অফবিট

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দৈব নগরী দ্বারকা আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আরব সাগরের মধ্যে ডুবে যায়। দ্বারকা নগরী শুধু ভারতের জন্য নয় বরং তৎকালীন সময়ে উন্নত ভারতীয় সভ্যতারও প্রমান। আরব সাগর ও গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত এই দ্বারকা নগরীতে একসময় দশ হাজার মানুষ বসবাস করতো। কয়েক হাজার বছর পর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা এএসআই আরব সাগরের নীচে দ্বারকা নগরীর অস্তিত্ব খুঁজে বার করে। শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীন দ্বারকা নগরীর সম্পর্কে এমন সব প্রমান পাওয়া গেছে  যা স্পষ্ট প্রমান করে দ্বারকা কোনও কাল্পনিক নগর ছিলনা। দ্বারকা নগরীর আবিষ্কার ছিল ভারতের ইতিহাসে জলের নীচে প্রথম কোন খোঁজ।

১১৩ বিসিতে (খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) ভারতে আসেন গ্রীস রাষ্ট্রদূত হেলাডোরাস। তিনি মধ্যপ্রদেশের বিদিশাতে শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে একটি স্তম্ভ তৈরি করান এবং তাতে ব্রাহ্মী ভাষায় লেখান দেবাদিদেব বাসুদেব। প্রাচীন ভারতে প্রথম কোন বিদেশী দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের উপাসনার এটাই প্রথম প্রমান। হেলাডোরাস ভগবত গীতায় খুব প্রভাবিত ছিলেন। দ্বারকা নগরীর খোঁজ এটা প্রমান করে ভারতীয় সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতা ও মিশরীয় সভ্যতার থেকেও অনেক পুরোনো। মিশরের পিরামিড নিয়ে আশ্চর্যের দাবি করা হয়, তারও পূর্বে ভারতে আরবসাগরের মধ্যে ৮৪ কিলোমিটার জুড়ে দ্বারকা নগরী তৈরি করা হয়েছিল যা অসাধারন কারিগরি বিদ্যার প্রমান। শ্রীকৃষ্ণ যখন কংসকে বধ করেন তারপরেই জরাসন্ধ ও কালিয়াবন নামে দুই রাজা বারবার মথুরা আক্রমন করতে থাকে যার কারনে শ্রীকৃষ্ণ মথুরা থেকে দশ হাজার লোককে নিয়ে সৌরাষ্ট্র চলে আসেন। সেখানে বিশ্বকর্মা দেবকে দ্বারকা তৈরির দায়িত্ব দেন। শ্রীকৃষ্ণ চাইলে জরাসন্ধকে তখনই বধ করতে পারতেন কিন্তু জরাসন্ধের মৃত্যু লেখা ছিল ভীমের হাতে যার কারনে তিনি চলে আসেন দ্বারকায়। দুটি দ্বারকা ছিল সেসময়। একটি ছিল সমুদ্রের তীরে দ্বারকা এবং আরেকটি সমুদ্রের তীর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্বে সমুদ্রের মধ্যে, একে বেট দ্বারকা বলা হয়, শ্রীকৃষ্ণ এখানেই থাকতেন৷ 

বেট দ্বারকাকে শঙ্খধরাও বলা হত কারন এখানে বিভিন্ন রকমের শাঁখ পাওয়া যেত। সোমনাথের কাছে ভালুকা তীর্থে শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর বয়সে মানবীয় লীলা শেষ করে গোলকধামে ফিরে যান। তার আগে অর্জুনকে দিয়ে তিনি দ্বারকাবাসীদের হস্তিনাপুরে পাঠিয়ে দেন। শ্রীকৃষ্ণের গোলকধামে ফিরে যাবার সাথে মাতা গান্ধারীর অভিশাপ অনুযায়ী দ্বারকা জলমগ্ন হয়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায়। ইতিহাসে এমন অনেক সভ্যতা আছে যা জলস্তর বৃদ্ধির সাথে সাথে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। যেমন মেক্সিকোর প্রত্নতত্ত্ববিদ ইভান অ্যাসপাক ত্রিশ বছর ধরে মেক্সিকোতে অনুসন্ধান করে মায়া সভ্যতার তিনটি শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন যা বারোশো বছরের পুরোনো। ৫৭৪ এডিতে (খ্রিষ্টাব্দে) সামন্ত সিমাদত্যের পালি শিলালিপি থেকে জানা যায় পশ্চিম উপকূলে দ্বারকা সৌরাষ্ট্রের রাজধানী ছিল এবং শ্রীকৃষ্ণ এখানে থাকতেন। 

১৯৬৩ সালে ডেকান কলেজ পুনে এবং গুজরাট সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যৌথভাবে দ্বারকা শহরের প্রাথমিক অস্তিত্বের খোঁজ পান এবং পরবর্তী ষোলো বছর ধরে জলমগ্ন দ্বরকা শহরের অনেক জিনিসের খোঁজ পাওয়া যায়। ১৯৭৯ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা এএসআই দ্বারকাধীশ মন্দিরের সংরক্ষনের কাজ শুরু করে। এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় এস আর রাওকে যিনি এএসআই এর সবচেয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। এস আর আরও হরপ্পা সভ্যতার অনেক উদ্ধারকার্য করেছিলেন বিশেষ করে লোথাল শহরের। দ্বারকাধীশ মন্দিদের সংরক্ষনের সময় মন্দিরের কাছে একটি বিষ্ণু মন্দির পাওয়া যায় যা নবম শতকের। এছাড়া মন্দিরের কাছে মহাভারত সময়কালের বসতির প্রমান পাওয়া যায়। এরপরেই এস আর রাও আরব সাগরে দ্বারকার খোঁজ শুরু করেন। কারন এস আর রাও অনেক ঐতিহাসিক গ্রন্থ পড়েছিলন যা দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমুদ্রের তীরে দ্বারকা ছাড়াও সমুদ্রের গভীরে আরও একটি দ্বারকা আছে। প্রথমেই সমুদ্রের কিছুটা কাছে প্রায় পাঁচশো মিটারের একরি পাথরের দেওয়াল পাওয়া যায় যাতে অসাধারন কারুকার্যের নিদর্শন ছিল। এছাড়া প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সময়ের বেশ কিছু জিনিস পাওয়া যায়, অনেক ধরনের শাঁখ পাওয়া যায়। এরপরেই এস আর রাও সিদ্ধান্ত নেয় বেট দ্বারকার জন্য তিনি সমুদ্রতীর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে উদ্ধারকার্য শুরু করা হবে। 

সমুদ্রের তলদেশে ভারতে সেই প্রথম উদ্ধারকার্য শুরু হয়। তবে এই উদ্ধারকার্য চালাতে প্রথমে অনেক সমস্যা আসে। এই ধরনের কাজে প্রচুর ফান্ডিং লাগে, তার উপর ভারতে এই ধরনের কাজ প্রথম হওয়ায় প্রশিক্ষিত ডবুরি পাওয়া সমস্যা ছিল, জলের তলায় ফটো তোলার সঠিক ফটোগ্রাফার দরকার ছিল। সবচেয়ে বড় কথা দ্বারকার সমুদ্র উত্তাল। শুধুমাত্র নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বেলা দশটা থেকে দুটো পর্যন্তই সমুদ্রে অভিযান করা সম্ভব ছিল। ১৯৮৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রজেক্টের জন্য তিন বছরের সময় দেয় এবং পরবর্তী দুই বছররে জন্য আশি হাজার টাকার ফান্ডিং দেয়। এরপরেই কাজ শুরু হয়, তবে খানিকটা অনুমান ভিত্তিক কাজ চলছিলো কারন সমুদ্রে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে দ্বারকার একদম সঠিক অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা ছিলনা। সমুদ্রের পাঁচ মিটার থেকে ষোলো মিটার গভীরতা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চালানো হতে থাকে। প্রথমেই বেশ কিছু ঝিনুকের মুদ্রা পাওয়া যায়। সেসব মুদ্রাতে ষাঁড়, ইউনিকর্ন সহ বিভিন্ন পশুর চিহ্ন হয়। বলা হয় বর্তমান দিনের ভোটার বা আধার কার্ডের মতো এটা সেসময়ের দ্বারকাবাসীর পরিচয় পত্র ছিল। এছাড়াও ত্রিভুজাকৃতি নোঙর পাওয়া যায় অনেক যাদের বয়স মোটামুটি ১২০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই একই রকম নোঙর সিরিয়াতেও পাওয়া গেছিল যাদের বয়স ওরকমই পুরোনো যা প্রমান করে প্রাচীন ভারতে সিরিয়ার সাথে ভারতের সমুদ্র বানিজ্য চলত। 

১৯৮৭ সালের ১২-১৪ অক্টোবর গুজরাটের জামনগরে এক সম্মলনের আয়োজন করা হয়। যাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং বিজ্ঞানীরা এসেছিল। তারা দ্বারকার এসব নিদর্শন দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যায়। এরপরে আবারও সমুদ্রে অভিযান চালানো হয় যাতে প্রায় ৫৫৮ মিটার লম্বা দেওয়াল পাওয়া যায় যার বয়স ১২০০-১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। 

১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে এস আর রাওয়ের দলকে আধুনিক উপকরনে সজ্জিত একটি জাহাজ বেদবতী দেওয়া হয়, যার ফলে আরও দ্রুত উদ্ধারকাজ হতে থাকে। সমুদ্রের গভীরতা থেকে ২০৩ মিটার লম্বা একটি পাথরের স্থাপত্য পাওয়া যায়, এছাড়া ১-২ মিটার অর্ধ গোলাকৃতি একটি পাথরের খন্ড পাওয়া যায় যা দেখতে অনেকটা চন্দ্রশীলা মন্দিরের মুনস্টোনের মতোন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ অবধি এস আর রাওয়ের দল দ্বারকার সমুদ্রে উদ্ধারকাজ চলায়। এসময় তারা ঝিনুকের মুদ্রার পাশাপাশি, পাথরের স্থাপত্য, ব্রোঞ্জ, তামা, লোহার জিনিস সহ বহু বস্ত পান যাদের গড় বয়স ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ। এরপরেই এসআর রাও জানান এসব জিনিসই প্রমান করে মহাভারত কালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীর অস্তিত্ব সম্পর্কে। তিনি আরও বলেন প্রাচীন দ্বারকা নগরী তৈরি করা হয়েছিল বোল্ডার ব্লক প্রযুক্তিতে যাতে বোল্ডারের ব্লক রেখে ভিত তৈরি করে তার উপর নগর নির্মান করা হয়। বর্তমানে এই পদ্ধতি সবে ভারতে ইঞ্জিনিয়াররা ব্যবহার করা শুরু করেছে। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে এই প্রযুক্তির ব্যবহার প্রমান করে সেসময় কারিগরি বিদ্যা কতটা উন্নত ছিল। দ্বারকা জলমগ্ন হবার পেছনে মহাভারতে বলা হয়েছে মাতা গান্ধারীর অভিশাপ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ গোলকধামে ফিরে যাবার সাথে সাথে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যায় দ্বারকা নগরী। 

বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুযায়ী দ্বারকা জলমগ্ন হবার পেছনে দুটি মতবাদ বলা হয় প্রথমত বিশাল ভূমিকম্পে হয়ত এই নগরী ধ্বংস হয়ে গেছে, দ্বিতীয়ত সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধির সাথে সাথে এই নগরী জলের তলায় চলে গেছে। দ্বিতীয় কারনটিকেই সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস করা হয় কারন ভৌগোলিক তথ্য বিশ্লেষন করে দেখা গেছে ৩,৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এখানে সমুদ্রে জলস্তর প্রায় ৬০ মিটার বেড়ে গেছে যার কারনে দ্বারকা সমুদ্রের নীচে চলে গেছে। একই সময়ে সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধির প্রমান বাহরিনেও পাওয়া গেছে। ২০০০ সালে জানুয়ারিতে এসআর রাও ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রককে জানিয়েছিল এই বেট দ্বারকাকে সংরক্ষন করে রাখার কথা অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন সমুদ্রের তলায় একটি মিউজিয়াম করে দ্বারকার ঐতিহাসিক নির্দেশনকে সংরক্ষন করে রাখতে কিন্তু এখনও পর্যন্ত এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এসআর রাও সমুদ্রের তলদেশে পাওয়া দ্বারকা নগরীর ধ্বংসবশেষই যে মহাভারত কালের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা সেই ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি বলেছিলেন শুধু একটি সাইনবোর্ড পাওয়া যায়নি বাকী সমস্ত প্রমান পাওয়া গিয়েছে। 

ভারতের ইতিহাসে বলা হয় সিন্ধু সভ্যতায় ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা কিন্তু গুজরাটের আরব সাগরের তলদেশে পাওয়া দ্বারকা নগরীর চিহ্ন স্পষ্ট প্রমান করে সিন্ধু সভ্যতার আগেও একটি বিশাল উন্নত আধুনিক সভ্যতা ছিল যার প্রানপুরুষ ছিলেন স্বয়ং ভগবান বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *