অ্যাভিয়েশনের ক্ষেত্রে বৈমানিকা শাস্ত্রতে যে ধরনের বিমান তৈরির কথা বলা আছে
আজ থেকে ১২০ বছর আগেও যখন মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিশেষ করে অন্য মহাদেশে যেত তখন যাতায়াত মাধ্যম হিসাবে সমুদ্রপথে জাহাজই প্রধান ভরসা ছিল। কয়েক মাস ধরে উত্তাল সমুদ্র অতিক্রম করে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে যাত্রা করতে হত। আকাশ পথে বিমানের মাধ্যমে অতি দ্রুত যাতায়াতের চিন্তাভাবনাও একটা সময় কেউই করতো না। কিন্তু ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে বিমান তৈরি হয় যা যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। শুধু যাত্রীই নয় এক দেশ থেকে অন্য দেশে দ্রুত কার্গো পরিবহনের ক্ষেত্রে বিমানের কোন বিকল্প নেই। আজ বিমান পরিবহন প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর গুরুত্বপূর্ন চালিকাশক্তি। বিশ্বের জিডিপিতে অ্যাভিয়েশন সেক্টরের ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অবদান রয়েছে। বিশ্বের সিভিল অ্যাভিয়েশন সেক্টরের তথ্য অনুযায়ী অ্যাভিয়েশন সেক্টর যদি একটি দেশ হত তাহলে তার বিশ্ব জিডিপিতে তার আয়তন ব্রিটেনের অর্থনীতির সমতুল্য হত। তবে বিমান তৈরি সহজে হয়নি, এর পেছনে রয়েছে অনেক বছরের নিরলস প্রচেষ্টা এবং ব্যর্থতার ইতিহাস। কিছু মানুষের হার না মানা মানসিকতাই মানব সমাজে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইতিহাস সৃষ্টি করে।
অ্যাভিয়েশনের ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো। মানুষের দ্বারা তৈরি প্রথম কোন জিনিস যা আকাশে ওড়ে তা হল ঘুড়ি। পঞ্চম শতকের দিকে ঘুড়ির প্রচলন প্রথম শুরু হয়। ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আকাশ পথে যাত্রার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ১২৫০ সালে রজার বেকন নামে এক গনিতজ্ঞ সর্বপ্রথম ধাতব বিমান সম্পর্কে তথ্য লেখেন। তিনিই প্রথম কোন ইউরোপীয়ান ব্যক্তি যিনি বিমান সম্পর্কে লিখেছেন। পনেরো শতকে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ফ্লাইং মেশিন বা বিমানের ছবি এঁকেছিলেন যা দেখে মানুষ কল্পনা করতে শুরু করে আকাশ পথে যাত্রার। ষোল শতক থেকে মানুষ বিমান তৈরির চেষ্টা শুরু করে। অনেক প্রচেষ্টার পরও কেউ সফল হয়নি সেসময়। এরপর আঠারো শতকের শেষের দিকে ফ্রান্সের দুই ভাই জোসেফ মিশেল এবং জ্যাকস মন্টগোলফায়ার মনুষ্যবিহীন হট এয়ার বেলুন তৈরি করে।
১৮৯১ সালে জার্মানির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ওটো লিলিনথাল সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসাবে গ্ল্যাডিয়েটরের সাহায্যে আকাশে ওড়েন। প্রথমে তিনি পঁচিশ মিটার পর্যন্ত ওড়েন। পরবর্তী পাঁচ বছরে অনেকবার প্রচেষ্টার পর ২৫০ মিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম হন তিনি। তারপর থেকে জার্মানিতে তাঁকে গ্লাইডার কিং বা ফ্লাইং ম্যান বলা হতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এমনই এক উড়ানের সময় মৃত্যু হয় তাঁর। এরপর অ্যালবার্তো স্যান্টস ডুমোন্ট ব্রাজিলে হট এয়ার বেলুন প্রযুক্তির সাহায্যে বিমান তৈরির চেষ্টা শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিমান তৈরিও করেন। এদিকে ১৮৯৮ থেকে ১৯০২ সালে আমেরিকাতে রাইট ভাইরা উইলবার রাইট ও ওরভিল রাইট একাধিক হট এয়ার বেলুন ও ঘুড়ি ডিজাইন করেন। একাধিক ব্যক্তি বিমান তৈরির চেষ্টা করলেও বিমান তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া হয় আমেরিকার রাইট ভাইদেরকেই। কারন তাঁরা বিমান তৈরির পাশাপাশি বিমানের গতি নিয়ন্ত্রন এবং উড়ানের সময় হওয়া সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করেন। প্রায় দুইশোর বেশী বিমানের ডানা তৈরি করেন তাঁরা সঠিক বিমান তৈরির জন্য। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯০৩ সালে হাওয়ার থেকেও বেশী ভারি গ্লাইডার ওড়ান তাঁরা নিজেরাই। আধুনিক অ্যাভিয়েশন ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ন দিন ছিল এটি।
বিমান তৈরি হয়ে যেতেই সর্বপ্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে তা ব্যবহারের কাজ শুরু হয়। ইটালি প্রথম কোন দেশ যারা যুদ্ধক্ষেত্রে বিমানের ব্যবহার করে। ১৯১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯১২ সালের অক্টোবর অবধি লিবিয়াতে তুরস্ক ও ইটালির যুদ্ধে সেনা পরিবহন ও বোম্বিং এর জন্য ইটালি বিমান ব্যবহার শুরু করে। ১৯১১ সালের ১ নভেম্বর বিমান থেকে প্রথম বোম্বিং করে ইটালি। ১৯১২- ১৯১৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বুলগেরিয়াও বিমানের ব্যবহার করে। ১৯১৪- ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামরিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী বিমানের ব্যবহার হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই যুদ্ধবিমানের ব্যবহার প্রথম শুরু হয়। সেসময় আকাশযুদ্ধে বিমান থেকে একজন সদস্য অন্য বিমান লক্ষ্য করে গুলি চালাতো কারন বিমানে নিজস্ব বন্দুকের কোন ব্যবস্থা ছিলনা সেসময়। ১৯১৪ সালে ফ্রান্সের রোলান্ড গ্যারোস বিমানে প্রথম মেশিনগান ইনস্টল করেন। প্রথম দিকে ফ্রান্স বিমান তৈরিতে বিশেষজ্ঞ ছিল।
১৯১৪ থেকে ১৯১৮ এর মধ্যে ফ্রান্স প্রায় ৬৮,০০০ বিমান তৈরি করেছিল। পরে ইটালি, ব্রিটেন ও জার্মানিও বিমান তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ও ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরাম্ভর মাঝের সময়কে বিমান তৈরির স্বর্নযুগ বলা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেসব বিমান ব্যবহার করা হত তা কাঠ দিয়ে তৈরি হত এবং গতি খুব কম ছিল কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে হতে এসব বিমানের বদলে উন্নত ধাতব, দ্রুতগতির বিমান তৈরি এবং হালকা ইঞ্জিন তৈরি শুরু হয়ে যায়। জার্মান বিজ্ঞানী হুগোকে জাঙ্কারসই ধাতব বিমান তৈরির জনক বলা হয়। ১৯১৫ সালেই তিনি ধাতব বিমান তৈরি করে ফেলেছিলেন যা ১৯১৮ সালে জার্মান সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয়। ১৯২০ সালে এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা ও ব্রিটেনও ধাতব বিমান তৈরি শুরু করে। ১৯৩০ সাল থেকে জার্মানি ও ব্রিটেন জেট ইঞ্জিন তৈরির কাজ শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে স্থলসেনার পাশাপাশি বায়ুসেনার প্রকৃত গুরুত্ব বোঝা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমান উৎপাদনের গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি দ্রুতগতিতে আধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরির কাজ শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সর্বপ্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ব্যবহার শুরু হয়। এসময় বিমানকে স্ট্রাটেজিক বোম্বার হিসাবে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এইসময়ই তরল জ্বালানি বিশিষ্ট রকেট এবং প্রথম প্রজন্মের জেট যুদ্ধবিমান তৈরি হয়।
শুধু সামরিক ক্ষেত্রেই নয় যাত্রী পরিবহন ক্ষেত্রেও বিমানের ব্যবহার সেই ১৯০৯ সাল থেকেই শুরু হয়। এই উদ্দেশ্যে ১৯০৯ সালের ১৬ নভেম্বর জার্মানিতে তৈরি হয় বিশ্বের প্রথম এয়ারলাইন সংস্থা ডেলাগ। ১৯১০ সালের ১৯ জুন এই সংস্থার প্রথম বিমান ২৪ জন যাত্রীকে নিয়ে প্রথম আকাশে ওড়ে। ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ট্যাম্পা শহর অবধি প্রথম একটি নির্দিষ্ট পথে বিমান চলাচল শুরু হয়। এইসময় বিমান যাত্রায় যাত্রীদের বেশ কষ্ট সহ্য করতে হত কারন বিমান কম উচ্চতায় ওড়ার কারনে এয়ার টার্বুলেন্সের কবলে পড়ত বিমান। যাত্রীবাহী বিমানের ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের সূচনা করে ডাগলাস ডিসি ৩ বিমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে হতে ইউরোপের বহু দেশে বিমান ঘাঁটি তৈরির পাশাপাশি উন্নত ডিজাইনের যাত্রীবাহী বিমান তৈরি শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় এসব বিমান যুদ্ধে ব্যবহার করা হত তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও কিছু এয়ারলাইন যাত্রী পরিবহন করতো যেমন ব্রিটেনের ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারওয়েস কর্পোরেশন বা বিএওসি।
শিকাগোতে ১৯৪৪ সালের ৭ ডিসেম্বর ৫৪ টি দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন চুক্তি হয়, একে শিকাগো কনভেনশনও বলা হয়। এজন্য ৭ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন দিবস হিসাবে পালিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই যাত্রীবাহী বিমান তৈরির কাজ দ্রুত গতিতে হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেখানে বোম্ব তৈরি হত সেখানে বিমান ও তার যন্ত্রাংশ তৈরি করা হতে থাকে।
১৯৬০ এর দশক থেকে যাত্রী পরিবহনের গতি বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠতে শুরু করে অ্যাভিয়েশন ক্ষেত্র। ১৯৮০ এর দশক থেকে ডিজিট্যাল প্রযুক্তি আধুনিক যাত্রীবাহী বিমান তৈরিতে ব্যবহার হতে শুরু করে। ইন্টারনেটের আবিষ্কার, জিপিএস সিস্টেম, ইলেকট্রনিকস, এলইডি প্যানেল, শক্তিশালী কম্পিউটার ও স্যাটেলাইট নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা অ্যাভিয়েশন সেক্টরে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে।
১৯৮১ সালে আমেরিকার বোয়িং ৭৬৭ বিমানে গ্লাস ককপিটের ব্যবহার শুরু হয় যাতে পাইলট রাতেও বিমান ভালোভাবে চালনা করতে পারতো। ২০০০ সালের পর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির কাজ শুরু হয় যা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পুরে বদলে দেয়। এইসময়েই সর্বপ্রথম যুদ্ধের জন্য আনম্যানড এরিয়াল ভ্যেইকল বা ইউএভি তৈরির কাজও শুরু হয় যার দ্বারা রিমোটের মাধ্যমে শত্রুকে আক্রমন করা সম্ভব হয়। হট এয়ার বেলুন তৈরি থেকে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি পর্যন্ত বিগত ১২০ বছরে অ্যাভিয়েশন সেক্টরে আশাতীত উন্নতি হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান এবং সুপারসনিক যাত্রীবাহী বিমান আসতে চলেছে।
১৯০৩ সালে বিশ্বের প্রথম বিমান তৈরির কৃতিত্ব আমেরিকার রাইট ভাইদেরকে দেওয়া হলেও এরও আট বছর আগে এক ভারতীয় বিজ্ঞানী ১৮৯৫ সালেই বিমান তৈরি করেছিলেন। মহান এই ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম সিভকর বাপুজী তালপাডে। মহারাষ্ট্রের স্যার জেজে স্কুল অফ আর্টসের সংস্কৃতর অধ্যাপক সিভকর বাপুজী ১৮৯৫ সালে মুম্বাইয়ের চৌপাটি সমুদ্রতীরে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতে তাঁর বিমানের পরীক্ষা করেন। সেসময় তাঁর বিমানটি পনেরোশো ফুট উচতায় উঠেছিল এবং ভাল ভাবেই ল্যান্ড করেছিল। এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তৎকালীন মুম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি মহাদেব গোবিন্দ রানাডে এবং বরোদার মহারাজ সৈয়াজি রাও গাইকোয়াড নিজে। সিভকর বাপুজী এই বিমানের নাম রেখেছিলেন মারুতসখা। মারুত শব্দের অর্থ হাওয়া এবং সখা শব্দের অর্থ বন্ধু। এই বিমানে তিনি তরল পারদ ব্যাবহার করেছিলেন। বলা হয় এই বিমান সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এসে পারদ যখন হাইড্রোজেন গ্যাস নির্গমন করে তখনই এটা উড়তো।
ঋষি ভরদ্বাজ এবং মহাঋষি নারদ দ্বারা বৈমানিকা শাস্ত্রতে বিভিন্ন ধরনের বিমান তৈরির কথা রয়েছে। সংস্কৃত ও বেদে পারদর্শী সিভকর বাপুজী সেই অনুযায়ী এই বিমান তৈরি করেছিলেন। রাইট ভাইরা যে বিমান তৈরি করেছিল তা মাত্র ১২০ ফুট উড়ানে সক্ষম ছিল। কিন্তু সিভকর বাপুজীর তৈরি বিমান ১৫০০ ফুট পর্যন্ত উড়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা এই পুরো বিমান চালক ছাড়া ছিল অর্থাৎ সিভকর বাপুজী একপ্রকার ড্রোনই তৈরি করে ফেলেছিলেন। হ্যাল তাঁর এই মহান নির্মান সংক্রান্ত তথ্য আজও সংরক্ষিত রেখেছে।