর নাট্যগ্রামের প্রত্যেক সদস্য সে যে বয়সেরই হোক না কেন নিজেদের জীবন-জীবিকার পাশাপাশি কোন না কোনভাবে নাটকের সঙ্গে যুক্ত। ফলে একদম কচিকাঁচা থেকে প্রবীণ মানুষজন প্রত্যেকেই নাট্যপ্রেমী এই গ্রামে। ভাবতে অবাক লাগলেও তেপান্তর গ্রামের মৌলিকতা এখানেই। সেই নাট্যগ্রামেররই মধ্যে অবস্থিত সুবিশাল নাট্যচর্চা কেন্দ্র, আর সেখানেই অনুষ্ঠিত হলো এই নাট্য উৎসবটি। উদ্বোধনে বেঙ্গল রেপার্টরির সদস্যবৃন্দের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন প্রবীর গুহ, পিয়াল ভট্টাচার্য্যের মত স্বনামধন্য নাট্যব্যক্তিত্বরা। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শ্রী ইন্দরজিৎ গ্রোভার, ডিরেক্টর, নর্থ সেন্ট্রাল জোন কালচারাল সেন্টার ও তার স্ত্রী প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী শ্রীমতি কবিতা ঠাকুরের উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য। ঋতুশ্রী চৌধুরীর নৃত্য, সংলাপ, কবিতা সহ জয় দীপ সিনহা ও শুভাশীষ সরকারের কন্ঠগীতি ও বাদ্যের সংমিশ্রণে উপস্থাপিত সুন্দর একটি উদ্বোধনী নৃত্যনাটিকার মধ্যে দিয়ে নাট্যোৎসবটির সূচনা হয়। বৈচিত্র্যময় এই নাট্য উৎসবে বেশ কয়েকটি  ভিন্ন রকম নাটকের সম্ভার ছিল।

প্রথমে ছিল নাটক ‘পদ্মপ্রভৃতকম’। প্রাচীন নাট্যশাস্ত্রের সমসাময়িক সময়কালের অপর নির্মিত। সায়ক মিত্রর লেখা স্ক্রিপ্ট আর পিয়াল ভট্টাচার্যের নান্দনিক পরিচালনায় উপস্থাপিত এই নাটকটি দর্শককে গুপ্ত যুগের উজ্জয়নী নগরে নিয়ে যায়। সেখানে পাটলিপুত্রের রাজা মুলদেব তার বিট (বিনোদনকারী) -কে নিজের প্রেমের স্মারক দিয়ে দূত হিসেবে তার প্রেমিকা দেবসেনার কাছে উজ্জয়িনীতে পাঠায়। সেই বিটের যাত্রাপথের অভিজ্ঞতাকে ঘিরেই নাটকটি গঠিত হয়েছে। এই নাটকে তৎকালীন মানুষের জীবনযাত্রা ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার এক সুন্দর প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। সেকালের বিভিন্ন স্তরের নারী ও পুরুষদের সঙ্গে বর্তমান নারী-পুরুষদের অবস্থানগত পার্থক্যটা উপলব্ধি করা যায়। এই বিশেষ ধরনের নাটকের একটি বিশেষত্ব হল এখানের উপস্থাপক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বিট চরিত্রটিই অন্যান্য চরিত্রগুলোও অভিনয় করে। যাত্রাপথে দেখা হওয়া মানুষজন তাদের জীবনকথন ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয় মঞ্চে। নাটকটির মূল ভাষা সংস্কৃত, এছাড়া পুরানো হিন্দি, ব্রজবুলি প্রভৃতি ভাষার সুন্দর ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু সংস্কৃত, প্রচলিত ভাষা না হওয়ার কারণে সব অংশগুলোর রস আস্বাদন করা দর্শকদের পক্ষে বেশ কঠিন। নির্মাতা পিয়াল ভট্টাচার্য্য ও সায়ক মিত্রর কথা অনুযায়ী এই সংস্কৃত শব্দের অনুবাদ করতে গেলে নাটকটির ভাষার স্থূলতা এড়ানো সম্ভব হবে না। তাই সংস্কৃত ব্যতিরেকে অন্য ভাষায় এই নাটক মঞ্চস্থ করা অসম্ভব। কিছু অংশে ভাষা অন্তরায় হলেও মনমুগ্ধকর মঞ্চসজ্জা, মঞ্চের পেছনে সারি বেঁধে যন্ত্রানুষঙ্গ, কখনো তারাই আবার পার্শ্বচরিত্র। অপূর্ব সঙ্গীত আর আলোর প্রক্ষেপণ সেই সঙ্গে পোশাক পরিকল্পনা, অভিনয়, সবটা মিলিয়ে মনটা ভরিয়ে দেয়।

পরবর্তী নাটকটি একেবারে অন্যধারার। বাংলার লোকশিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পুতুল নাচ। প্রচলিত গল্প অথবা পৌরাণিক কাহিনী কিংবা কোন ঐতিহাসিক ঘটনা এই পুতুল নাচের মাধ্যমে উপস্থাপিত করা হতো। এই বঙ্গ, রাঢ় অঞ্চলে এই পুতুল নাচের আসর ছিল অন্যতম জনপ্রিয় লোকশিল্প। সেই লোকশিল্প বর্তমানে অবলুপ্তির পথে। এই পুতুলনাচের আঙ্গিকে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী লাভপুর নির্মাণ করেছে তাদের নাটক বেহুলা লখিন্দর পালা। মূল কাহিনী মনসামঙ্গল। নাটক শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই সংগীত ও নেপথ্যকথন দর্শকের সামনে পুতুলনাচের আবহের সৃষ্টি করে। নাটকটির প্রত্যেকটি চরিত্র মঞ্চে আসে পুতুল হয়ে। অভিব্যক্তিহীন অভিনয়ের মাধ্যমে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে পুতুলগুলো। অভিনয়ের নজরকাড়া দক্ষতায় পুতুলের নড়াচড়া ও সেইসাথে নেপথ্যের সংলাপ পাঠের সুন্দর সামঞ্জস্য আর লাইভ মিউজিকের সঙ্গে আলোর ব্যবহার এককথায় অনবদ্য। নির্দেশক উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় ও নৃত্য নির্দেশক অন্বেষা ঘোষ যথার্থই প্রশংসার দাবি রাখে।

সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী আরেকটি নাটক, ঘরে ফেরার গান। নির্মাতা প্রবীর গুহর মতে, এই নাটকটি কয়েকটি মানুষের জীবনের ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু গল্প। নাটকটি দেখতে দেখতে সে কথা বারবার মনে পড়ে। স্বাধীনতা, দেশভাগ এবং পরবর্তীতে অনাহার, দাঙ্গা, রাজনীতি, শিল্পায়ন, বিশ্বায়ন প্রভৃতি কারণে দরিদ্র সাধারণ মানুষ ক্রমাগত বাস্তুহারা সর্বহারা হচ্ছে। সেই বিভিন্ন প্রান্তের বাস্তহারা সর্বহারা মানুষদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা যা ঘটে চলে মানুষগুলোর ওপর তাই নিয়েই তৈরি নাটকটা। কিভাবে প্রতিকূলতা তাদের আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে কিভাবে সেই পরিস্থিতি পেরিয়ে তারা এগিয়ে চলে। সব সময়ের জন্য প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মান বাঁচানো যাদের কাছে বিলাসিতা সেইসব মানুষগুলোর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু স্বাভাবিক ঘটনার টুকরো দিয়ে তৈরি একটা সুন্দর কোলাজ যা থেকে সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। যা প্রগতিশীল সাধারণ মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে। নাটকটির শৈল্পিক উপস্থাপনা লাইভ মিউজিকের ব্যবহার কলাকুশলীদের নজরকাড়া অভিনয় ঝকঝকে সংলাপ, আলোর ব্যবহার মনের মধ্যে নাটকটা দীর্ঘস্থায়ী একটা ছাপ ফেলে দেয় নিঃসন্দেহে।

বৈচিত্র্যময় নাট্য উৎসবের নাট্যসম্ভারের মধ্যে অন্যতম নাটক, ম্যাকবেথ- উপস্থাপনায ‘এবং আমরা়’। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটক ম্যাকবেথ অবলম্বনে এই নাটকটির রচনা। ম্যাকবেথ নামে এক সাহসী স্কটিশ জেনারেল একটি ভবিষ্যদ্বাণী পায় যে সে একদিন স্কটল্যান্ডের রাজা হবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষার বসে সে রাজা ডানকানকে হত্যা করে স্কটিশদের সিংহাসনটি দখল করে। রাজা হয়ে ম্যাকবেথ কেবল সন্দেহের বশে, শত্রু ভেবে নির্বিচারে আরো বেশকিছু খুন করে। এভাবেই সে ক্রমশই এক অত্যাচারী শাসক হয়ে উঠে। কিন্তু এত রক্তপাত, গৃহযুদ্ধ সেইসঙ্গে অপরাধবোধ, ম্যাকবেথ আর লেডি ম্যাকবেথকে উন্মাদ হয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। নাটকটির নাট্যরূপ ও পরিচালনায় কল্লোল ভট্টাচার্য়। নাটকের সংলাপ থেকে পোশাক পরিকল্পনায রয়েছে সমকালীন ছাপ়। আলোর প্রক্ষেপণও নজরকাড়া। কলাকুশলীদের সুন্দর অভিনয়ে সার্থক হয়েছে এই উপস্থাপনা। আরও একটি ভিন্নধর্মী প্রযোজনা, ‘তোমার ডাকে’। নাটকটির রচনা ও পরিচালনা শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইর জীবনের গল্প সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজ মূলক নাটক রক্তকরবী, বিসর্জন, মুক্তধারা, ডাকঘর প্রভৃতি নাটকের গল্প এখানে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। রাজতন্ত্রের আমল থেকে বর্তমান গণতন্ত্রের যুগেও নৃশংসতা, মৌলবাদ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম ও আন্দোলন চলছে। এই গল্পটিতে পাকিস্তানের তালিবানদের অত্যাচারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের রচিত নাটকের চরিত্রগুলি চিত্রিত করে তা বর্তমান সামাজিক প্রসঙ্গে নতুন রূপে হাজির হয়েছে।এখানে আরও দেখা যায় যে কিভাবে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ এবং বিশ্বাসঘাতকতা বিভিন্ন সামাজিক কাঠামোর উপর কেমনভাবে প্রচলিত রয়েছে। নারীরা আমাদের সামাজের কতটা ক্ষতিগ্রস্থ। সীতা-সাবিত্রীর যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান মালালার যুগে শুরু হওয়া দৃশ্যের কোনও পরিবর্তন নেই। তারা এখনও তাদের অধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে চলাই এই নাটকটির মূল বিষয়বস্তু। সুগঠিত সংলাপ অতি সুন্দর পোশাক ভাবনা সঙ্গীত আলো সেই সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পরিশীলিত অভিনয় মুগ্ধ করে আমাদের।

বেঙ্গল রেপার্টরির সম্পাদক ঋক অমৃতর উদ্যোগে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘ডেস্টিনেশণ থিয়েটার ফেসটিভ্যাল’ এই নাট্যধারা নাট্য উৎসবে  অনুষ্ঠিত প্রত্যেকটি নাটক নিজের স্বকীয়তার পরিচয় দেয়। প্রকৃতির কোলে ভিন্ন ধরনের ভাবনা, অপূর্ব উপস্থাপন শৈলী প্রত্যেকটি নাটককে আলাদা করে দর্শক মনে জায়গা করে নিতে সাহায্য করে। শিল্প যে মানব মনের তথা চিন্তার বিকাশে সাহায্য করে, এই নাট্যধারা নাট্যোৎসব তারই প্রকৃত উদাহরণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *