ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লাসকর দত্তের ভূমিকা
যেই হাত এক সময় বোমা বাঁধার কাজ করত সেই হাতে জোরটুকুও ছিলনা। ব্রিটিশরা ভেঙে দিয়েছিল তাঁর শরীর- মন দুটোই। ফাঁসির মুখ থেকে ফিরে আসলেও তাঁকে ভুগতে হয়েছিল নরক যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা থেকে মৃত্যু অনেক শ্রেয় ছিল তাঁর কাছে। ‘কালাপানি’ নামে খ্যাত আন্দামানের সেলুলার জেল ছিল নরক, বন্দী বিপ্লবীদের কাছে। কারণ সেখানে অমানুষিক খাটুনির পাশাপাশি অকথ্য অত্যাচার এবং শাস্তি ভোগ করতে হত বন্দী বিপ্লবীদের। যার ফলে একটা সময় পর্যন্ত শরীর ও মন সব সহ্য করলেও তারপর ভাঙতে শুরু করে। এই বিপ্লবীর ক্ষেত্রেও এটাই ঘটেছিল। শরীর মন ভেঙে দেওয়ার পরও থেমে যাননি ব্রিটিশরা। তাঁকে একাধিকবার জোরালো ইলেকট্রিক শক দিয়ে মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে তিনি মুক্তিলাভের পরও আর ফিরতে পারেননি সক্রিয় বিপ্লবের ময়দানে। কিন্তু ‘কালাপানি’ তে যাওয়ার পূর্বে ব্রিটিশদের কাছে তিনি ছিলেন এক ত্রাস। তাঁর কার্যকলাপ ব্রিটিশ শক্তির ভীত নড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। অগ্নিযুগের এই অকুতোভয় বিপ্লবী হলেন উল্লাসকর দত্ত।
উল্লাসকর দত্ত অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কালিকচ্ছ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত, সচ্ছল বৈদ্য পরিবারে ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্বদেশপ্রেম ছিল তাঁর রক্তে। তাঁর বাবা দ্বিজদাস দত্তগুপ্ত স্বদেশপ্রেমিক হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন সমাজ সংস্কারক এবং ব্রাহ্মসমাজের সদস্য। পেশাগত দিক থেকে তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন।
তিনি তাঁর বাড়ি থেকে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ সম্পূর্ন করার পর ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার একটি স্কুলে। সেখান থেকে ১৯০৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল রসায়ন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। নানা বিষয়ের বই পড়তে ভালোবাসতেন। শুধু পড়াশুনাই নয় সঙ্গীতের দিক থেকেও বেশ দক্ষ ছিলেন। বাঁশি ও সেতার, বাজাতেও জানতেন। তবে তাঁর জীবন সংগ্রামের দিকে বাঁক নিয়েছিল প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীন সময়ে তাঁর সাথে ঘটা একটি ঘটনার মাধ্যমে। এই ঘটনাটি ছিল ব্রিটিশ প্রফেসর রাসেল ভারতীয়দের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেন। তিনি সহ্য করতে না পেরে ব্রিটিশ প্রফেসরকে জুতো ছুঁড়ে আঘাত করেন। এর ফলে তাঁকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল কলেজ থেকে।
সেই সময় সশস্ত্র বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল বাংলা। ১৯০৪ সাল বিপ্লবী কর্মকান্ড পথে পা রাখেন উল্লাস। তাঁর এই নতুন জীবনের শিক্ষাগুরু ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল। তাঁর অণুপ্রেরণায় তিনি যোগদান করেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে। সেই সময় থেকে তিনি শার্ট-প্যান্ট পরিত্যাগ করে ধুতি পরিধান করেন। এরপর থেকে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন বৈপ্লবিক পথে। যোগদান করেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন ঘোষের বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’ দলে। সেই সময় কলকাতার মানিকতলায় ৩২ নং মুরারি পুকুর লেনের বাগানবাড়িতে বারীন ঘোষ গড়েছিলেন সশস্ত্র আন্দোলনের আখড়া। সেখানে বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো কুস্তি খেলা, লাঠি খেলা, ছোরা চালানো, পিস্তল চালানো, বোমা তৈরি করা প্রভূতি। সেই সময় সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য বোমা তৈরি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল।সেইসময় অন্যতম বিখ্যাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোই বিদেশ থেকে বোমা তৈরির পদ্ধতি শিখে আসেন। তারপর এই বাড়িতে তিনি বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেন বিপ্লবীদের। অন্যদিকে উল্লাস শুরু করেন এই বোমা আরো শক্তিশালী বানানোর প্রক্রিয়া। তিনি বোমা তৈরির কাজে রসায়নে অর্জিত বিদ্যা কাজে লাগান এবং বহু গবেষণা করেন। অবশেষে তিনি শক্তিশালী বোমা তৈরি করার কাজে সফল হন।
ওই সময়ে বারীন ঘোষের নেতৃত্বে ‘যুগান্তর’ দলের ক্রমাগত সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য বিপ্লবীদের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল বোমা ও পিস্তল। এরপর বোমা তৈরি করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে উল্লাসকরের কাঁধে। বোমার শক্তি পরীক্ষা করার জন্য দেওঘরে যান উল্লাসকর, প্রফুল্ল চক্রবর্তী সহ আরও কয়েকজন বিপ্লবী এবং সেখানে গিয়ে তৈরি করা বোমার শক্তি পরীক্ষা করার জন্য পাহাড়ের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। এই পরীক্ষা করতে গিয়ে বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তীর মৃত্যু হয় এবং উল্লাসকর দত্ত গুরুতরভাবে আহত হন। এরপর উল্লাসকরকে গোপনে কলকাতায় এনে চিকিৎসা করা হয়।
সেই সময় ‘যুগান্তর’ দলের গেরিলা আক্রমণ ব্রিটিশ সরকারের ভীত নড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল মুজফ্ফরপুরে অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী তার গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন। কারণ ওইদিন ওই গাড়িতে কিংসফোর্ডের বদলে ছিলেন ইংরেজ মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা সন্তান। এই অভিযানে এই দুই বিপ্লবীর ব্যবহৃত করার বোমা তৈরি করেছিলেন উল্লাস কর। এরপরে ব্রিটিশ সরকার শুরু করে সারা ভারত জুড়ে তল্লাশি। এই অভিযানে তারা খুঁজে পায় মানিকতলার মুরারি পুকুর লেনের এই বাড়িটি। সেখান থেকে তারা উদ্ধার করে বোমা তৈরির সরঞ্জাম, কার্তুজ, গুলি, তাজা বোমা এবং সেগুলি বাজেয়াপ্ত করে। ব্রিটিশদের এই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেন্ট ক্রেগান এবং তাঁর বিখ্যাত গোয়েন্দা বিনোদকুমার গুপ্ত। এরপর ওই বছরেরই ২ মে গ্রেপ্তার করা হয় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ এবং উল্লাসকর দত্ত সহ আঠারোজন বিপ্লবীকে। শুরু হয় আলিপুর কোর্টে তাদের বিরুদ্ধে মামলা। বিপ্লবীদের হয়ে এই মামলা লড়েন ব্যারিষ্টার তথা দেশপ্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাশ। চিত্তরঞ্জন দাশ এবং অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই মামলা দীর্ঘ আটদিন চলার পর চিত্তরঞ্জন দাশ তার বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি মুক্তি দেন অরবিন্দ ঘোষ ও নগেন্দ্রনাথ গুপ্তকে। তবে এই মামলার রায়ে ফাঁসির আদেশ হয় উল্লাসকর দত্ত ও বারীন ঘোষের। এই রায় শোনার পর উল্লাসকর দত্ত বিচারকে একটি অনুরোধ করেন। এই অনুরোধটি হল গান গাওয়ার। বিচারক অনুমতি দিতেই ভরা আদালত কক্ষে গেয়ে উঠেলেন ‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে’ গানটি। তাঁর মুখে বিরাজ করছিল হাঁসি। তাঁর এই ব্যবহারে তাজ্জব করে দিয়েছিল ব্রিটিশদেরকে।
তবে পুনরায় এই রায়ের উপর আপিল করার ফলে ১৯০৯ সালে উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির রায় পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি দেওয়া হয়। এই মামলা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে ‘আলিপুর বোমা মামলা’ নামে খ্যাত হয়ে রয়েছে। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া আন্দামানের সেলুলার জেলে। আন্দামানের সেলুলার জেল যা বলা হতো ‘কালাপানি’। জীবন্ত থেকে নরক বাস করার কথা আমরা শুনেছি, কিন্তু ওই সময় এই জেলে থাকা বন্দীরা এটা ভোগ করেছে। এই জেলে বন্দি বিপ্লবীদের অবস্থার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল নানা জায়গায়। এই জেলে বিপ্লবীদের উপর চলত অমানুষিক খাটুনির পাশাপাশি অকথ্য অত্যাচার এবং শাস্তি। বিশ্রাম না দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘানি টানানো থেকে শুরু করে গাছ কেটে লাকড়ি বানানো, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাটি কেটে ইট তৈরির কাজ করানো হত বিপ্লবীদের। আর যদি কেউ একটু দাঁড়িয়ে পড়তো তাহলে তাঁকে মোটা মোটা লাঠি, চাবুক দিয়ে আঘাত করা হত। তাতেও না হলে, দু’হাত বেঁধে টেনে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। এরপর চলত আরও নির্যাতন। এই অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল উল্লাস করকেও। যার ফলে তিনি গভীরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন জেলের মধ্যে। অসুস্থ হয়েও তাঁকে রেহাই দেয়নি ব্রিটিশরা। জেলে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন সময়েও তাঁকে একাধিকবার ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে তাঁর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এরপর ১৯১৪ সালে তাঁকে আন্দামান থেকে মাদ্রাজের মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই তাঁর বাকি চিকিৎসা করা হয়। অবশেষে দীর্ঘ এগারো বছর পর অর্থাৎ ১৯২০ সালে কারাবাস থেকে তিনি মুক্তি পান। মুক্তিলাভের করলেও ব্রিটিশরা তাঁর শরীর এবং মন এমনভাবে ভেঙে দিয়েছিল যে তিনি আর ফিরতে পারেননি সক্রিয় বিপ্লবের ময়দানে। ১৯৩১ সালে পুনরায় তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল ব্রিটিশ সরকার। দীর্ঘ ১৮ মাস পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর তিনি ফিরে আসেন তার নিজের জন্মভূমি কালিকচ্ছ গ্রামে।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনতা লাভের পর তিনি তার জন্মভূমি কালিকচ্ছ গ্রামের মানুষদের উন্নয়ন ও সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। স্বাধীনতার নামে দেশভাগকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি তিনি। যার ফলে ভারত সরকার তাঁকে ভাতা দিতে চাইলেও তিনি সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৫৭ সালে তিনি ব্রিটিশ মুক্ত কলকাতায় প্রথমবার পা রাখেন। সেই সময় তিনি জানতে পারেন তাঁর শিক্ষাগুরু স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনচন্দ্র পালের কন্যা তথা তাঁর বাল্যকালের বান্ধবী লীলা বিধবা এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার কথা। সারা জীবন যিনি নিঃসঙ্গ হয়ে কাটিয়েছিলেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সে তিনি তাঁর সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন লীলাকে। তিনি ৬৩ বছর বয়সে বিবাহ করেন লীলাকে। তাঁরা বিয়ের পরে প্রথমে ওঠেন রামমোহন লাইব্রেরির বারান্দায়। এরপর তাদের বাসস্থান পরিবর্তন হতে থাকে। কিছুদিন তারা টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে একটা ছোট্ট ঘড়ে ভাড়া থাকতেন। এরপর তারা বৌবাজারের একটা ভাড়াবাড়িতেও ছিলেন।
শেষ বয়সে তাঁকে চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হলেও তিনি তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসায় কোন খামতি রাখেননি। এরপরে তাঁর সহৃদয় বন্ধুদের সহযোগিতায় তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান শিলচরে। সেখানের বাসিন্দারাই তাঁদের দেখাশোনা ও ভরণপোষণের দায়িত্বগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬২ সালে মৃত্যু হয় লীলার। তিনি পুনরায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।
১৯৬৫ সালের ১৭ মে শিলচরে মৃত্যুবরণ করেন উল্লাসকর দত্ত। তাঁর স্মৃতিতে তাঁর নামে নামকরণ করা রয়েছে কলকাতা এবং শিলচরে দুটি রাস্তার। তিনি তাঁর কারাবন্দী জীবনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘কারাজীবন’ ও ‘দ্বীপান্তরের কথা’ নামক দুটি গ্রন্থে।