অফবিট

বিরাট স্প্যানিশ নৌবাহিনীকে যুদ্ধ ছাড়াই পরাস্ত করেছিল ইংল্যান্ড। কি ছক কষেছিল জানেন?

মানব ইতিহাসে এমন অনেক যুদ্ধ হয়েছে যেখানে অনেক বেশী সংখ্যায় শক্তিশালী সেনাও পরাজিত হয়েছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষের কাছে। আসলে সেনা যতই বড় হোকনা কেন তা পরিচালনা নির্ভর করে একজন দক্ষ সেনানায়কের উপর। শত্রুর দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া গেলে সে যতই শক্তিশালী হোকনা কেন তাকে পরাজিত করা সম্ভব। ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটে বাস্তবে। সময়টা ১৫৫৮ সাল, ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনে রয়েছে মহারানী এলিজাবেথ প্রথম। তিনি যখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন তখন ইংল্যান্ডের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। সেসময় ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ চলছিল। দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছিল প্রায়। সুতরাং এলিজাবেথ প্রথম সিংহাসনে বসেই তাঁর কাছে প্রথম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ইংল্যান্ডের পুনর্গঠন। তিনি ঠিক করেন প্রথমে ইংল্যান্ডকে বাইরের সমস্ত দেশের সাথে যুদ্ধ থেকে বিরত করা হবে, তারপর দেশের আভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধান করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবেন। সেসময় ইউরোপে দুটি সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ছিল ফ্রান্স এবং স্পেন। মহারানী এলিজাবেথ প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন সেই মূহুর্তে এই দুই দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য নেই ইংল্যান্ডের। তাঁর নেতৃত্বে ইংল্যান্ড ধীরে ধীরে মজবুত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু ১৫৭০ সালের দিলে হঠাৎই নতুন সমস্যা দেখা দেয়। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ইংল্যান্ডের মহারানী এলিজাবেথ প্রথমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। খ্রিস্টান ধর্মে দুটো ভাগ আছে ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টেন্ট। স্পেনের রাজা ফিলিপ দ্বিতীয় ছিলেন  ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী, সে স্বপ্ন দেখতো গোটা ইউরোপে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্ম ছড়িয়ে পড়বে। এদিকে ইংল্যান্ডের মহারানী এলিজাবেথ প্রথম ছিল প্রোটেস্টেন্ট। সেসময় ইউরোপের রাজনীতিতে ইংল্যান্ডের একটা প্রভাব ছিল যার কারনে ফিলিপ দ্বিতীয় ঠিক করে এলিজাবেথ প্রথমকে হত্যা করে তারই বোন ম্যারিকে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসাবে। কারন ম্যারি ছিল ক্যাথলিক অর্থাৎ সে সিংহাসনে বসলে ইউরোপে দ্রুত ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্ম ছড়িয়ে পড়বে। দ্বিতীয় ফিলিপ দুটো পরিকল্পনা করেছিল তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল মহারানী এলিজাবেথ প্রথমকে হত্যা করা, যদি এই পরিকল্পনা ব্যার্থ হয় তাহলে আরও একটা বিকল্প ব্যাবস্থাও ঠিক করা হয়। ফিলিপ দ্বিতীয় ঠিক করে বিশাল স্প্যানিশ নৌবাহিনী বা স্প্যানিশ আর্মাডা তৈরি করে সরাসরি ইংল্যান্ড আক্রমন করবে। ইংল্যান্ড সেসময় সামরিক ভাবে অনেকটাই দুর্বল ছিল ফলে দ্বিতীয় ফিলিপ সহজেই ইংল্যান্ডকে পরাজিত করতে পারবে।

১৫০০ শতকে ইউরোপে স্পেন ও ফ্রান্সের ব্যাপক প্রভাব ছিল। বেলজিয়াম ও হল্যান্ড সেসময় স্পেনের অধীনে ছিল। বেলজিয়াম ও হল্যান্ডে প্রোটেস্টেন্টদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছিলো যার কারনে ফিলিপ দ্বিতীয় তাঁর একটি সেনা পাঠায় সেখানে তাদের দমন করতে। এদিকে মহারানী এলিজাবেথ প্রথমকে তাঁর মন্ত্রীরা জানায় বেলজিয়াম ও হল্যান্ডে সেনা পাঠাতে প্রোটেস্টেন্টদের রক্ষা করতে। কিন্তু এলিজাবেথ প্রথম জানতেন ইংল্যান্ডের যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাতে সেনা পাঠাতে দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পুরে ভেঙে পড়বে। সেজন্য তিনি একটি মজবুত গুপ্তচর দল তৈরি করে। এদের বেশীরভাগই স্পেনে থেকে সেখানকার খবর মহারানীকে জানাতে থাকে। এলিজাবেথ প্রথম স্পেনের দুর্বলতা খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি একটা জিনিস লক্ষ্য করেন স্পেন আর্থিক ভাবে এত শক্তিশালী তার প্রধান কারন উপনিবেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ। সেসময় দক্ষিন আমেরিকা স্পেনের উপনিবেশ ছিল, এখান থেকে মোটা অর্থ পেত স্পেন। এলিজাবেথ প্রথম ঠিক করেন যদি স্পেনের নৌবাহিনীকে সমস্যায় ফেলা যায় তাহলে স্পেন আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। এখনও বিশ্বরাজনীতিতে সমুদ্র বানিজ্যকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারত মহাসাগর, দক্ষিন চীন সাগর, ভূমধ্যসাগর, মালাক্কা প্রনালী, হরমুজ প্রনালীর মতো গুরুত্বপূর্ন সমুদ্রপথ কোন কারনে বন্ধ হয়ে গেলে বহু দেশের আর্থিক ব্যাবস্থা ভেঙে পড়বে। সেকারনে পৃথিবীর সব শক্তিশালী দেশ গুলোই তাদের নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করছে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ইংল্যান্ডের প্রধান শক্তি ছিল তাদের নৌবাহিনীই। ১৫৭০ এর দশকে স্পেন থেকে প্রতিদিন প্রচুর জাহাজ স্পেনের বিভিন্ন উপনিবেশে যেত এবং সেখান থেকে অর্থ, সোনা নিয়ে আসতো ৷ এই এত জাহাজ চলাচলের খরচের জন্য দ্বিতীয় ফিলিপ ইটালির কিছু ব্যাঙ্কারের থেকে অর্থ ধার নিতো। মহারানী এলিজাবেথ প্রথম বুঝতে পারেন স্পেনের দুর্বলতা এটাই। এলিজাবেথ প্রথম তাঁর নৌবাহিনীর এক দক্ষ ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস ড্রেককে নির্দেশ দেয় স্পেনের বানিজ্য জাহাজের উপর আক্রমনের। ফ্রান্সিস ড্রেক একের পর এক স্প্যানিশ বানিজ্য জাহাজ আক্রমন করে লুঠতে শুরু করে। এই আক্রমন হত অভিনব কায়দায়। ফ্রান্সিস ড্রেক তাঁর জাহাজে ইংল্যান্ডের পতাকা ব্যাবহার করতো না, জলদস্যুদের কালো পতাকা ব্যবহার করত। যার কারনে স্পেন ইংল্যান্ডকে কিছু বলতেও পারতনা। এভাবে একের পর এক স্প্যানিশ জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবার ফলে স্পেনের অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ পড়তে শুরু করে। ইটালিয়ান ব্যাঙ্কাররা সুদের হার বাড়িয়ে দেয় এবং স্পেনের ধার বাড়তেই থাকে। আর্থিক ক্ষতি যাই হোক স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ তাঁর পরিকল্পনা থেকে সরে আসেনি, তিনি ১৫৮২ সালে বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমনের পরিকল্পনা করতে থাকে। দ্বিতীয় ফিলিপ এলিজাবেথ প্রথমকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাধ্য হয় আক্রমনের পরিকল্পনা করতে। তবে একের পর এক স্প্যানিশ জাহাজের উপর আক্রমনের ফলে তাঁর এই পরিকল্পনা ধীরে হয়ে যায়। 

শেষপর্যন্ত ১৫৮৮ সালের জুলাই মাসে পর্তুগালের লিসবন থেকে বিশাল স্প্যানিশ নৌবাহিনী রওনা হয় ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। ১২৮ টি বড় যুদ্ধজাহাজ এবং প্রায় চল্লিশ হাজার নৌসেনা ছিল এই বাহিনীতে। এলিজাবেথ প্রথমও গুপ্তচর মারফত স্প্যানিশ আর্মাডার রওনা হবার খবর পেয়ে যায়। এলিজাবেথ প্রথম ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর আটটি ছোট ছোট জাহাজকে পাঠায় স্প্যানিশ আর্মডার উদ্দেশ্যে। এই জাহাজ গুলো স্প্যানিশ আর্মডার উপর সরাসরি আক্রমন না করে সাপ্লাই জাহাজ গুলোর উপর আক্রমন করে যাতে সমস্যা হয় স্প্যানিশ নৌবাহিনীর এবং তাদের গতি ধীরে হয়ে যায়৷ এরপর স্প্যানিশ আর্মাডা ফ্রান্সেই ক্যালেই বন্দরে পৌঁছায়। বেলজিয়াম ও হল্যান্ডে থাকা স্প্যানিশ সেনাদের একসাথে নিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমনের জন্য এখানে দাঁড়ায় স্প্যানিশ আর্মাডা। ইংল্যান্ড নৌবাহিনী এই সুযোগে তাদের আটটি জাহাজকে পুরো জ্বালিয়ে দিয়ে জ্বলন্ত জাহাজকে ক্যালেই বন্দরে নোঙর করে থাকা স্প্যানিশ যুদ্ধ জাহজ গুলোর দিকে পাঠিয়ে দেয়। স্প্যানিশ নৌবাহিনী দেখতে পায় দূর থেকে জ্বলন্ত জাহাজ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে তারা তারাতাড়ি ক্যালেই বন্দর থেকে নোঙর তুলে গভীর সমুদ্রে যাবার চেষ্টা করে কিন্তু ১২৮ টি জাহাজের বিশাল বহর একসাথে নোঙর করে থাকায় সম্ভব হয়নি। ফলে আটটি জ্বলন্ত জাহাজ এসে সরাসরি আঘাত হানে স্প্যানিশ আর্মাডার উপর এবং বহু যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায় এবং অসংখ্য নৌসেনার মৃত্যু হয়। স্প্যানিশ নৌবাহিনী এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে স্পেন ইংল্যান্ডে আক্রমনের পরিকল্পনা বাদ দিতে বাধ্য হয় এবং তারা স্পেনে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। স্পেনে ফিরে যাবার জন্য পূর্বের পথে না গিয়ে এবার স্প্যানিশ আর্মাডা উত্তর দিকে স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড হয়ে যাবার ঠিক করে কারন তারা ভেবেছিল আগের পথে ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী রয়েছে। কিন্ত এবার স্পেনের নৌবাহিনীর পীছু করেনি ইংল্যান্ডের জাহাজ। কারন ইংল্যান্ডের নাবিকরা জানতো যে পথ হয়ে স্প্যানিশ নৌবাহিনীর জাহাজ যাচ্ছে সেপথে সমুদ্র খুবই অশান্ত। ঠিক তাই হয় স্প্যানিশ নৌবাহিনীর সাথে, তীব্র ঝড় ও সামুদ্রিক ঢোউয়ে বহু স্প্যানিশ জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। 

শেষপর্যন্ত যখন স্প্যানিশ আর্মাডা স্পেনে পৌঁছায় তখন তাদের বহরে ৮৩ টি জাহাজ ছিল। ৪৫ টি জাহাজ কোন যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস হয়ে যায়, প্রায় ২০,০০০ স্প্যানিশ নৌসেনা ধ্বংস হয়ে যায়। বাকী জাহাজগুলোর ৭৫ শতাংশ আর যুদ্ধপযোগী ছিলনা। একতরফা বিশাল বিজয় হয় ইংল্যান্ডের। তবে এই বিজয়ের পরে মহরানী এলিজাবেথ প্রথম ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর আয়তন কমিয়ে দেয় কারন বিশাল নৌবাহিনী করতে প্রচুর খরচ হচ্ছিল। তাছাড়া ইংল্যান্ডের কাছে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা বেলজিয়াম ও হল্যান্ড আক্রমন করেনি কারন ইংল্যান্ড সেসময় নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত করতে চাইছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে যত নৌযুদ্ধ হয়েছে এটা তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারন এখানে কোনরকম যুদ্ধ ছাড়াই স্পেনের এত ক্ষতি হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *