অক্ষরধাম মন্দিরে NSG যেভাবে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করেছিল
দিনটা ২৪ ডিসেম্বর, ২০০২ সাল, আমেদাবাদ রেলওয়ে স্টেশনে বেলা চারটের সময় বারেলি থেকে আসা ট্রেন থেকে দুজন যুবক নামে। কাঁধে বড় ব্যাগ নিয়ে থাকা এই দুই যুবক খুব দ্রুত স্টেশনের বাইরে থাকা ২২৩৪ নং এর সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে উঠে পড়ে। এই দুই যুবক পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর ই তৈবার সদস্য। এদের পাকিস্তানি ইনটেলিজেন্স আইএসআই গুজরাটে নাশকতার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিল। এই দুই সন্ত্রাসীর কারনে বহু সাধারন মানুষের প্রান গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত এনএসজি কম্যান্ডোদের চেষ্টায় এই দুই জঙ্গীকে খতম করা হয়। পাকিস্তান এমনই একটি দেশ যেটি তৈরি হওয়ার পর থেকেই ভারতে নাশকতার চেষ্টা করে আসছে।
আজ ২০২৪ সালে এসেও অর্থনৈতিক ভাবে দেওলিয়া হয়ে গেলেও অন্যান্য দেশ থেকে ঋন নিয়েও ভারত বিরোধী সন্ত্রাসী কার্যকালাপ চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ইনটেলিজেন্সের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানকে সমস্ত নাশকতার বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব দিচ্ছে ভারত।
২৪ ডিসেম্বর, প্রতিদিনের মতোই সেদিন অক্ষরধাম মন্দিরে পুন্যার্থীদের ভিড় রয়েছে। হঠাৎই মন্দিরের তিন নং দরজার বাইরে সেই ২২৩৪ অ্যাম্বাসাডরটি এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে নেমেই দুই যুবক মন্দিরে প্রবেশের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে। দরজার নিরাপত্তা রক্ষী ওই দুই যুবককে ব্যাগ খোলবার কথা জানালে তারা সেখান থেকে ফিরে গিয়ে একটু দূরে যায় এবং ব্যাগ থেকে একে ৪৭ বন্দুক বার করে এলোপাথাড়ি গুলি চালানো শুরু করে। মহূর্তের মধ্যে ৩ নং দরজার বাইরে থাকা মানুষজন গুলিবিদ্ধ হয় এবং এই দুজন জঙ্গী মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করে। ২৩ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত অক্ষরধাম মন্দিরের চারদিকে সাতফুট উচ্চ পাঁচিল রয়েছে। সন্ত্রাসীরা যে দরজা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেছিল সেই দরজার সামনে থেকে একটি লম্বা সোজা বাঁধানো পথ মন্দিরের মূল কক্ষ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। পথের দুধারে সুন্দর বাগান ও একটি বুক স্টল রয়েছে, কীছুটা দূরে অডিটোরিয়াম ১ রয়েছে। জঙ্গীরা বুকস্টলে থাকা মানুষদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অডিটোরিয়াম ১ এর দিকে এগিয়ে যায়। মন্দিরের মূল কক্ষে থাকা মানুষরা ততক্ষনে পনেরো ফুট লম্বা বড় দরজা বন্ধ করে দিয়ে মন্দিরের মূল কক্ষে পৌঁছানোর রাস্তা বন্ধ করে দেয়। মন্দিরের মূল পূজারী গুজরাট পুলিশকে এই ঘটনা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। কিছুক্ষনের মধ্যে গুজরাট পুলিশ মন্দিরে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু ততক্ষনে এই ঘটনা পুলিশের হাতের বাইরে চলে গেছে। ওই দুই জল্লাদ মন্দিরে নরহত্যায় মেতে ওঠে রীতিমতো। মন্দিরের মূল কক্ষে পৌঁছাতে না পেরে ওই দুই জঙ্গী এরপর অডিটোরিয়াম ১এ প্রবেশ করে অন্ধকারের মধ্যে গুলি চালানো শুরু করে। গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ততক্ষনে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডাবানিকে গুজরাটে দ্রুত এনএসজি পাঠানোর কথা জানিয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষন পর হরিয়ানার মানেসর থেকে এনএসজির ৬০ কম্যান্ডো পালাম এয়ারবেস থেকে অক্ষরধাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অডিটোরিয়াম ১এ গনহত্যা করবার পর ওই দুই জঙ্গী মন্দিরের মূল কক্ষের পাশে থাকা অডিটোরিয়াম ২এ প্রবেশ করে কিন্তু সেসময় অডিটোরিয়াম ২ সম্পূর্ন রূপে ফাঁকা ছিল। বহুক্ষন কেটে যাবার পরেও অডিটোরিয়াম ২ থেকে জঙ্গীরা না বেরোতে গুজরাট পুলিশের কম্যান্ডোরা মন্দির চত্বরে প্রবেশ করে বুক স্টল ও অডিটোরিয়াম ১এ বেঁচে যাওয়া মানুষদের উদ্ধারকার্য শুরু করে কিন্তু হঠাৎই সন্ধ্যা ৭:৩০ নাগাদ ওই দুই জঙ্গী পুনরায় অডিটোরিয়াম ২ থেকে বেরিয়ে গুলি চালানো শুরু করে। তবে এবার গুজরাট পুলিশও তাদের দিকে গুলি চালানো শুরু করে ফলে বাধ্য হয়ে সন্ত্রাসী দুজন পুনরায় অডিটোরিয়াম ২এ ঢুকে যায়। রাত দশটা নাগাদ অক্ষরধাম মন্দিরের বাইরে আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত এনএসজি কম্যান্ডোরা এসে উপস্থিত হয়। প্রথমেই এনএসজির স্নাইপাররা মন্দিরের চারপাশে নিজেদের অবস্থান নিয়ে নেয়। রাত ১১:৩০ নাগাদ এনএসজি কম্যান্ডোরা মেজর যোশীর নেতৃত্বে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করে। কিছুটা এগোনোর পরেই হঠাৎ একজন জঙ্গী এনএসজি কম্যান্ডোদের উদ্দেশ্যে গুলি চালিয়ে বাগানে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। সাথেসাথে এনএসজি কম্যান্ডো ও ওই জঙ্গীর মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয় যাতে ওই জঙ্গীর মৃত্যু হয়। মেজর যোশীও আহত হন। তাকে মন্দিরের বাহিরে নিয়ে এসে চিকিৎসা করা হয়। মন্দিরে তখনও একজন সন্ত্রাসী লুকিয়ে ছিল। ডাক্তার মেজর যোশীকে মন্দিরে যেতে বারন করেছিল কিন্তু দেশের প্রতি নিয়োজিত প্রান মেজর যোশী ভোর পাঁচটায় পুনরায় মন্দিরে প্রবেশ করেন। বাকী একজন জঙ্গী ততক্ষনে অডিটোরিয়াম ৩এ থাকা ৮০ জনকে বন্দী বানিয়ে ফেলেছিল। মেজর যোশী ও তার একজন সাথী অডিটোরিয়াম ৩ এর ছাদে উঠে পড়ে। মেজর যোশী জানে ভিতরে থাকা জঙ্গী জানে না তার সাথীর মৃত্যু হয়েছে সে কীছুক্ষন পর হলেও একবার তার সাথীকে খুঁজতে বাইরে আসবেই। এজন্য মেজর যোশী অপেক্ষা করতে শুরু করেন। আধঘন্টা পর স্নাইপারের থেকে মেজর যোশী বার্তা পান ওই জঙ্গী অডিটোরিয়াম ৩ এর বাইরে এসে গেছে। কিন্তু ওই জঙ্গী বাইরে একা আসেনি, তার সাথে একজন বন্দীকেও নিয়ে এসেছিল।
মেজর যোশীর নামার আগেই পুনরায় ওই জঙ্গী ভিতরে ঢুকে যায়। স্নাইপারের থেকে এই বার্তা পেয়ে পুনরায় অপেক্ষা করা শুরু করে মেজর যোশী। কিছুক্ষন পর আবারও স্নাইপারের মাধ্যমে মেজর যোশী জানতে পারেন ওই জঙ্গী বাইরে এসেছে এবং তার সাথে একজন বয়স্ক মহিলা রয়েছে। মেজর যোশী জানতেন তার কাছে একটি মাত্র সুযোগ আছে, সামান্য ভুলও ওই বয়স্ক মহিলার জীবনহানির কারন হবে। মেজর যোশী এক ঝটকায় নীচে সন্ত্রাসীর সামনে গিয়ে সরাসরি তার মাথায় গুলি করে। অতর্কিত এই ঘটনায় কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগেই গুলি ওই জঙ্গীর মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। এর মধ্যেই এনএসজির অপারেশনে মন্দিরে প্রবেশকরা দুই জল্লাদের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় ৩৩ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল যার মধ্যে এনএসজি কম্যান্ডো সুরেশ চন্দ্র যাদবও ছিল, ৮০ জন আহত হয়েছিল। আরেকজন এনএসজি কম্যান্ডো প্রায় দুই বছর কোমায় থাকার পর বীরগতি প্রাপ্ত হন।