অফবিট

ভবিষ্যত দেখার জন্য আমেরিকার গোয়েন্দাদের প্রজেক্ট স্টারগেট

১৯৯৮ সালে ইঙ্গো সোয়ান নামে এক ব্যাক্তি একটি বই লেখেন যার নাম পেনিট্রেশন। ওই বইয়ে সে দাবি করে সে একজন সাইকিক এবং সে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। সাইকিক ক্ষমতা একধরনের বিশেষ অতিমানবীয় ক্ষমতা যার প্রভাবে কোন ব্যাক্তি  এবং টেলিপ্যাথির ক্ষমতা অর্জন করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে ছদ্ম বিজ্ঞানও বলা হয়। বিজ্ঞানীরা যদিও এই ধরনের ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয়। ইঙ্গো সোয়ানের এই বই সম্পর্কে হয়ত সব মানুষ বিশ্বাস করেনি, কিন্তু ২০০৬ সালে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ বেশ কিছু গোপন নথি প্রকাশ করে। যাতে সিআইএ নিজেই জানিয়েছে তারা একটি বিশেষ প্রজেক্টে কাজ করছিল যার নাম প্রজেক্ট স্টারগেট। সিআইএ আরও জানিয়েছে ইঙ্গো সোয়ান নামে ওই ব্যাক্তি সাইকিক ক্ষমতার অধিকারী তাকে তারা তাদের এই প্রজেক্টে ব্যাবহার করেছে। সেই নথিতে শুধু ইঙ্গো সোয়ানই নয় এমন অনেক সাইকিকের নাম পাওয়া গেছে। ইঙ্গো সোয়ানকে সিআইএ কাজ দিয়েছিল যে পৃথিবীতে বসে অতিমানসিক ক্ষমতা প্রয়োগে চাঁদের মানচিত্র তৈরি করা এবং আমেরিকার মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নাসাকে সাহায্য করা। পৃথিবী থেকে সর্বদা চাঁদের একটি দিকই দেখা যায় কিন্তু চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ পৃথিবী থেকে দেখা যায় না। চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ সম্পর্কে জানতে হলে স্যাটেলাইট পাঠানো ও চাঁদে রোভার পাঠানো ছাড়া উপায় নেই। এইজন্য আমেরিকা, ভারত, চীন সহ বেশ কীছু দেশ চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠে অভিযান করছে। সিআইএ ইঙ্গো সোয়ানকে চাঁদের এই অন্ধকার দিক সম্পর্কে বিশ্লেষন করার জন্যই নিয়োগ করেছিল। সিআইএর এই অতি রহস্যময় প্রজেক্ট স্টারগেট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয় শীতল যুদ্ধ। দুই দেশই একে অপরকে ছাড়িয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমানের জন্য একের পর এক প্রজেক্ট শুরু করে। আমেরিকার এমন অনেক প্রজেক্ট সফল হয়েছিল আবার বেশ কিছু প্রজেক্ট এত গোপনীয় ছিল যার ব্যাপারে আজও কোনও তথ্য পাওয়া যায়না। আমেরিকার এমনই একটি অত্যন্ত গোপনীয় ও অলৌকিক প্রজেক্ট হচ্ছে প্রজেক্ট স্টারগেট। ১৯৭৮ সালে আমেরিকার ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি বা ডিআইএ প্রজেক্ট স্টারগেটের সূচনা করে। সত্তরের দশক থেকেই ডিআইএ সাইকিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যাক্তিদের গোপনে এই প্রজেক্টের জন্য নিয়োগ করছিল। মেরিল্যান্ডের একটি সেনা বেস ফোর্ট মিয়েড এবং উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বিশেষ জায়গায় এই প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছিল। প্রথমে এই প্রজেক্টকে গন্ডোলা উইশ, গ্রিল ফ্লেম, সেন্টার লেন অনেক সাংকেতিক নামে ডাকা হত। ১৯৯১ সালে এই প্রজেক্টের নাম স্টারগেট ঠিক করা হয়। প্রথম দিকে এই প্রজেক্টে একটি বিশেষ জায়গা থেকে অনেক দূরে কোন জায়গায় কি হচ্ছে তা জানার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছিল। এই প্রজেক্ট এতটা গোপনীয় ছিল যে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগন ও সেক্রেটারি ছাড়া কেউই জানত না। 

১৯৮১ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগন, মিশরের রাজনীতিবিদ আনোয়ার আল সাদাত এবং পোপ জন পল ২ এর উপর আক্রমন হয়, যাতে আনোয়ার আল সাদাত মারা যায় কিন্ত বাকী দুজন বেঁচে যায়। যার জন্য ডিআইএ এই প্রজেক্টের উপর আরও বেশী জোর দেয়। এই প্রজেক্টে নিযুক্ত সাইকিকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমেরিকার গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিদের উপর হতে চলা আক্রমনের সম্পর্কে আগেই অনুমান করে সেই অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেওয়া। আমেরিকা প্রজেক্ট স্টারগেট হঠাৎই শুরু করেনি, ১৯৭০ এর দিকে আমেরিকা খবর পায় সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি প্রজেক্টে কাজ করছে সাইকোট্রনিক, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ৬০ মিলিয়ন রুবেল বিনিয়োগ করেছে। এটা একধরনের ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক মানসিক অত্যাচার। তাড়িতচুম্বকীয় তরঙ্গ, রেডার ও সারভিল্যান্স ডিভাইস ব্যাবহার করে বিভিন্ন ধরনের শব্দ মানুষের মাথায় প্রয়োগ করা হত যার ফলে বন্দী ব্যাক্তিটি সব সত্যি কথা স্বীকার করতে বাধ্য হত। এর দেখাদেখি আমেরিকাও শুরু করে স্ক্যানেট নামে একটি প্রজেক্ট অর্থাৎ দূরে কোন ঘটনা দেখার চেষ্টা যা প্রথম দিকে ৬৫ শতাংশ সফল হয়। এই প্রজেক্টে ১৯৭৬ সালে সিআইএ সফল ভাবে একটি হারিয়ে যাওয়া সোভিয়েত গোয়েন্দা বিমানকে খুঁজে বার করে। এরপরেই এই প্রজেক্ট আরও বড় আকারে প্রজেক্ট স্টারগেট নামে শুরু হয়।  এই প্রজেক্টে একটি সমস্যা ছিল বিভিন্ন সাইকিক ব্যাক্তি একজন বিশেষ ব্যাক্তির উপর হতে চলা আক্রমন সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিত, এমনকী আক্রমনকারী ব্যাক্তি সম্পর্কে দেওয়া তথ্যও ভিন্ন হত যার কারনে সিআইএ সমস্যায় পড়ে আসল তথ্য খুঁজে পেতে। এরই মধ্যে ১৯৮১ সালের ১৫ ডিসেম্বর একটি ঘটনা ঘটে। প্রজেক্ট স্টারগেটের সাইকিকদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ ছিল গ্যারি ল্যাংফোর্ড যে নৌবাহিনীর একজন প্রাক্তন অফিসার ছিল। 

১৫ ডিসেম্বর ল্যাংফোর্ড হঠাৎ জানায় আগামী ১৭ ডিসেম্বর পেন্টাগনের একজন বড় অফিসারকে অন্য একটি দেশ থেকে অপহরন করা হবে, অপহরনকারী ব্যাক্তি দক্ষিন ইউরোপের কোন দেশের হবে। সেই অফিসারকে অপহরন করে হাত, মুখ বেঁধে একটি নীল গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হবে। এই খবর পাওয়া মাত্রই সিআইএ ততক্ষনাৎ তার নেটওয়ার্ক সক্রিয় করে পুরো দক্ষিন ইউরোপে কারন এর আগে কোন সাইকিক ভবিষ্যতের কোন ঘটনা সম্পর্কে এতটা নিখুঁত বর্ননা দিতে পারেনি। এরপরেই ইন্টারপোল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আমেরিকান অফিসারদের উপর সতর্কতা জারি করে। কিন্তু খোদ পেন্টাগনের অনেকেই এই প্রজেক্টের উপর বিশ্বাস করত না সেজন্য ততটা জোর দেওয়া হয়নি নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। ১৭ ডিসেম্বর ইটালির ভেরোনা শহরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এক আমেরিকান অফিসার জেমসের বাড়িতে কলমিস্ত্রীর ছদ্মবেশে দুজন এসে জেমস ও তার বৌকে অজ্ঞান করে। এরপর আরও দুইজন ব্যাক্তি একটি বড় ট্রাঙ্ক নিয়ে এসে তাতে জেমসকে ঢুকিয়ে একটি নীল ভ্যানে করে চলে যায়। ঠিক গ্যারি ল্যাংফোর্ড যেমনটা বলেছিল তেমনই হলো। আমেরিকা জেমসকে খুঁজে বের করার জন্য দুই মিলিয়ন ডলারের পুরস্কারও ঘোষনা করেছিল কিন্তু পাঁচদিন পর এক ব্যাক্তি ইটালির সবচেয়ে বড় সংবাদমাধ্যমে আরবি ভাষায় একটি তথ্য দেয় যাতে বলা হয় আমেরিকান অফিসার জেমসকে রেড ব্রিগেডের আদালতে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাকে হত্যা করা হয়েছে। রেড ব্রিগেড ইটালির একটি সন্ত্রাসী সংগঠন যারা চাইত ইটালি থেকে আমেরিকান সেনা চলে যাক। তবে রেড বিগ্রেডের এই কথায় বিশ্বাস করেনি সিআইএ। বেশ কিছু সাইকিক ব্যাক্তি সিআইএকে জানায় জেনারেল জেমস বেঁচে আছে কিন্তু তারা সঠিক অবস্থানের কথা বলতে পারেনা। পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়ে আমেরিকান স্পেশাল ডেল্টা ফোর্স ইটালি জুড়ে অভিযান করে কিন্তু তাও জেনারেল জেমসকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। 

১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি পেন্টাগন ও প্রজেক্ট স্টারগেটের দায়িত্বে থাকা অফিসারের বৈঠক হয় এবং ডেল গ্রাফ নামে এক ব্যাক্তিকে ইটালি পাঠানো হয় ডেল্টা ফোর্সের সদস্য হিসাবে জেনারেল জেমসকে খুঁজে বের করার জন্য। এই ডেল গ্রাফ ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত গোয়েন্দা বিমান খুঁজে বের করার মিশনে ছিল এবং উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় স্টারগেট মিশনের দায়িত্বে ছিল। ডেল গ্রাফ ইটালিতে পৌঁছে বেশ কিছু দিন চেষ্টা করেও জেনারেল জেমসকে খুঁজে পাচ্ছিলনা। হঠাৎ একদিন স্বপ্নে ডেল গ্রাফ একটি দোকান দেখতে পায় এবং দোকানের সামনে সাইনবোর্ড লেখা আছে পাডুয়া। ডেল গ্রাফ পরেরদিন পাডুয়া শব্দের অর্থ দেখে বুঝতে পারে এটি উত্তর ইটালির একটি শহর যা তাদের ডেল্টা ফোর্সের ক্যাম্প থেকে মাত্র ৪৩ কিলোমিটার। ডেল্টা ফোর্স সাথে সাথে সেই শহরে অভিযান চালায় এবং হবুহু ডেল গ্রাফের স্বপ্নে দেখা দোকান খুঁজে পায়। সেখানে অভিযান চালিয়ে জেনারেল জেমসকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও রেড ব্রিগেডের একজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়, যে ১৭ ডিসেম্বর জেনারেল জেমসকে অপহরন করার সাথে যুক্ত ছিল। 

জিজ্ঞাসাবাদ করার পর একটি নির্দিষ্ট বাড়িতে ডেল্টা ফোর্স ও ইটালিয়ান স্পেশাল ফোর্স যৌথভাবে অভিযান চালায় এবং উদ্ধার করা হয় জেনারেল জেমসকে। ১৯৯৫ সালে সিআইএ এই প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয় কারন হিসাবে সিআইএ জানায় এই প্রজেক্টে সবসময় সঠিক তথ্য আসে না এবং তাদের অপারেশনে এই প্রজেক্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য ততটা সাহায্য করেনা। ২০১৭ সালে সিআইএ স্টারগেট প্রজেক্টের তথ্য প্রকাশ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *