অফবিট

টয়লেট পেপার তৈরি করতে প্রতিদিন কত হাজার গাছ কাটতে হচ্ছে?

টয়লেট পেপার বা টয়লেট টিস্যুর ব্যবহারের বিষয় সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। এই টিস্যু বর্তমানদিনে নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে মানুষের কাছে। তবে প্রশ্ন হল যে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসটির ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? এবং সেই সময় টয়লেট পেপার হিসাবে কি ব্যবহার করত মানুষ? 

আধুনিক টয়লেট পেপার আবিষ্কার হওয়ার আগে কি ব্যবহার করত মানুষ?

বর্তমান দিনে আমরা যে আধুনিক টয়লেট পেপার ব্যবহার করে থাকি সেটির সৃষ্টির ইতিহাস আজকের নয়, আজ থেকে  আনুমানিক ২০০ বছরের। তবে  টয়লেট পেপার ব্যবহার  কবে থেকে শুরু হয়েছিল সেই বিষয়ে তথ্য ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায় নি।   

প্রাচীন চীন
৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম লিখিতভাবে চীনে টয়লেট পেপার ব্যবহারের কথা উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। তবে মনে করা হয় যে তারা ৫৮৯ খ্রিস্টাব্দের আগেও টয়লেটের উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে কারন খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীতে চীনারা আবিষ্কার করে ফেলেছিল কাগজের। 

টয়লেট এর শেষে  প্রাচীন চীনের মানুষরা এই কাগজ ব্যবহার করত। এই কাগজটি  তুলনামূলক নরম ছিল সাধারণ কাগজের থেকে। এছাড়াও যেসব কাগজ রাজ আদালতের সদস্যরা ব্যবহার করতেন সেগুলি ছিল সুগন্ধিযুক্ত।   

ইতিহাস অনুযায়ী, চীনে টয়লেট পেপার ব্যবহার করার রীতি ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দে চালু হয়েছিল। চীনের রাজ প্রাসাদে এই কাগজ ব্যবহারের জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল চতুর্দশ শতকে মিং বংশের শাসনকালে। ১৩৯৩ সালে বছরে ৭,২০,০০০ টুকরো টয়লেট পেপার দরকার হত শুধুমাত্র রাজ পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করার জন্য। যার প্রতিটি টুকরোর মাপ ছিল ৬০ সেমি X ৯০ সেমি।

প্রাচীন রোম
প্রাচীন রোমানরা মলত্যাগের পরে মলদ্বার মোছার জন্য ব্যবহার করতো জাইলোস্পনজিয়াম (ল্যাটিন ভাষায় একটি লাঠিতে স্পঞ্জ)। এই স্পঞ্জযুক্ত লাঠিকে একজন ব্যবহার করার পর সেটিকে একটি ভিনেগার বা লবণ জলে ভরা বালতিতে রেখে দিতো। যাতে পরবর্তীতে অন্য ব্যক্তিরাও  ওই একই জাইলোস্পনজিয়াম ব্যবহার করতে পারে।

প্রাচীন গ্রীক
প্রাচীন গ্রীকরা মলদ্বার মোছার জন্য ব্যবহার করত সিরামিক টুকরো যাকে বলা হত পেসসোই। (বলাই বাহুল্য যে এই পাথর এবং তাতে থাকা ছিদ্রের ফলে ত্বকে জ্বালাপোড়া এবং অর্শ্বরোগ হয়)। প্রাচীন গ্রীকরা এই পাথরে তাদের শত্রুর নাম লিখে রাখতো। ওই সময় গ্রীকরা পাবলিক টয়লেটগুলোতে পেসসোই রেখে দিত। তারা মনে করতেন যে, এই টয়লেট যেই ব্যবহার করবে তার মানে সে তার শত্রুর বিরুদ্ধে কিছু করতে পেরেছে।অর্থাৎ এটি একটি যুদ্ধের মতোই ছিল তাদের কাছে। 

প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ‘পেসসোই’ এই সিরামিকের টুকরোর উল্লেখ পেয়েছিল গ্রীক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নথি থেকে। এছাড়াও একবার একটি গুহা থেকে পাওয়া সেখানকার মানুষের মল পরীক্ষার করার পর প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে পেয়েছিল পেসোইয়ের ধ্বংসাবশেষ।     

প্রাচীন জাপান
প্রাচীন জাপানের মানুষেরা অষ্টম শতাব্দীর দিকে তাদের মলদ্বারের বাইরের এবং অভ্যন্তর পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করত এক ধরণের কাঠের কাঠি। এই কাঠিটিকে বলা হত  চুগি। এছাড়াও প্রাচীনকালের মানুষেরা জল, পাতা, ঘাস, পাথর, পশুর চামড়া ও ঝিনুক ব্যবহার করত এবং মধ্যযুগে মরিসন জাতির মানুষেরা শ্যাওলা, গাছের ছাল, খড়, এবং কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি ব্যবহার করত।

মানুষের এইসব জিনিস ব্যবহার করার বিষয়টিকে নিয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখেছিলেন ফ্রান্সোইস রাবেলাইস নামের একজন ফরাসী ঔপন্যাসিক। পশ্চিমা বিশ্বে টয়লেট পেপারের প্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল তার কবিতায়। তিনি বলেছিলেন যে হাঁসের মাথায় তাদের শুধু ব্যবহার করা বাদ রয়েছে। 

আধুনিক টয়লেট পেপারের ইতিহাস
১৮৫৭ সালে, টয়লেট পেপারের জন্য এক বিশেষ ধরনের তৈরি করা কাগজ বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন জোসেফ সি. গেয়েটি। একটি বাক্সে কাগজের পৃথক শীট দ্বারা গঠিত ছিল তার পণ্য। এটিতে অ্যালোভেরার নির্যাস দিয়ে তিনি মিশ্রিত করেছিলেন এবং একটি জলছাপ যুক্ত করেছিলেন তার উপাধির সাথে।
১৮৭১ সালে রোল্ড এবং ছিদ্রযুক্ত টয়লেট পেপার পেটেন্ট করেছিলেন শেঠ হুইলার। স্কট পেপার কোম্পানি একটি রোলে টয়লেট পেপার ১৮৯০ সালে বিক্রি করা শুরু করেছিল। নর্দার্ন টিস্যু কোম্পানি  ১৯৩০ সালে স্প্লিন্টার-মুক্ত টয়লেট পেপার বিক্রি করা শুরু করেছিল। তবে প্রশ্ন হচ্ছে যে এটি কি সমস্ত ব্যবহারকারীদের কাছে স্বস্তিদায়ক একটি বিষয় ছিল?

১৯৪২ সালে  ইংল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুস পেপার মিল ঘটিয়ে ছিল আরেকটি বিপ্লব। তারা অ্যান্ড্রেক্স প্রবর্তন করেছিল যা ছিল প্রথম টু-প্লাই টয়লেট পেপার।রঙিন টয়লেট পেপার প্রথম নর্দান টিস্যু কোম্পানি ১৯৫৪ সালে বিক্রি করা শুরু করেছিল। স্কট পেপার কোম্পানি  ১৯৫৫ সালে প্রথমবারের মতো টয়লেট পেপারের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল টিভিতে। প্রথম দেশব্যাপী টয়লেট পেপার সংকট ২০২০ সালের মার্চ মাস, তখন বিশ্বের কাছে আতঙ্কের একটি নাম ছিল COVID-19।  সেই সময় টয়লেট পেপার কেনার বিষয়ে আতঙ্ক প্রকাশ করেছিল একাধিক দেশ। যা টয়লেট পেপার ঘাটতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। তবে এটাই যে প্রথম তা কিন্তু নয় এর আগেও দেখা দিয়েছিল টয়লেট পেপারের সংকট।
প্রথম টয়লেট পেপার এর সংকট দেখা দিয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ওই সময় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ফলে তেলের সংকট দেখা দেয়। আর সেই সময়ই জাপানে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে দেশে টয়লেট পেপার ফুরিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে টয়লেট পেপার কেনার উন্মাদনায় সাড়া দিয়েছিল জাপানি গৃহিণীরা। টয়লেট পেপার কেনার জন্য প্রতিদিন শত শত দোকানের সামনে ভিড় জমত মানুষদের।
১৯ শে ডিসেম্বর, ১৯৭৩ সালে আমেরিকান এক জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা জনি কারসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্য টুনাইট শো-তে টয়লেট পেপার ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে রসিকতা করেছিলেন, যা এই আতঙ্কের সৃষ্টির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল  এবং প্রকৃত ঘাটতি ছিল টয়লেট পেপারের। 
তবে পরে তার এই রসিকতার জন্য কারসন ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং আশা প্রকাশ করেছিলেন যে তাকে যেন মানুষেরা টয়লেট পেপারের সংকট সৃষ্টি করা ব্যক্তি হিসাবে মনে না রাখে। 

টয়লেট পেপার উৎপাদন পরিবেশ বান্ধব নয়। কারন প্রতিদিন,  প্রায় ২৭,০০০ এর ও বেশি গাছ কাটা হয়  টয়লেট পেপার তৈরির জন্য পর্যাপ্ত কাঠ সরবরাহ করতে। যা পরিবেশের উপর বিশাল প্রভাব ফেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *