অফবিট

আমেরিকার ভুলেই পৃথিবীর ঘাতক জঙ্গি সংগঠন আল কয়েদা তৈরি হয়েছিল। আমেরিকা ছাড়াও আর কোন কোন দেশ এর পেছনে ছিল?

সময়টা ২৪ নভেম্বর, ১৯৮৯ সাল, পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরের এক রাস্তায় হঠাৎই একটি তীব্র গাড়ি বোমা বিস্ফোরন হয় যাতে গাড়িতে থাকা এক ব্যক্তি ও তার দুই ছেলের মৃত্যু হয়। ওই বিস্ফোরনে মৃত ব্যক্তিটির নাম ছিল ইউসুফ আবদুল্লাহ আজম যাকে আফগানিস্তান সন্ত্রাসবাদের জনক বলা হত। ইউসুফ আবদুল্লাহর মৃত্যু আল কায়েদার মতোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সৃষ্টির কারনে হয় যারা আমেরিকাতে ৯/১১ এর মতোন সন্ত্রাসী আক্রমনের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে একাধিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের পর পুরো আরব বিশ্বে অস্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় কারন ছিল এই আল কায়েদা সংগঠনই। একটা সময় আল কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন এবং আয়মান আল জাওহিরি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত সন্ত্রাসী। 

আল কয়েদা তৈরি হওয়ার পটভূমি ১৯৭৮ সালেই তৈরি হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালের দিকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চরমে ছিল। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন গোটা বিশ্বে নিজ নিজ প্রভাব বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করছিলো, এই ঘটনাই আল কায়েদার মতো সংগঠন তৈরিতে সহায়তা করে যার সূচনা হয় আফগানিস্তান থেকে। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসে। নতুন সরকারের কর্মসূচিতে স্থানীয় আফগানিরা খুশি ছিলনা তারা মনে করতো এর ফলে তাদের ধর্ম সংকটে পড়ে যাবে। এর জন্য তারা সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমানোর জন্য ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেনাবাহিনী পাঠায় আফগানিস্তানে। ঠিক এটারই সুযোগ নেয় আমেরিকা। আমেরিকা আফগানিস্তানে সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না এসে সেখানকার স্থানীয় মানুষদের বোঝাতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ইসলামি সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরো আরব বিশ্ব দখল করতে চায়। সৌদি আরব ও পাকিস্তানকেও আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে কাজে লাগায়। আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ অপারেশন সাইক্লোন শুরু করে যার মাধ্যমে পাকিস্তানের সহায়তা আফগানিস্তান স্থানীয় যুবকদের অর্থ ও অস্ত্র সহয়তা ও প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করে যাতে তারা সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। একটি তথ্য অনুযায়ী সিআইএ অপারেশন সাইক্লোনে সেসময় দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলো কিন্তু আমেরিকা যেহেতু সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি, সেজন্য আমেরিকার দরকার ছিল এমন একটি সংস্থার যার সাহায্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সাধারন মুসলিমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চলে যাবে। এই উদ্দেশ্যেই আমেরিকার অর্থ সাহায্যে আফগানিস্তানে গঠন করা হয় মাকতাব আল খিদমত নামক একটি সংস্থা। কিন্তু আমেরিকা তখন ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এই সংস্থা পরবর্তীকালে আল কায়েদা নমাক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে কুখ্যাত হবে। মাকতাব আল খিদমত গঠনের সময়েই ইউসুফ আবদুল্লাহ আজমের নাম সামনে আসে। ফিলিস্তিনে জন্ম হলেও ইউসুফ আজম সিরিয়া ও মিশরে তার পড়াশোনা সম্পূর্ন করে পরবর্তীকালে সৌদি আরবের কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ওসামা বিন লাদেনও পড়েছিলো। এখানে আজমের সংস্পর্শে আসে লাদেন। ইউসুফ আজমের চিন্তাধারায় ব্যাপক প্রভাবিত ছিল ওসামা বিন লাদেন। 

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠানোর পরেই ইউসুফ আজম সৌদি আরব ছেড়ে পেশোয়ারে চলে আসে। পাকিস্তানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি আজম স্থানীয় যুবকদের সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষনও দিত। ১৯৮১ সালে ওসামা বিন লাদেনও সৌদি আরব থেকে পেশোয়ারে চলে আসে সোভিয়েত আফগান যুদ্ধে যোগ দিতে। কিন্তু ইউসুফ আজম লাদেনকে পুনরায় সৌদি আরব পাঠায় অর্থ সংগ্রহে। সৌদি আরবের একটি ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে ছিল ওসামা বিন লাদেন, তার বাবার সাথে সৌদি রাজ পরিবারের ভালো সম্পর্ক ছিল। এজন্য লাদেন সৌদি আরবে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। এরপর লাদেন পুনরায় পেশোয়ার ফিরে আসে। ১৯৮৪ সালে ইউসুফ আজম একটি নতুন সংগঠন মাকতাব আল খিদমত তৈরি করে যেখানে লাদেনের পাশাপাশি আয়মান আল জাওহিরিকেও যুক্ত করে আজম। ১৯৮৪ সালে মিশরের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আল জাওহিরি পাকিস্তান গিয়ে মাকতাব আল খিদমতে যোগ দেয়। পেশায় একজন ডাক্তার আল জাওহিরি, ১৯৮১ সালে মিশরের রাষ্ট্রপতিকে হত্যায় অভিযুক্ত হিসাবে তিন বছর মিশরের জেলে বন্দী ছিল। পরবর্তীকালে আল জাওহিরিই লাদেনকে মাকতাব আল খিদমত থেকে আলাদা করে আল কায়েদা গঠন করে। পাকিস্তানের আইএসআই, আমেরিকার সিআইএ এবং সৌদি আরবের রয়েল ইনটেলিজেন্স এই সংগঠনে অর্থায়নে যুক্ত ছিল। আজম নিজেও আমেরিকা সফরে গিয়েছিল অর্থ সংগ্রহের জন্য। আমেরিকার ৩৩টি শহরে সেসময় মাকতাব আল খিদমতের শাখা ছিল যাদের আমেরিকাতে আরব সার্ভিসেস ব্যুরো নাম দেওয়া হয়েছিল। ৯/১১ আক্রমনের পর আমেরিকা দেশে এই সমস্ত শাখা বন্ধ করে দিয়েছিল। এই সংগঠন থেকে জিহাদ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করা হত যা আফগানিস্তান মানুষদের মধ্যে পৌঁছে দিত ওসামা বিন লাদেন। এই জন্য আফগানিস্তানে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল ওসামা বিন লাদেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আল জাওহিরি ও ইউসুফ আজমের মধ্যে মতাদর্শ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ইউসুফ আজম মাকতাব আল খিদমতকে সরাসরি কোনও সামরিক সংগঠন হিসাবে ব্যবহার না করে রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে তৈরি করতে চাইছিলো। কিন্তু আল জাওহিরি ও ওসামা বিন লাদেন গোরিলা যুদ্ধের পক্ষে ছিল। আল জাওহিরিই লাদেনকে ইউসুফ আজমের বিরুদ্ধে করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তানে পরাজয়ের পর ইউসুফ আজম আফগানিস্তানে মুজাহিদ সরকার গঠন করতে চাইছিলো কিন্তু লাদেন চাইছিলো জিহাদ সমস্ত মুসলিম দেশে ছড়িয়ে দিতে। এই কারনে ১৯৮৭ সালে লাদেন মাকতাব আল খিদমত থেকে সম্পূর্ন আলাদা হয়ে যায়। ১৯৮৮ সালের ১১ আগস্ট লাদেন ও আল জাওহিরি যৌথভাবে আল কায়েদা নামে একটি নতুন সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে। প্রবল জনপ্রিয়তার কারনে ওসামা বিন লাদেনকে আল কায়েদার নেতা ঘোষনা করা হয়। অন্যদিকে ইউসুফ আজম সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান যোদ্ধাদের সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। 

১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দশ বছরের যুদ্ধ শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী দেশে ফিরে যায়। আমেরিকাও ইউসুফ আজমের থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এরকম পরিস্থিতিতে হঠাৎই ১৯৮৯ সালের ২৪ নভেম্বর ইউসুফ আজম ও তার দুই ছেলের গাড়ি বোমা বিস্ফোরনে মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পেছনে কারা দায়ী আজও জানা যায়নি। বলা হয় ওসামা বিন লাদেনই ইউসুফ আজমকে হত্যা করায়। 

১৯৮৮ সালে আল কায়েদা তৈরি হলেও অর্থাভাবে সংগঠনটি তেমন সক্রিয় ছিলনা। যার জন্য পুনরায় ১৯৮৮ সালে সৌদি আরব যায় লাদেন অর্থ সংগ্রহের জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোন সুপার পাওয়ারকে পরাজিত করায় সৌদি আরবে রীতিমতো নায়কের মতো অভ্যর্থনা জানানো হয় লাদেনকে। ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন হঠাৎই কুয়েত আক্রমন করে। সাদ্দামের সেনাবাহিনী সৌদি আরবের সীমানায় এসেও উপস্থিত হয়। কিন্তু আমেরিকার কারনে সৌদি আরব রক্ষা পায়। ওসামা বিন লাদেন আমেরিকার সহায়তার বিরোধীতা করেছিল। যার জন্য সৌদি সরকার লাদেনকে দেশ থেকে নির্বাসিত করে তার নাগরিকত্ব খারিজ করে দেয়। লাদেন সুদান চলে যায় কিন্তু সেখান থেকেও আমেরিকার চাপে তাকে বের করে দেওয়া হয়। সুদান থেকে লাদেন আবারও আফগানিস্তানে পালিয়ে আসে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ১৯৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা করিয়েছিল। কিন্তু এই হামলা ততটা সফল হয়নি, এতে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছিল। আফগানিস্তানে ওসামা লাদেন ও আল জাওহিরি রীতিমতো আল কায়েদার ভীত মজবুত করে ১৯৯৬ সালের মধ্যে এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। আল কায়েদা শুধু আমেরিকাতে নয় ভারতেও সন্ত্রাসী হামলা করেছে অনেকবার। 

১৯৮৫ সালে ওসামা লাদেনের সহয়াতায় হাফিজ সৈয়দ লস্কর ই তৈবা সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে। এই সংগঠনই ২৬/১১ এর মতো সন্ত্রাসী হামলা করে ভারতে। কাশ্মীর উপত্যকাতে সবচেয়ে বড় জঙ্গি সংগঠন জইশ ই মহম্মদের নেতা মাসুদ আজাহারও আল কায়েদার সাথে যুক্ত। তবে ২০০১ সালে ৯/১১ এর পর থেকেই আল কায়েদার পতন শুরু হয়। কারন আমেরিকা আফগানিস্তানে সেনা পাঠায়। দীর্ঘ কয়েক বছরের অভিযানের পর ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে এবং ২০২২ সালে আয়মান আল জাওহিরি দুজনকেই হত্যা করে আমেরিকা। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর ইরাকের আল কায়েদা সংগঠন আইএস আইএস নামক সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বর্তমানে সেই আইএস আইএসেরও আর কোনও অস্তিত্ব নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *