অফবিট

গোটা পৃথিবী জুড়ে আমেরিকান ডলারের আধিপত্য শেষ হতে চলেছে। বদলে কি চীন, রাশিয়ার মুদ্রা রাজত্ব করবে?

বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন মিডিয়াতে বলা হচ্ছে আমেরিকান ডলারের আধিপত্য শেষ, বিশ্ববাজারে এবার রাশিয়ার রুবেল ও চীনের ইউয়ান রাজত্ব করবে। কিন্ত এটা বলাটা যতটা সহজ বাস্তবে ঠিক ততটাই কঠিন। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা হিসাবে পরিচিত আমেরিকান ডলারের আধিপত্য এত তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার কোনও সম্ভবনাই নেই। আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের নেতৃত্বে আমেরিকান ডলারের বিশ্ব মুদ্রায় পরিনত হওয়ার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এখনও দীর্ঘকাল বজায় থাকবে।

১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ৩৭তম রাষ্ট্রপতি ছিল রিচার্ড নিক্সন। তবে ভারতীয়রা রিচার্ড নিক্সনকে পচ্ছন্দ করেনা কারন রিচার্ড নিক্সন ভারত বিরোধী ছিল। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে রিচার্ড নিক্সন সরাসরি ভারতের বিপক্ষে গিয়ে আমেরিকাকে সমর্থন করেছিল। সেসময় আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে দিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে ভারতের বিরুদ্ধে কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পরমানু সাবমেরিনের কারনে আমেরিকা পীছু হটতে বাধ্য হয় এবং ভারত জয়লাভ করে। যারপরেই স্বাধীন বাংলাদেশের গঠন হয়। কিন্তু আমেরিকা সহ সৌদি আরব, চীন এবং অন্যান্য দেশের কাছে রিচার্ড নিক্সনের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। রিচার্ড নিক্সন তার সময়ে অর্থনৈতিক সংস্কারে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল তার ফল ৫০ বছর পরেও বিশ্ব পাচ্ছে। 

রিচার্ড নিক্সনের নামে নিক্সন শক নামে উইকিপিডিয়াতে একটি বিশেষ পেজ পর্যন্ত রয়েছে যা বিশ্বের অন্যকোনও রাষ্ট্রপতির নামে নেই। নিক্সন আন্তর্জাতিক স্তরে আমেরিকান ডলারের সাথে সোনার সংযোগ তুলে দেয়, আমেরিকার বিশ্ববাজারে ঋন নেওয়ার পদ্ধতিও নিক্সন পরিবর্তন করে। রিচার্ড নিক্সন ও তার বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সেসময় আমেরিকার একটি নতুন বিদেশনীতি শুরু করে। কোনওদেশ গনতন্ত্র থাকুক কী স্বৈরশাসক সেই দেশটি থেকে আমেরিকার লাভ হচ্ছে কীনা তার উপরেই দেশটির সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় থাকবে এই নীতি শুরু করে রিচার্ড নিক্সনই। রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার লক্ষ্য করে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে সৌদি আরবের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে কিন্তু সৌদি আরবের সাথে সেসময় আমেরিকার কুটনৈতিক সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ ছিল যার প্রধান কারন সৌদি আরবে গনতন্ত্র ছিলনা, রাজতন্ত্র ছিল। রিচার্ড নিক্সন চিন্তাভাবনা করে সৌদি আরবে গনতন্ত্র থাকুক কীংবা রাজতন্ত্র তাদর কোনও যায় আসেনা বরং সৌদি আরবের বিশাল খনিজ তেলের ভান্ডার এর থেকেও বেশী জরুরী। রিচার্ড নিক্সন ঠিক করে সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার কুটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করবে যাতে সৌদি আরব আমেরিকান ডলারে খনিজ তেল বিক্রি করে আন্তর্জাতিক বাজারে। 

১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জার সৌদি আরবে যায় এবং তার এই সফরে আমেরিকা ও সৌদি আরবের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক ব্যাপক মজবুত হয়। বলা হয় ১৯৭৪ সালের ৬ জুন আমেরিকা ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হয় যাতে বলা হয় আাগমী পঞ্চাশ বছর সৌদি আরব বিশ্ববাজারে আমেরিকান ডলারের খনিজ তেল বিক্রি করবে। এর বিপরীতে আমেরিকা সৌদি আরবের তেল উত্তোলন কেন্দ্র গুলিকে সামরিক নিরাপত্তা দেবে, সৌদি আরবকে প্রযুক্তি দেবে এবং সৌদি আরবের অন্যান্য বিভাগে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করবে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বহু বছর ধরেই বিবাদ রয়েছে যার জন্য আমেরিকা সৌদি আরবকে ইরানের থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। 
সৌদি আরব ও আমেরিকার মধ্যে হওয়া ওই ঐতিহাসিক চুক্তি চলতি বছরের ৯ জুন শেষ হয়ে গেছে। সৌদি আরব আর এই চুক্তি পুনর্নবীকরন করবেনা বলে জানিয়েছে। এখন আর সৌদি আরব ও আমেরিকার মধ্যে সরকারি ভাবে কোনও চুক্তি নেই। যার জন্য বলা হচ্ছে আমেরিকান ডলারের পতন ঘটতে চলেছে। কিন্ত এই বিষয়ে বেশ কিছু মতবিরোধ রয়েছে।
প্রথমত আমেরিকা ও সৌদি আরবেের মধ্যে পেট্রো ডলার নিয়ে কোনও চুক্তির ব্যাপারে কখনও সরকারি কেনও প্রমান পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত গতবছরই সৌদি আরব চীনের মুদ্রা ইউয়ানে তেল বিক্রি করেছিল অর্থাৎ যদি চুক্তি থাকতো আমেরিকা ও সৌদি আরবের মধ্যে তাহলে সৌদি আরব কখনও চীনের মুদ্রায় তেল বিক্রি করতোনা। এজন্য বেশ কিছু ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগন বলছে আমেরিকা ও সৌদি আরবের মধ্যে সরকারি ভাবে কোনও চুক্তি ছিলইনা কোনওদিন, বরং দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ছিল যে আমেরিকা ইরানের থেকে সৌদি আরবকে নিরাপত্তা দেবে এবং সৌদি আরব বেশীরভাগ তেল আমেরিকান ডলারে বিক্রি করবে। বিভিন্ন মিডিয়াতে বেশ কিছুদিন ধরে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে আমেরিকান ডলারের দিন শেষ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যদি এটা সত্য হত তাহলে ৯ জুন চুক্তি শেষ হওয়ার পর আজ প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে তাও আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের পতন হয়নি, ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপিরও তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। সৌদি আরব সরকার ও আমেরিকান সরকারও এই বিষয়ে সরকারি ভাবে কখনও কিছু জানায়নি। তবে বিশ্বের ডিডলারাইজেশন শুরু হয়ে গেছে অর্থাৎ আমেরিকান ডলারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ক্রমশ কমে আসছে তবে এই পদ্ধতি খুবই ধীর গতিতে হচ্ছে। এত দ্রুত আমেরিকান ডলারের গুরুত্ব কমবেনা। রাশিয়া ও চীন মূলত আমেরিকান ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রা ব্যবহার করছে। তবে হ্যাঁ একটা সময় অবশ্যই এমন আসবে যখন আমেরিকান ডলার বিশ্বমু্দ্রা হিসাবে আর থাকবেনা তবে সেসময় এখনও বহুদূর। বিশ্বের বাকী সমস্ত দেশকে এখনও কয়েকদশক আমেরিকান ডলারের উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। ২০২৩ সালে বিশ্বে যত খনিজ তেল কেনা হয়েছিল তার আশি শতাংশই আমেরিকান ডলারে কেনা হয়েছিল অর্থাৎ বিশ্ববাজারে আমেরিকান ডলারের আধিপত্য এখনও রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *