অফবিট

প্রকৃতির বিরুদ্ধে কেউ জিততে পারেনা। আমেরিকার নৌবাহিনী পর্যন্ত উড়ে গেছিল কয়েক মুহূর্তে

প্রকৃতির কাছে সুপার পাওয়ার দেশও হার মানতে বাধ্য হত। যত শক্তিশালী নৌবাহিনীই হোক না কেন টাইফুনের কাছে হার মানতে বাধ্য, তেমনি শক্তিশালী বায়ুসেনাও আগ্নেয়গিরির বিরুদ্ধে জিততে পারবেনা অর্থাৎ প্রকৃতির কাছে মানুষ সবসময়ই অসহায়। কিন্তু ইতিহাসে এমন কিছু সেনানায়ক ছিল যাদের ধারনা ছিল তাদের সেনাবাহিনী এতটাই শক্তিশালী যে প্রকৃতির বিরুদ্ধেও লড়াই করতে পারবে। যেমন ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডার সম্ভবনাকে বাদ দিয়েই রাশিয়া আক্রমন করেছিল কিন্তু বাস্তবে যখন রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডার মুখোমুখি হয় তখন কোনও রকমে প্রানে বাঁচে নেপোলিয়ন এবং তার অধিকাংশ সেনা মারা যায় ওই তীব্র ঠান্ডায়। এই ঘটনা থেকেও শিক্ষা না নিয়ে জার্মানির সর্বাধিনায়ক অ্যাডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমন করে এবং মস্কোর যুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জার্মানির এই আক্রমনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পতনের সূচনা করেছিল। আমেরিকার নৌবাহিনী একবার সমুদ্রের তীব্র ঝড়ের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্ট করেছিল কিন্ত প্রকৃতির বিরুদ্ধে কোনওদিনও কেউ জিততে পারেনি।

দিনটা ডিসেম্বর ৭, ১৯৪১, আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরে অতর্কিত আক্রমন করে জাপান। জাপানের এই আক্রমনের পরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা যোগ দেয়। জাপান একটি এমন দেশ যা অনেকগুলি দ্বীপের সমষ্টি যার কারনে জাপানকে পরাজিত করতে হলে শক্তিশালী নৌবাহিনীর প্রয়োজন। ১৯৪১ সাল থেকেই আমেরিকা দ্রুত যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা শুরু করে। আমেরিকা সেসময় একটি শিল্পোন্নত দেশ ছিল যার কারনে যুদ্ধজাহাজ তৈরির কাঁচামাল যথেষ্ট ছিল আমেরিকার। 

১৯৪৪ সাল আসতে আসতে আমেরিকা তাদের নৌবাহিনীকে ব্যাপক শক্তিশালী করে তুলেছিল। এরপর আমেরিকার নৌবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরে একের পর এক জাপান অধিকৃত দ্বীপে আক্রমন করতে শুরু করে। এরকমই একটি দ্বীপ হল ফিলিপিন্সের লুজন দ্বীপ যেখানে জাপানি শাসন ছিল। আমেরিকা লুজন দ্বীপে আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়। লুজন দ্বীপের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ন ছিল, আমেরিকান নৌবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল লুজান দ্বীপ দখল করা যাতে আশেপাশের সম্পূর্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন তাদের হাতে থাকে। কিন্তু আমেরিকার নৌবাহিনী জানতো না লুজান দ্বীপে জাপান ছাড়াও আরও একটি বড় শত্রু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো তা হল সামুদ্রিক ঝড় বা টাইফুন। 

আমেরিকার নৌবাহিনীর মূল নেভাল বেস পার্ল হারবার থেকে প্রায় নয় হাজার কিলোমিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের লুজান দ্বীপের আশেপাশের আবহাওয়া সম্পর্কে তাদের কোন ধারনা ছিলনা। জাপানিরা বিশ্বাস করতো তাদের ভূভাগের উপর কেউ আক্রমন করতে পারবেনা কারন অদৃশ্য শক্তি তাদের রক্ষা করে। জাপানিদের এই ধারনা তৈরি হয় ১২৭৪ সাল থেকে। ১২৭৪ সালে এক শক্তিশালী মোঙ্গল শাসক কুবলাই খান জাপান আক্রমনের পরিকল্পনা করে। কুবলাই খান প্রায় এক হাজার যুদ্ধজাহাজ সহযোগে ৪০,০০০ এর বেশী সেনাকে জাপান আক্রমনে পাঠায়। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরে বিশাল সামুদ্রিক ঘূর্নিঝড়ের কবলে পড়ে কুবলাই খানের প্রায় তেরো হাজারের অধিক সেনার মৃত্যু হয়। এরপর কুবলাই খান জাপান আক্রমন না করেই দেশে ফিরে আসে। এর পরবর্তী সাত বছর ধরে কুবলাই খান আরও শক্তিশালী নৌবাহিনী তৈরি করে। ১২৮১ সালে কুবলাই খান ৪,৫০০ যুদ্ধজাহাজে ১,৪৫,০০০ সেনাকে জাপান আক্রমনে পাঠায়। এত বিশাল সংখ্যায় সেনা নিয়ে সমুদ্র পথে হামলা এর আগে কোনও রাজা করেনি। কুবলাই খানের এই বিশাল সেনা জাপানে পৌঁছে জাপান দখল করে নেয় কিন্তু জাপান থেকে ফিরে আসার সময় আবারও ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়ের কবলে পড়ে কুবলাই খানের নৌবাহিনী। এই ঘূর্নিঝড়ে কুবলাই খানের  প্রায় এক লাখ নৌসেনার মৃত্যু হয়। এরপরে আর কখনও কুবলাই খান জাপান আক্রমনের কথা চিন্তাও করেনি। তখন থেকেই জাপানিদের ধারনা জন্মে যায় সমুদ্রের অদৃশ্য শক্তি তাদের রক্ষা করছে। জাপান প্রশান্ত মহাসাগরের এই ঘূর্নিঝড় বা টাইফুন গুলোর নাম দেয় কামিকাজে। 

লুজান দ্বীপে আক্রমন করার জন্য আমেরিকার নৌবাহিনীতে টাস্ক ফোর্স ৩৮ বা টি এফ ৩৮ গঠন করা হয় যার অধীনে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, প্রচুর ডেস্ট্রয়ার সহ অনেক যুদ্ধজাহাজ ছিল। টি এফ ৩৮ এর প্রধান কম্যান্ডার ছিলেন উইলিয়াম হ্যালসে জুনিয়র। আমেরিকার নৌবাহিনীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডমিরাল উইলিয়াম হ্যালসের যথেষ্ট সুনাম ছিল। ১৪ ডিসেম্বর লুজান দ্বীপের কাছে পৌঁছায় টি এফ ৩৮ এবং জাপানিদের পরাস্ত করে। এরপর উইলিয়াম হ্যালসে গভীর সমুদ্রের দিকে রওনা দেয় জাহাজে জ্বালানি ভর্তির জন্য। কিন্তু এইসময়েই আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। এত ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল যে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে যুদ্ধবিমান নামতে পারছিলনা, এমনকী জ্বালানির জাহাজ থেকে জ্বালানি ভরা যাচ্ছিলনা যুদ্ধজাহাজ গুলিতে। 

উইলিয়াম হ্যালসে কয়েকবার তার যাত্রাপথ পরিবর্তনও করেন কিন্তু যেন পুরো প্রশান্ত মহাসাগরই উত্তাল হয়ে উঠেছিল। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে যুদ্ধবিমান জলে পড়ে যেতে শুরু করে, জাহাজ গুলোতে তেল কমে যাওয়ায় জাহাজগুলো হালকা হয়ে যায় যার কারনে অতিরিক্ত দুলতে শুরু করে উত্তাল সমুদ্রে। বাধ্য হয়ে উইলিয়াম হ্যালসে আবহাওয়া পরিবর্তনের অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু জাপানের কাছে প্রশান্ত মহাসাগরের আবহাওয়া সম্পর্কে কোন ধারনা ছিলনা তার, এটা কোনও সাধারন ঝড় ছিলনা, এটা রীতিমতো টাইফুন ঘূর্নি ঝড় ছিল। ১৮ ডিসেম্বর উইলিয়াম হ্যালসে টি এফ ৩৮ কে অন্যত্র যাবার নির্দেশ দেন কিন্তু উইলিয়াম হ্যালসে জানতেননা তিনি যেদিকে যাচ্ছেন সেখানেই টাইফুনের কেন্দ্রবিন্দু, যে কোনও ঘূর্নিঝড় তার কেন্দ্রে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়। 

উইলিয়াম হ্যালসে পরে এক সাক্ষাৎকারে জানান টাইফুনের কেন্দ্রে পৌঁছনোর পর তার টি এফ ৩৮ গ্রুপের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়, তিনি যে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে ছিলেন তার সামনেটা কখনও জলে ডুবে যাচ্ছিল আবার পরমুহূর্তেই উঠে যাচ্ছিল কয়েক ফুট উচ্চতায়, ছোট ছোট যুদ্ধজাহাজ গুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ ছিল। তিনটি যুদ্ধজাহাজ ডুবে যায় এই টাইফুনে। উইলিয়াম হ্যালসে বুঝে যান ফর্মেশনে গেলে প্রায় সব যুদ্ধজাহাজই ধ্বংস হয়ে যাবে যার কারনে তিনি আদেশ দেন সমস্ত যুদ্ধজাহাজ যেভাবে হোক নিজেকে রক্ষা করুক, ফর্মেশনের কোনও প্রয়োজন নেই। ১৯ ডিসেম্বর আবহাওয়া একটু শান্ত হলে টি এফ ৩৮ এর সমস্ত যুদ্ধজাহাজ আবারও একসাথে ফর্মেশনে আসে। এই ঘটনার পর আমেরিকায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং অনুসন্ধানের পর জানা যায় জাপানের কাছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায়ই বড় বড় ঘূর্নিঝড় হয়। যার জন্য পার্ল হারবারে আমেরিকা টাইফুন সেন্টার তৈরি করে যেখানে আমেরিকার নৌবাহিনীকে সমুদ্রের আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হতে থাকে। 

উইলিয়াম হ্যালসে যে ভায়ানক ঘূর্নিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছিল তার নাম কোবরা টাইফুন। আমেরিকার নৌবাহিনীর ইতিহাসে এই ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়ে প্রায় আটশো আমেরিকার নৌসেনার মৃত্যু হয়েছিল। এই ঘটনার ছয় মাস পর উইলিয়াম হ্যালসে ও তার টি এফ ৩৮ আবারও একটি ঘূর্নিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছিল যার নাম টাইফুন কনি। তবে এটি কোবরার মতো ভয়াবহ ছিলনা। এসব ঘটনা প্রমান করে মানুষ যত শক্তিশালীই হয়ে যাক না কেন সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে প্রকৃতির কাছে মানুষ বরাবরই অসহায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *