অফবিট

ভারতবর্ষের অন্যতম ধনী রাজ্য হতে চলেছে উত্তরাখন্ড

৮৬ শতাংশ পাহাড়ে ঘেরা মোনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ভারতের একটি রাজ্য হচ্ছে উত্তরাখন্ড। বর্তমানে ভারতবর্ষে নতুন উদ্যোক্তা সংস্থা বা স্টার্টআপ সংস্থাদের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে এই রাজ্যটি। ২০২২ সালে ভারতের বানিজ্য ও শিল্প মন্ত্রনালয় উত্তরাখন্ডকে ভারতের স্টার্টআপ সংস্থাগুলির মূলকেন্দ্র ঘোষনা করে। উত্তরাখন্ড রাজ্যের এই অভূতপূর্ব উন্নয়ন দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই ঘোষনা করে দিয়েছেন এই দশক উত্তরাখন্ডের হতে চলেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি দেরাদুনে অনুষ্ঠিত হওয়া বৈশ্বিক বিনিয়োগ সম্মলনে উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে উত্তরাখন্ডে বিভিন্ন সংস্থা ৩.৫ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষনা করেছে। ভারতের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন রাজ্য উত্তরাখন্ডে অধিকাংশ পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে শিল্প কারখানা বা উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি হওয়া একপ্রকার অসম্ভব। ২০২০ পর্যন্ত ভারতের স্টার্টআপ সংস্থার শীর্ষে ছিল ব্যাঙ্গালোর, সেসময় ভারতের প্রথম দশ রাজ্যের মধ্যেও ছিলনা উত্তরাখন্ড। কিন্তু মাত্র তিন বছরে বিজেপি সরকারের নেতৃত্বে এই রাজ্যে এতটাই উন্নয়ন হয়েছে যে উত্তরাখন্ড অধিকাংশ নতুন সংস্থার প্রথম পচ্ছন্দের জায়গা। উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি ২০২৫ এর মধ্যে উত্তরাখন্ডকে আত্মনির্ভর রাজ্য তৈরি করার দাবী করেছে।

উত্তরাখন্ড সরকার পাঁচটি নতুন নীতি তৈরি করেছে রাজ্যটির উন্নয়নের জন্য। এদের মধ্যে এমন একটি নীতি রয়েছে যা কোনও বিনিয়োগ ছাড়াই উত্তরাখন্ডের বহু মানুষকে উপকৃত করেছে। এই নীতিতে উত্তরাখন্ডের প্রতিটি বাড়ির লোকই ঘরে বসে উপার্জন করতে সক্ষম। এই নীতির নাম হচ্ছে হোমস্টে নীতি। কোনও পর্যটন এলাকার মানুষ সাধারনত নিজের বাড়ির একটি বা দুটি ঘরকে ভাড়া দেয় যাতে পর্যটক গিয়ে সেখানে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে থাকা, খাওয়া করতে পারে, একেই হোমস্টে বলে। সিকিম, অরুনাচল প্রদেশ, মেঘালয়ের মতো রাজ্যে আগে থেকেই এই হোমস্টে সংস্কৃতি রয়েছে কিন্ত উত্তরাখন্ডে হোমস্টে সংস্কৃতি আগে ততটা প্রচলিত ছিলনা। কিন্তু উত্তরাখন্ড সরকার হোমস্টে নীতি চালু করার পর থেকে রাজ্যটির ৮৫০ গ্রামের মানুষ যারা আগে কর্মসূত্রে বাইরে চলে গিয়েছিল তারা ফিরে এসেছে। পাহাড়ে ঘেরা উত্তরাখন্ড রাজ্য বরাবরই পর্যটন শিল্পের উপরই অধিকাংশ নির্ভরশীল। কিন্তু করোনা মহামারীর সময় সারাদেশ জুড়ে লকডাউন থাকায় এখানকার মানুষ বাধ্য হয়ে কর্মসূত্রে অন্যত্র যাচ্ছিল কিন্তু এবার বাইরে যাওয়া মানুষগুলোই ফিরে আসছে নিজের গ্রামে। মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি নিজে সরকারি বাংলোর তুলনায় হোমস্টেতে থাকার প্রচার করছেন। উত্তরাখন্ডে বর্তমানে ব্যাপক আকারে হোমস্টে ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। 

পর্যটকরাও হোটেলের বদলে হোমস্টে থাকাই বেশী পচ্ছন্দ করছে কারন এতে স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও বেশী জানা যায়। যেমন উত্তরাখন্ডের পওরি গাড়োয়াল জেলায় একটি ছোট গ্রাম সড, এখানকার ৮৫টি পরিবারের মধ্যে ৬০টি পরিবারই হোমস্টে চালায়। শুধু সডই নয় উত্তরাখন্ডের প্রত্যন্ত এলাকাতেও আজ হোমস্টে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই এয়ারবিএনবির মতোন বড় সংস্থা রয়েছে যারা হোমস্টের বুকিং করে। কিন্তু উত্তরাখন্ড সরকার এয়ারবিএনবিতে কিছু সমস্যা খুঁজে পায় এবং সেটা সমাধান করে তাদের নিজস্ব হোমস্টে নীতিতে। এয়ারবিএনবির উপর প্রায়ই পর্যটকরা প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ করে, টুইটারে এয়ারবিএনবি স্ক্যামের অভিযোগ প্রচুর রয়েছে। এয়ারবিএনবিতে ঘর রেজিস্ট্রেশন করতে কোনও সরকারি সংস্থা যুক্ত থাকেনা যার কারনে এখানে প্রায়ই মানুষ প্রতারিত হয়। কিন্ত এরকম অবস্থা যাতে উত্তরাখন্ডে না হয় তার জন্য সরকার হোমস্টে নীতিতে দুটি শর্ত দিয়েছে। 

প্রথমত যে ব্যক্তি হোমস্টে নীতিতে যুক্ত হবে তাকে উত্তরাখন্ড সরকারের কাছে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে এবং দ্বিতীয়ত সেই ঘরে ঘর মালিক ও তার পরিবার থাকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে এয়ারবিএনবির মতোন পর্যটককে প্রতারিত হতে হয়না। এছাড়া উত্তরাখন্ড সরকারের এই হোমস্টে নীতিতে অনেক সুবিধাও রয়েছে যেমন কোনও ব্যক্তি যদি হোমস্টের জন্য রেজিস্ট্রেশন করায় তাহলে হোমস্টের জন্য ব্যবহৃত জল ও বিদ্যুৎ এর খরচ বানিজ্যিক খরচের অন্তর্ভুক্ত করা হবেনা অর্থাৎ সাধারন গৃহের জল ও বিদ্যুৎ এর খরচের মতোই বিল আসবে। কোনও ব্যক্তি যদি হোমস্টে চালাতে চায় কিন্তু তার ঘর হয়ত পুরোনো হয়ে গেছে, তাহলে এরকম ক্ষেত্রে সরকার সেই ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক ভাবেও সহয়তা করবে ঘরের উন্নয়নের জন্য। হোমস্টে নীতিতে শুধু ঘরের মালিকরাই নয় বরং পুরো এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে। যদি কোনও গ্রামে ছয়টি ঘর হোমস্টের জন্য রেজিস্টার করানো হয় তাহলে সেই গ্রামের জল সরবরাহ ও রাস্তা নির্মানের দায়িত্ব সম্পূর্ন সরকারের। প্রচুর বিদেশী পর্যটকও এখানকার হোমস্টেতে আসছে। 

২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর ২০.৭ শতাংশ হারে হোমস্টের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরাখন্ডে। হোমস্টে ছাড়া উত্তরাখন্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই উত্তরাখন্ডের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত তৈরি করে দিয়েছে। গতবছর ভারতে মোট ৩২ লাখ ডেসটিনেশন ওয়েডিং হয়েছে যাতে ৩.৭৫ লাখ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ডেস্টিনেশন ওয়েডিং এর রীতি ভারতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যার কারনে উত্তরাখন্ড সরকার উত্তরাখন্ডকে ভারতে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং এর প্রধান কেন্দ্র তৈরি করতে চাইছে। ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩এ উত্তরাখণ্ডে বৈশ্বিক বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মেক ইন ইন্ডিয়ার মতোন ওয়েড ইন ইন্ডিয়া নীতিরও প্রস্তাব দেন। তিনি ভারতের শিল্পপতিদের পরবর্তী পাঁচ বছরে তাদের পরিবারের অন্তত কোনও একজনের বিবাহ উত্তরাখন্ডে করবার জন্য বলেন। উত্তরাখন্ড সরকার ডেস্টিনেশন ওয়ডিং এর জন্য ছয়টি স্থানও নির্বাচন করে ফেলে, জিম কটবেট জাতীয় উদ্যান, তেহেরি গাড়োয়াল নরেন্দ্র নগর, মুসৌরির জর্জ এভারেস্ট পাহাড়, পিথোরাগড়ের মুন্সিয়ারি পাহাড়, গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের পাঁচটি অতিথি ভবন এবং রুদ্রপ্রয়াগের ত্রিযুগী নারায়ন মন্দির। 

হিন্দু ধর্মে বলা হয় মা পার্বতী ও ভগবান মহাদেবের বিবাহ হয়েছিল এই ত্রিযুগী নারায়ন মন্দিরেই। যেকোনও দেশ বা রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে সেখানকার পর্যটন শিল্পের একটি বড় ভূমিকা থাকে। উত্তরাখন্ড ভারতের এমন একটি রাজ্য যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশপাশি হিন্দু ধর্মের জন্যও পবিত্র তীর্থ স্থান। উত্তরাখন্ডকে দেবভূমিও বলা হয়। উত্তরাখন্ডের প্রসিদ্ধ তীর্থযাত্রা হচ্ছে চারধাম যাত্রা। বলা হয় প্রত্যেক হিন্দুকে জীবনে একবার চারধাম যাত্রা করা দরকার। আদিশঙ্করাচার্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ভারতের উত্তরে বদ্রীনাথ, পূর্বে পুরী, দক্ষিনে রামেশ্বরাম এবং পশ্চিমে দ্বারকা যাত্রাকে চারধাম যাত্রা বলে। কিন্তু এই পুরো যাত্রায় ৬,০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় যা সময় সাপেক্ষ। সেকারনে উত্তরাখন্ডে বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, যমুনোত্রী ও গঙ্গোত্রীকে নিয়ে  চারধাম যাত্রা আয়োজিত হয় যা প্রকৃত চারধাম যাত্রার সমান পুন্য বলেই মনে করা হয়। এজন্য প্রতিবছর অসংখ্য হিন্দু এখানে আসে চারধাম যাত্রার জন্য। ২০২৩ সালে উত্তরাখন্ডে ৫০ লাখ পর্যটক এসেছিল। এজন্য উত্তরাখন্ড সরকার এই চারধাম উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে যাতে আরও বেশী সংখ্যক পর্যটক এখনে আসে। যেমন উত্তরপ্রদেশ সরকার বেনারসের উন্নয়নের জন্য বিশ্বনাথ করিডর তৈরি করে যাতে বেনারসে পর্যটকের সংখ্যা দুই বছরে দশ গুন বেড়ে হয়েছে প্রায় দশ কোটি। এই বিশাল তীর্থযাত্রী সংখ্যা থেকে উত্তরপ্রদেশের জিডিপিতে ব্যাপক অর্থ এসেছে। ঠিক এরকমই চারধাম উন্নয়ন প্রজেক্ট উত্তরাখন্ডের আর্থিক উন্নয়নে সহায়তা করবে। 

মন্দির ও হোমস্টে ছাড়াও উত্তরাখন্ড সরকার পুরো রাজ্যের আর্থিক বিকাশের জন্য একটি জেলা দুটি দ্রব্য প্রকল্প শুরু করেছে। যেমন হরিদ্বারের গুড় ও মধু, পিথোরাগড়ের উলের কার্পেট এভাবে উত্তরাখন্ডের প্রতিটি জেলা থেকে দুটি বিশেষ দ্রব্য নির্বাচন করে তা তৈরি, প্যাকিং, প্রচার ও বাজারজাত করায় সরকার স্থানীয় মানুষকে সহায়তা করছে, এর ফলে জেলাস্তরেও কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। উত্তরাখন্ড রাজ্যের উন্নয়নে যাতে কোনও দূর্নীতি না হয় তারজন্য মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি দূর্নীতি দমন আইন তৈরি করেছে। যাতে সরকারের বিশেষ ওয়েবসাইটে সমস্ত দূর্নীতিপরায়ন অফিসারদের নাম, ছবি, তথ্য থাকবে যাতে সরকারি কর্মচারীরা দূর্নীতি করতেও ভয় খায় লোকলজ্জার কারনে। 

৮ এপ্রিল, ২০২২ সালে ১০৬৪ মোবাইল অ্যাপ  লঞ্চ করে উত্তরাখন্ড সরকার অভিযোগ জানানোর জন্য। উত্তরাখান্ড রাজ্যের ভিজিলেন্স বিভাগ সমস্ত সরকারি কর্মচারীর উপর সবসময় নজর রাখছে এবং অভিযুক্ত কর্মচারীদের উপরে  গোপনে নজরদারিও করছে। এছাড়া ধামি সরকার পরীক্ষায় নকল ঠেকাতে অ্যান্টি চিটিং আইনও তৈরি করেছে। এই আইন অনুযায়ী কোনও শিক্ষার্থী পরীক্ষায় দুবার নকল করতে গিয়ে ধরা পড়লে তাকে ত্রিশ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসে কেউ যুক্ত থাকলে তাকে দশ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং কারাদণ্ড দেওয়া হবে। উত্তরাখন্ড সরকার রাজ্যের উন্নয়নের জন্য দূর্নীতি ও নকল কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *