নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে কমিউনিস্টরা তোজোর কুকুর বলেছিল। ভারতবর্ষে কমিউনিজমের ইতিহাস ও ভারতে কমিউনিস্টদের দ্বিচারিতা!
১৯২৪ সালে ভ্লাদিমির লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট দলে ক্ষমতা দখল নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কমিউনিস্ট দলের অনেক নেতাই ভ্লাদিমির লেনিনের জায়গা নেবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত দলের ক্ষমতা দখল করে জোসেফ স্ট্যালিন। কিন্তু ১৯৩০ সাল আসতে আসতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলে স্টালিনের প্রভাব কমতে শুরু করে, দলের অধিকাংশ কর্মকর্তাই স্ট্যালিনের বিরোধীতা শুরু করে। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে জোসেফ স্ট্যালিন দলের মধ্যে সবাইকে সন্দেহ করা শুরু করে। ১৯৩৪ সালের ১ ডিসেম্বর এক বিখ্যাত সোভিয়েত রাজনীতিবিদ সার্গেই কিরোভকে হত্যা করা হয়। তদন্তের পর জানা যায় দলের মধ্যেই স্ট্যালিন বিরোধী এক ব্যাক্তি কিরোভকে হত্যা করেছে। ওই ব্যক্তি স্ট্যালিনকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। এরপরেই শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় যাকে দি গ্রেট পার্জ বা দি গ্রেট টেরর বলা হয়। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৩৮ সালের দি গ্রেট পার্জে সোভিয়েত ইউনিয়নে স্ট্যালিনের বিরোধীতে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয় যার মধ্যে সাধারন মানুষও ছিল। ১৯৫৩ সালে জোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর যখন দি গ্রেট পার্জের তথ্য সামনে আসে তখন দেখা যায় সাত লাখ থেকে ১.২ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই সময়কালে। এদের মধ্যে ৪৫ জন ভারতীয়ও ছিল যার মধ্যে ১২ জনের পরিচয় জানা গেছিল। এদের মধ্যে ছিল সরোজিনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং আর এক গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি অবনী মুখার্জী যাকে ভারতে কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি দল সোভিয়েত ইউনিয়নের ডাকে মস্কো পৌঁছায়। এই দলের প্রধান ছিল বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। বীরেন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল এবং জার্মান সোশ্যালিস্ট কংগ্রেসের সদস্য ছিল। এর পাশাপাশি বীরেন্দ্রনাথ ফ্রান্স, সুইডেনের মতো দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ভারত থেকে মস্কো যাওয়া এই দলের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে প্রথম কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা করা। ভারতে কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা করার চিন্তাভাবনা ১৯১৬ সালের দিকে শুরু হয়। সেসময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো, জার্মানি ভারতের বিদ্রোহীদের ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সহায়তা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ভারতের অনুশীলন সমিতির উদ্দেশ্য ছিল জার্মানি থেকে অস্ত্র এনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কিন্তু এই পরিকল্পনা সফল হওয়ার আগে ব্রিটেনের ইনটেলিজেন্স বিভাগ বহু বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে। বাকী কিছু সংখ্যক মানুষ পালিয়ে বার্লিন চলে গিয়েছিল।
১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজম বা সাম্যবাদ স্থাপনের জন্য একাধিক সংগঠন তৈরি হয়। ১৯১৭ সালেই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার আমন্ত্রন পেয়েছিল কিন্তু তখন কিছু কারন বশত তিনি যেতে পারেননি। ১৯২০ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্ত সোভিয়েত আধিকারিকরা তকে আটকে দিয়ে জানায় একটি পুরো দল নিয়ে আসতে হবে। পরের বছর এপ্রিল মাসে একটি পূর্নাঙ্গ দল নিয়ে ভারতে কমিউনিস্ট দল তৈরির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পৌঁছায় বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছে তিনি খবর পান ভারতে ইতিমধ্যেই সিপিআই বা কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া তৈরি হয়ে গেছে। তিনি আরও অবাক হয়ে যান যে এই দলকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন করেছে। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আরও অবাক হয়ে যায় এটা শুনে যে ভারতে কমিউনিস্ট দল তৈরি হয়েছে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে। এই মানবেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী অ্যাভেলিন ট্রেন্ট বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও তার দলকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কিন্তু অ্যাভেলিন ট্রেন্ট বীরেন্দ্রনাথকে কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। এজন্য ক্ষুব্ধ হয়ে বীরেন্দ্রনাথ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দলকে সমর্থন করতে অসম্মত হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য মস্কোতে কমিউনিস্ট দলের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে বীরেন্দ্রনাথ স্পষ্ট জানায় মানবেন্দ্রনাথের দলে অবনী মুখার্জী থাকলে তারা সেই দলকে সমর্থন করবেনা। বীরেন্দ্রনাথের বক্তব্য ছিল অবনী মুখার্জী তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। রাসবিহারী বোসের সংস্পর্শে এসে ১৯১৪ সাল থেকে অবনী মুখার্জী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেয়।
১৯১৫ সালে বাংলার অনুশীলন সমিতি জার্মানি থেকে অস্ত্র আনবার পরিকল্পনা করে। এরজন্য অবনী মুখার্জীকে জার্মানি পাঠানো হয়। কিন্তু ইংরেজরা আগেই এই পরিকল্পনা জেনে যায়। ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫ সালে অবনী মুখার্জী জার্মানি যাওয়ার জন্য জাপান হয়ে সিঙ্গাপুর পৌঁছায় এবং সেখানেই ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। দুইবছর পর অবনী মুখার্জী জেল থেকে পালিয়ে যায়। এই ঘটনা নিয়েই মস্কোকে বৈঠকে বীরেন্দ্রনাথ অভিযোগ করে বলেছিল অবনী মুখার্জী ইংরেজদের অনেক বিপ্লবীদের নাম জানিয়েছিল যার বদলে সে মুক্তি পায়। এসব বিপ্লবীদের অনেককে পরবর্তীকালে ফাঁসি দেওয়া হয়। যদিও অবনী মুখার্জী বলেছিল তাকে জেল থেকে পালাতে সহায়তা করেছিল কিছু আইরিশ সেনা। জেল থেকে পালিয়ে গিয়ে অবনী মুখার্জী ১৯১৯ সাল পর্যন্ত জাভাতে ছদ্মনামে বসবাস করে। ১৯২০ সালে অবনী মুখার্জী মস্কো যায় এবং সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের। অবনী মুখার্জী সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের সাথেও সাক্ষাৎ করে এবং এই বৈঠকের পর ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জী যৌথভাবে ভারতের প্রথম কমিনিস্ট দলের স্থাপনা করে। যেহেতু এই দল তাসখন্দে গঠিত হয়েছিল তাই ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কানপুরে এক বৈঠকের পর পুনরায় ভারতের কমিউনিস্ট দল গঠনের কথা ঘোষনা করা হয়। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট দল আরও অনেক ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৩৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সিক্রেট পুলিশ অবনী মুখার্জী ও বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করে এবং তাদের হত্যা করা হয়। জোসেফ স্ট্যালিন তাদের কেন হত্যা করেছিল তার কারন আজও অজানা।
কমিউনিজম শব্দের অর্থ সাম্যবাদ, এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ধনী, গরীবের কোনও বিভেদ থাকবেনা। অর্থাৎ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সমান অধিকারের কথা বলে সাম্যবাদ। কমিউনিজম সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু হয়ে এই সাম্যবাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতেও কমিউনিস্ট দল রয়েছে বিভিন্ন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই কমিউনিস্টদের দ্বারা দেশের ক্ষতি হয়েছে ভালো কিছু নয় এমনটাই মত কিছু বিশেষজ্ঞদের। ভারতের স্বাধীনতা লগ্নেই কমিউনিস্টরা ভারত বিরোধীতা করেছিল। ভারত মায়ের বীর সন্তান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে কমিউনিস্টরা তোজোর কুকুর বলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ও জার্মানি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস জাপান ও জার্মানির সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে ভারতকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন। এর জন্য তৎকালীন সময়ে ভারতের কমিউনিস্টরা নেতাজীকে তোজোর কুকুর পর্যন্ত বলেছিল। নেতাজী প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সহায়তা চায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন রাজি না হওয়ায় নেতাজী জার্মানি, জাপানের সহায়তা চায়। এতে কমিউনিস্ট দল ক্ষুব্ধ হয়ে নেতাজীকে নিয়ে কুৎসা প্রচার শুরু করে, সংবাদমাধ্যম অপমানজনক কার্টুন ছাপানো হয়। ১৯৪২ সালে তৎকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট দলের মুখপত্র পিপিলস ওয়ারে নেতাজীকে যথেষ্ট অপামানজনক চিত্র প্রকাশ করা হত।
এর থেকে বোঝা যায় কমিউনিস্ট দলের কাছে নিজ দেশের স্বাধীনতার থেকেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশী প্রিয় ছিল। পরে অবশ্য ভারতীয় জনগনের সমর্থনের জন্য এসব কর্মকান্ডের জন্য কমিউনিস্ট দল ক্ষমা চেয়েছিল। ১০৩ বছর আগে তৈরি হওয়া এই কমিউনিস্ট দল ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র তিনটি রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে পেরেছে এখনও পর্যন্ত, সর্বভারতীয় গ্রহনযোগ্যতা তারা কখনও পায়নি। এই তিনটি রাজ্যের পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ হয়েছে কমিউনিস্ট শাসনে। কমিউনিজমের অর্থ সাম্যবাদ হলেও বামপন্থীদের দ্বিচারিতা চোখে পড়ার মতোন। চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবার মতোন কিছু দেশে বর্তমানে কমিউনিস্ট সরকার রয়েছে, অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট সরকার ছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এসব দেশেই ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। দেশটির সরকারের হাতেই সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে এবং বেশ কয়েকটি দেশে কোনও বিরোধীপক্ষও নেই। কমিউনিস্ট দল যখন কোনও রাজ্য বা দেশে ক্ষমতায় আসে তাদের লক্ষ্যই থাকে যেভাবেই হোক বিরোধীশূন্য করতে হবে যাতে দীর্ঘকালীন সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা যায়।
বর্তমানে ভারতের কমিউনিস্টদের ভন্ডামি সবাই বুঝতে পেরে গেছে। কমিউনিস্টরা আমেরিকা, ইউরোপের পুঁজিবাদের বিপক্ষে কিন্তু কর্মসূত্রে, শিক্ষার জন্য কিন্ত তাদের সেসব দেশে যেতে কোনও আপত্তি নেই। বরাবরই কংগ্রেস দলের বিরোধী ছিল কমিউনিস্ট দলগুলো কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে কমিউনিস্ট দলগুলো কংগ্রেসকে সমর্থন করে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে কমিউনিজমের উদ্ভব হয়েছিল, এরকম কোনও পরিস্থিতি ভারতে ছিলনা। এই কারনে ভারতের মতো দেশে কমিউনিজম পূর্নভাবে ব্যর্থ হয়েছে।