অফবিট

দুই মাথা ওয়ালা শিশু

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমন অনেক ঘটনাই থাকে যেটা গোটা পৃথিবীকে অবাক করে দেয়। নতুন করে চিন্তায় ফেলে দেয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদেরকেও। সেরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৭৮৩ সাল নাগাদ। দুই মাথা নিয়ে জন্মেছিল একটি শিশু। তাজ্জব হয়েছিল গোটা চিকিৎসাবিজ্ঞান। জানা যায় যে এখনো পর্যন্ত নাকি সেই জটিল ঘটনা বিশ্লেষণ করে উঠতে পারেনি বিজ্ঞানীরা। 

ঘটনাটি শুরু হয়েছিল ১৭৮৩ সাল নাগাদ। সেই বছরের মে মাস নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ ভারতের এক গরীব কৃষকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিল এক পুত্র সন্তান। পুত্র সন্তান জন্মের আনন্দ ছিল পরিবারের কিন্তু তার দুটো মাথা হওয়ায় অবাক হয়েছিলেন তারা। সেইসময় অধিকাংশ শিশু বাড়িতেই জন্মাতো। সেরকমই একজন দাইমা এই শিশুটিকে প্রসব করানোর সময় তার রূপ দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। এবং ভয়ে সেই কক্ষে থাকা আগুনের উপর ফেলে দিয়েছিলেন। তবে সৌভাগ্যক্রমে শিশুটির শরীরের অল্প কয়েকটি জায়গা পুড়ে গেলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল সে। সেই শিশুটির নাম সম্বন্ধে রয়েছে যথেষ্ট জটিলতা। তাই শিশুটির নাম অজানাই থেকে গেছে।

পরবর্তীতে শিশুটিকে সুস্থ করিয়ে তার বাবা-মা নিজেদের ভিটে ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। সেখানেই এরকম আজব ঘটনার জন্য নিজের শিশুকে পয়সা ইনকামের একটি মাধ্যম করে তুলেছিলেন। অর্থাৎ নিজের সদ্যজাত আত্মজকে নিয়ে প্রদর্শনীতে বসেছিলেন। যে সকল মানুষেরা শিশুটির গল্প শুনতেন এবং তাকে দেখতে চাইতেন তাদের সকলকেই পয়সা দিয়ে দেখতে হতো। শুধুমাত্র প্রদর্শনী নয় কোন ধনী ও স্বনামধন্য ব্যক্তির পরিবার শিশুটিকে দেখতে চাইলে তারা ভাড়া করে নিয়ে যেত। তার জন্য অবশ্য শিশুটির পরিবারকে মোটা টাকা দেওয়া হতো। পরবর্তীতে এই শিশুর কথায় ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা শিশুটির বিষয় জানতে পেরে তাকে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে একদিন চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে শিশুটি সকলের সামনে প্রদর্শনী হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে পঞ্চাশ লক্ষ শিশু জন্মের মধ্যে মাত্র দুজন শিশুর মধ্যে এই ধরনের ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। যদিও এই ধরনের শিশুরা বেশি দিন জীবিত থাকে না।

** ছেলেটি দেখতে ছিল- শিশুটির অন্যান্য শিশুর মতই দুই হাত, দুই পা এবং শারীরিক গঠন ছিল। তবে শিশুটির মাথা ছিল একটু বড় এবং সেই মাথার উপর দিয়ে আরেকটা মাথা তৈরি হয়েছিল। যেটাকে দেখলে অনেকটা মনে হতো মাথার উপর কোন একটা ভারী স্তুপ রেখে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রথম মাথাটির তুলনায় দ্বিতীয় মাথাটি ছিল ছোট এবং সেই দ্বিতীয় মাথার চোখ কান নাক সঠিকভাবে তৈরি ছিল না। এমনকি জিহ্বা ও চোয়াল ছিল কিছুটা বিকৃত। এছাড়াও তার প্রথম মাথাটি ছিল অন্যান্য শিশুর মাথার তুলনায় অত্যাধিক বড়। যদিও দেখা গেছিল যে শিশুটির দ্বিতীয় মাথাটা কম সক্রিয় ছিল। কারণ শিশুটি যখন হাসতো কিংবা কাঁদবো তখন দ্বিতীয় মাথায় কোনরকম প্রতিক্রিয়া হত না। অর্থাৎ অনেকটা এরকম মনে হতো যে তার দ্বিতীয় মাথাটা তার শরীরে অংশই নয় আলাদা একটা সত্তা। মাঝে মাঝে ওই দ্বিতীয় মাথাটি স্বাধীনভাবে কাজ করতো।

যখন শিশুটি ঘুমাতো তখন তার দ্বিতীয় মাথাটির চোখ খোলা থাকতো এবং চারিদিক ঘোরাত। অর্থাৎ এটা প্রমাণ করতে চাই তো যে সে ঘুমন্ত অবস্থায় সজাগ রয়েছে এবং চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করছে। আবার যখন শিশুটিকে প্রথম মাথার মুখ দিয়ে খাওয়ানো হতো তখন তার দ্বিতীয় মাথার মুখের জিহ্বা দিয়ে লালা ঝরতো। আবার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে এই শিশুটির দ্বিতীয় মাথা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে স্তন্যপান করতো।

** চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই ঘটনার বিবরণ – চিকিৎসকদের মতেই মায়ের গর্ভে যখন জমজ বাচ্চার জন্ম হবে তখন যদি ভ্রুণ বিচ্ছিন্ন না হয় সেক্ষেত্রে ক্রেনিওপ্যাগাস প্যারাসিটিকাস কন্ডিশন দেখা দেয়। যার ফলে একটা শিশু এই ভাবে জন্মগ্রহণ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগের নিরাময়ের পদ্ধতি নেই সেটা বললে ভুল হবে। এই ধরনের কেসের জন্য এক ধরনের চিকিৎসা রয়েছে যাকে বলে ‘the removal of the parasitic twin’। অর্থাৎ শিশুদের প্রথম মাথা থেকে দ্বিতীয় মাথাটি অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে আলাদা করতে হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিষয়টা খুবই প্রাণঘাতি হয়ে দাঁড়ায়। কারণ দুটি মাথার মধ্যে শিরা গুলি এমনভাবে যুক্ত থাকে যে সেগুলো ছিন্ন করা মানে প্রাণ হারানো।

তবে ২০০৩ সাল নাগাদ ক্র্যানিওপ্যাগাস প্যারাসিটিকাসের একটি মেয়ের উপর অস্ত্রপাচার করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অস্ত্র চালানোর পর মাত্র ১১ ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছিল। পরবর্তী ২০০৫ সালে মিশরের এক ছেলের উপর একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল তবে সেও মস্তিষ্ক সংক্রান্ত কিছু রোগের কারণে মারা গিয়েছিল।

তবে এই দুই মাথাওয়ালা শিশুটির  অন্যান্য কোন শারীরিক উপশম ছিল না। তবে শিশুটির চার বছর বয়সে একটা কোবরা সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছিল। 

** মৃত্যুর পরেও চুরি হয়েছিল শিশুটির মৃতদেহ – দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল যে শিশুটি মারা যাওয়ার পর তাকে কবরস্থ করা হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন এজেন্ট সেই কবর লুট করেছিল। এরপর শিশুটির মাথা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারা গেছিল যে পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে শিশুটির দুটি মস্তিষ্কই পুষ্ট ছিল। পরবর্তীতে অবশ্য ইংরেজদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই শিশুটির শরীর শুকিয়ে গিয়েছিল। যার কারণে একজন ইংরেজ সার্জন এভারার্ড হোম নামে এক ব্যক্তিকে মাথার খুলি উপহার দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আধিকারিকেরা। বর্তমানে সৃষ্টিকর্তার এই অদ্ভুত সৃষ্টিটি লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস-এর হান্টেরিয়ান মিউজিয়ামে প্রদর্শনী হিসেবে যত্ন সহকারে রাখা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *