শ্রীলঙ্কার মতো লাওসকে ভারত সাহায্য করবে না। কমিউনিজমের করালগ্রাসে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত লাওস
দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট দেশ লাওস। উত্তর পূর্ব ভরতের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার, মায়ানমারের পরে রয়েছে থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়া। এই থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, চীন ও ভিয়েতনামের সাথে সীমানাযুক্ত একটি দেশ লাওস। আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে লাওস একমাত্র দেশ যার কোনও সমুদ্রসীমা নেই অর্থাৎ লাওস ল্যান্ড লকড দেশ। লাওসের অতীত জড়িয়ে আছে চীনের ইউনান প্রদেশের সাথে। তেরো শতাব্দীতে লাও জনগোষ্ঠীকে আরও দক্ষিনদিকে পাঠিয়ে দেয় তৎকালীন চীনের সাম্রাজ্য। চীনের দক্ষিনে সেসময় হামের সাম্রাজ্যের শাসন ছিল। বর্তমানে হামের সাম্রাজ্যের অঞ্চল কম্বোডিয়ার অংশ। ১৩৫৩ সালে লাও জনগোষ্ঠীর এক যুবরাজ লাও সাম্রাজ্যের সূচনা করে এবং তার নাম রাখে লানজিয়াং যার অর্থ হাজার হাতির ভূমি। সেসময় আশেপাশের সমস্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই যুদ্ধ হত। লানজিয়াং এর সাথেও আশেপাশের রাজ্যের বহুবার যুদ্ধ হয়েছিল। ১৬৯৪ সালে লাও সাম্রাজ্যের রাজা সোলেগনাও এর মৃত্যু হয়, রাজার কোনও ছেলে না থাকায় উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বের কারনে ১৭০৭ সালে সমগ্র লাও সাম্রাজ্য তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ১৭৭৯ সালে থাইল্যান্ডের রাজা লাও সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। ১৮৯৩ সালে লাওস ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিনত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছুবছর লাওস জাপানের অধীনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর পুনরায় লাওস ফ্রান্সের অধীনে চলে যায়। তবে এবার লাওসে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। যার কারনে ১৯৫৩ সালে জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী লাওস স্বাধীনতা পায়। কিন্ত ফ্রান্স লাওসকে স্বাধীনতা দিলেও লাওসে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি বরং লাওসে রাজতন্ত্র ছিল। লাওসের রাজা ফ্রান্সের পক্ষে ছিল। এই কারনে লাওসে একটি কমিউনিস্ট বিদ্রোহী সংগঠন তৈরি হয় যাদের লক্ষ্য ছিল রাজাকে ক্ষমতা থেকে সরানো। লাওসের বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অস্ত্র সহায়তা করতো উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকার। উত্তর ভিয়েতনামকে আবার সহায়তা করতো সোভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৫৪ সালে ভিয়েতনামে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর ভিয়েতনাম থেকে ফ্রান্স চলে যায়। এরপর উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে দক্ষিন ভিয়েতনামকে রক্ষার দায়িত্ব আমেরিকা নিয়ে নেয়। আমেরিকা এই সময় লাওসের রাজাকে অস্ত্র সহায়তা করা শুরু করে। কিন্ত ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আমেরিকা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। যার কারনে আমেরিকা ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যায় একটা সময়। ১৯৭৫ সালে উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট যোদ্ধারা দক্ষিন ভিয়েতনাম দখল করে নেয়। এর ফলে ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে লাওসেও রাজতন্ত্রের পতন ঘটে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। লওসের নাম হয় লাও পিপলস ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক। এখানে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল লাওসের নাম ডেমোক্রেটিক অর্থাৎ গনতান্ত্রিক হলেও দেশটিতে শুধুমাত্র কমিউনিস্ট দলই রয়েছে ক্ষমতায়। গনতান্ত্রিক দেশের কোনও বৈশিষ্ট্যই নেই লাওসে।
কমিউনিস্ট দেশগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনও বিরোধী পক্ষ না থাকা বা বলা ভালো যেসব দেশে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা সরকার বিরোধী পক্ষকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে দেশে। কমিউনিস্ট সরকারদের মূল লক্ষ্য বিনা বাধায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা দখল তার জন্য তারা তাদের বিরোধীদের নির্বিচারে হত্যা করতেও পিছপা হয়না। ইতিহাসে এমব উদাহারন এমন অনেক রয়েছে, যেমন ভ্লাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে যখন বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন হয় তখন লেলিন প্রথমেই তার বিরোধীদের হটিয়ে দেয়। ভ্লাদিমির লেলিনের উত্তরসূরী জোসেফ স্টালিন মানুষরূপে সাক্ষাৎ নরপিশাচ ছিল। জোসেফ স্টালিন কমিউনিস্ট দলের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিরোধীদের পাশাপাশি কয়েক লাখ সাধারন মানুষকেও হত্যা করে। চীনে মাও জেডং এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় আসার পরেও মাও প্রথমেই বিরোধীদের হত্যা করে। উত্তর কোরিয়া, কিউবা সহ সমস্ত কমিউনিস্ট দেশেই এভাবেই বছরের পর বছর নৃশংস দমন পীড়নের মাধ্যমেই কমিউনিজম ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে। ঠিক তেমনই লাওসেও একটিমাত্র কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় রয়েছে লাও পিপলস রেভ্যুলেশনারী পার্টি বা এলপিআরপি। দেশটির রাষ্ট্রপতি থংলাউন সিসুলিথ এবং প্রধানমন্ত্রী সোনেক্সে সিফানডোন। লাওসে বিগত কয়েকবছর ধরে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে যা চরম আকার ধারন করে ২০২২ সালে। লাওসের জনগন রীতিমতো সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে এর জন্য। কমিউনিস্ট দেশে সাধারনত বাক স্বাধীনতা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া সরকারই নিয়ন্ত্রন করে, কোনও কমিউনিস্ট দেশেই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায়না কারন সরকার কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু লাওসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় ২০২২ সাল থেকে যার থেকে সহজেই অনুমেয় দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা কতটা খারাপ। লাওসে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় উল্লেখ যোগ্য হারে কমে যায়। যার জন্য লাওসের বানিজ্যি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশটিতে খনিজ তেলেরও অভাব দেখা দিয়েছে কারন আমেরিকান ডলারের অভাব রয়েছে। লাওসের মুদ্রার মান ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কোনও দেশের মুদ্রার মান আমেরিকান ডলারের তুলনায় যত বেশী সেই দেশটির অর্থব্যবস্থা ততটাই দুর্বল। লাওসের মুদ্রার মান লাও কিপ। লাওসে ২০২২ সালে ১ ডলারের মান ছিল ১২,৪৯২.৮৮ লাও কিপ কিন্তু বর্তমানে ১ দেশটিতে ১ আমেরিকান ডলারের মান ২১,৩২৪.২৪ লাও কিপ। লাওসে মুদ্রাস্ফীতিও ক্রমশ বাড়ছে ২০২১ সালে লাওসে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৩.৭৫ শতাংশ সেখানে ২০২৪ সালে লাওসে মুদ্রাস্ফীতি ২১.৫ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংগঠন লাওসের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে সবচেয়ে খারাপ জানিয়েছে। করোনা মহামারী এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে বিশ্বের সবদেশই কমবেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু লাওস এত বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কারন তাদের সরকারের ভুলনীতির কারনে। লাওসের কমিউনিস্ট সরকার লাওসকে বিশ্ব বানিজ্য থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন রেখেছে। লাওস পশ্চিমা বিশ্বের সাথে বানিজ্য তেমন করেনা বললেই চলে। মূলত আসিয়ান দেশগুলো বিশেষ করে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং চীনের সাথেই বানিজ্য হয় লাওসের। লাওসের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তাদের বৈদেশিক ঋন। সাম্প্রতিক সময়ে লাওসের ঋন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। লাওস সবচেয়ে বেশী ঋন নিয়েছে চীনের থেকে। যার জন্য অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য লাওস চীনের ঋনের ফাঁদে পথে গেছে। ডেব্ট ট্র্যাপ বা ঋনের ফাঁদ চীনের একটি পুরোনো স্ট্রাটেজি। চীন এশিয়া, আফ্রিকার ছোট গরীব দেশগুলোকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋন দেয় চড়া সুদে। দেশ গুলো সেই অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে তখন চীন সেই দেশগুলোর ভূমি দীর্ঘ সময়ের জন্য তাদের নিয়ন্ত্রনে রেখে দেয়। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, কেনিয়া সহ বহু দেশ চীনের এই স্ট্রাটেজির শিকার। এবার লাওসও চীনের এই ঋনের ফাঁদে পড়েছে। লাওসে চীনের ঋন রয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার। লাওসের মোট জিডিপি ১৮-২০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ লাওস তার জিডিপির সমান ঋন নিয়েছে চীনের থেকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের শেষে লাওসের ঋনের পরিমান তার জিডিপির ৮৮ শতাংশ যার মধ্যে বৈদেশিক ঋনই ১৪.৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আবার ৪৭ শতাংশ ঋনই চীনের থেকে নিয়েছে লাওস। অতিরিক্ত ঋনের জন্য লাওসের বেশীরভাগ ইলেকট্রিক গ্রিডই চীনের সংস্থার অধীনে রয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, উগান্ডা, লাওস যেসব দেশগুলোকেই চীন অতিরিক্ত ঋন দিয়েছে সেইসমস্ত দেশই হয় দেওলিয়া হয়ে গেছে, না হয় দেউলিয়া হওয়ার পথে। যার থেকে এটা স্পষ্ট যে চীন ইচ্ছে করেই এসব দেশগুলোকে তাদের ঋনের ফাঁদে ফেলার জন্য ঋন দেয়। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে জনগনের বাকস্বাধীনতা না থাকায় সরকারের যেকোনও নীতি তাদের মানতে বাধ্য হয়। সরকার যদি ভুল আর্থিকনীতিও শুরু করে তাহলেও জনগন প্রতিবাদ করতে পারেনা। যার কারনে সোভিয়েত ইউনিয়ন, কিউবা, উত্তর কোরিয়া সহ সব কমিউনিস্ট দেশই একটা নির্দিষ্ট আর্থিক সংকটে পড়েছিল। শুধুমাত্র চীন ১৯৭০ এর দশকে কিছুটা পুঁজিবাদী নীতি গ্রহন করায় তারা আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সব কমিউনিস্ট দেশের মতোই লাওসের কমিউনিস্ট সরকারের ভুল আর্থিকনীতি ও বানিজ্যনীতির শিকার হয় দেশটির জনগন। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার এই ছোট দেশটির সাথে ভারতেরও কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। লাওস ভারতের জন্য দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যের জন্য ততটা গুরুত্বপূর্ন নয় কিন্তু আসিয়ান দেশ হিসাবে গুরুত্বপূর্ন। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতির অংশ লাওস। ১৯৯৪ সালে ভারত ও লাওসের মধ্যে সাংস্কৃতিক চুক্তি হয়েছে। মাদকের চোরাকারবারি প্রতিরোধে, কৃষিকাজে, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দুইদেশ একসাথে কাজ করে। লাওস ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয়। লাওসের অনেক প্রজেক্টে ভারত লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটে ভারত যেভাবে শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করেছিল সেভাবে লাওসকে হয়ত সহয়তা করা হবেনা কারন লাওস আমাদের প্রতিবেশী দেশ নয়।