অফবিট

দ্বিতীয় গল্ফ যুদ্ধ বা ইরাকের যুদ্ধ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় যা এখনও পর্যন্ত বিদ্যমান৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গঠন হওয়ার পর থেকেই আরব ইসরায়েল সংঘাত তৈরি হয়। সৌদি আরব ছাড়া ইরান, ইরাক, কুয়েত, ইয়ামেন, লিবিয়া, সিরিয়া, জর্ডন সহ প্রায় সমস্ত আরব দেশেই রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয় যার কারনে মধ্যপ্রাচ্য বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক সংঘাত হয়েছে যাদের মধ্যে প্রথম গল্ফ যুদ্ধ ও দ্বিতীয় গল্ফ যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।

প্রথম গল্ফ যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৯০ সালে ইরাকের স্বৈরাচারী শাসক সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত আক্রমনের কারনে। এরপর আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বের ৪২ টি শক্তিশালী দেশ একত্রিত হয়ে ইরাককে প্রতিরোধ করেছিল ফলত সাদ্দাম হোসেন তার সেনাবাহিনী কুয়েত থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় গল্ফ যুদ্ধের সূচনা হয় ২০০৩ সালে যা পরবর্তী আট বছর ধরে চলে। দ্বিতীয় গল্ফ যুদ্ধকে ইরাকের যুদ্ধও বলা হয়। দ্বিতীয় গল্ফ যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই বছর আগে ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে দেওয়া হয় যা ইতিহাসে ৯/১১ নামে কুখ্যাত। এই ঘটনার জন্য দায়ী ছিল আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নির্ভর সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদা এবং এই নৃশংস ঘটনার মাস্টারমাইন্ড ছিল আল কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন৷ ইরাকের সাথে ৯/১১ ঘটনার কোন সংযোগ ছিলনা কিন্তু আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএর কাছে তথ্য ছিল ইরাক ৯/১১ এর মতোনই আমেরিকাতে একটি বড় সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছে। কারন ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেন প্রথম গল্ফ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টায় ছিল। আমেরিকা জানতো ইরাকের কাছে রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের ভান্ডার আছে যার কারনে আমেরিকা ২০০৩ সালে ইরাকে সেনাবাহিনী পাঠায়। আট বছরের এই যুদ্ধে অবশেষে সাদ্দাম হোসেনের পতন হয় কিন্তু ইরাকের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে যার ফল আজও ভোগ করছে ইরাক।

১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট এবং ইরাকের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় এবং প্রথম গল্ফ যুদ্ধের অবসান হয়। এই যুদ্ধে ইরাকের সামরিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই যুদ্ধে আমেরিকা ও সম্মিলিত জোট জয়লাভ করলেও এই যুদ্ধের একটি প্রধান উদ্দেশ্য আমেরিকার পূরন হয়নি। আমেরিকার লক্ষ্য ছিল এই যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের পতন ঘটানো কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সাদ্দাম হোসেনকে নিয়ন্ত্রনে রাখবার জন্য এবং উত্তর ইরাকে কুর্দ বাহিনী এবং দক্ষিন ইরাকে সিয়ায়েট বাহিনীকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমেরিকা ও সম্মিলিত জোট ইরাকের উত্তর ও দক্ষিন প্রান্তে নো ফ্লাই জোন ঘোষনা করে দেয়। আমেরিকার ধারনা ছিল কুর্দ ও সিয়ায়েট বাহিনী সাদ্দাম হোসেনকে ভবিষ্যতে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে কিন্তু এটা হয়নি, সাদ্দাম হোসেন এই দুই বাহিনীকেই প্রতিরোধ করে। 

সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য জাতিসংঘ ইরাকের উপর প্রচুর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ইরাকের সাথে সমস্ত দেশের বানিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। জাতিসংঘ ইরাকে অয়েল ফর ফুড নামে বিশেষ কার্যক্রম শুরু করে যাতে ইরাকের তেলের বদলে তাদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হয় অর্থাৎ সরাসরি ইরাককে কোনও অর্থ দেওয়া হয়নি। ইরাকের রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্র ভান্ডার ধ্বংসের জন্য জাতিসংঘ ইরাকে বিশেষ প্রতিনিধি দল নিযুক্ত করে। যদিও আমেরিকা পরে দাবি করে ইরাক এই দলের কার্যে বাধা দিচ্ছে। 

১৯৯৮ সালের আগস্ট মাসে ইরাক অভিযোগ করে জাতিসংঘের এই দল আমেরিকার হয়ে কাজ করছে এবং ইরাক জাতিসংঘের এই দলের কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপরেই অক্টোবর মাসে আমেরিকাতে ইরাক লিবারেশন অ্যাক্ট পাশ হয় যাতে স্পষ্ট জানানো হয় সাদ্দাম হোসেনকে ইরাকের শাসন ক্ষমতা থেকে সরানো আমেরিকার লক্ষ্য। ইরাকের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলকে ৯৭ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য দেয় আমেরিকা সাদ্দাম হোসেনকে পরাজিত করতে। আমেরিকা ও ব্রিটেন যৌথভাবে এইসময় ইরাকে অপারেশন ডেসার্ট ফক্স নামে একটি এয়ারস্ট্রাইক করে যার লক্ষ্য ছিল ইরাকের পরমানু, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্র ভান্ডারকে ধ্বংস করা। 

২০০০ সালে আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি হয় জর্জ ডাব্লিউ বুশ জুনিয়র এবং তিনি ইরাকের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নীতি প্রয়োগ করেন। জর্জ ডাব্লিউ বুশ তাঁর নির্বাচনি প্রচারেও ঘোষনা করেছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতি হলে ইরাক লিবারেশন অ্যাক্ট সম্পূর্ন ভাবে প্রয়োগ করবেন। 

১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলার পর আমেরিকা সাদ্দাম হোসেনকে সরানোর ব্যাপারে আরও দ্রুত পরিকল্পনা শুরু করে। আমেরিকা জানতো আল কায়দার সাথে ইরাকের কোন যোগ নেই তাই সরাসরি ইরাকে আক্রমন করা যাবেনা। ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে জর্জ ডাব্লিউ বুশ ইরাক, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে অ্যাক্সিস অফ ইভেল বলে ঘোষনা করে। সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকা জানায় ইরাকের কাছে পরমানু অস্ত্র আছে এবং ইরাকে অভিযানের কথা। আমেরিকার প্রস্তাবে বিরোধীতা করে জার্মানি ও ফ্রান্স কিন্তু ব্রিটেন আমেরিকাকে সমর্থন করে। জাতিসংঘ ১৪৪১ ধারা অনুযায়ী ইরাকে পুনরায় প্রতিনিধি দল পাঠাবার কথা ঘোষনা করে। ১৩ নভেম্বর সাদ্দাম হোসেন জাতিসংঘের এই প্রতিনিধি দল পাঠানোর প্রস্তাবে সম্মত হয়। 

এদিকে আমেরিকান কংগ্রেস জর্জ ডাব্লিউ বুশকে ইরাকে সেনা পাঠানোর অনুমোদন দিয়ে দেয়, আমেরিকার সাধারন নাগরিকও এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে। ২০০৩ সালে আমেরিকা আবারও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাকে সেনা পাঠানোর প্রস্তাব আনে, তবে এবারেও বিরোধীতা করে রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও কানাডা। ১৭ মার্চ আমেরিকা সাদ্দাম হোসেন ও তার দুই ছেলেকে আত্মসমর্পন করে দুই দিনের মধ্যে ইরাক ছেড়ে যাবার আদেশ দেয়। কিন্তু সাদ্দাম হোসেন তা না মানায় আমেরিকা অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম শুরু করে দেয়। ১৯ মার্চ সকালে আমেরিকা ও চল্লিশটি দেশ সম্মিলিত ভাবে ইরাক আক্রমন করে। আমেরিকা এয়ারস্ট্রাইক শুরু করে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের গুরুত্বপূর্ন সামরিক স্থাপনা গুলোতে। ২১ মার্চ কুয়েত হয়ে আমেরিকান ও ব্রিটিশ সেনা ইরাকে প্রবেশ করে। ২৬ মার্চ তুরস্ক হয়ে সম্মিলিত সেনা ইরাকে প্রবেশ করে। মাত্র চার সপ্তাহে ইরাকের সমস্ত গুরুত্বপূর্ন শহর আমেরিকার নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। ১৩ ডিসেম্বর তিকরিট থেকে সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেফতার করে আমেরিকা এবং ২০০৬ সালে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি হয়। সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর পরই ইরাকের শাসনব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়ে। ক্ষমতার দখলকে কেন্দ্র করে ইরাকে দুটো গোষ্ঠী তৈরি হয়। 

২০০৪ সালের ১০ এপ্রিল সিয়ায়েট দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আমেরিকা এবং ২০০৫ সালে সাধারন নির্বাচন করানো হয় ইরাকে, এতেও জয়লাভ করে সিয়ায়েট দল। কিন্তু সিয়ায়েটের বিপক্ষে একাধিক ছোট ছোট দল তৈরি হয়ে যায় এবং ইরাকে রীতিমতো গৃহযুদ্ধ তৈরি হয়। ইরাকে তৈরি হওয়া দুটি সবচেয়ে বড় বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে একজনকে সৌদি আরব এবং অন্যজনকে ইরান সমর্থন করতে শুরু করে। ইরাকের অস্থিরতার সুযোগে আইএসআইএস এবং আল কায়েদার মতোন সন্ত্রাসী সংগঠনও ইরাকে তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা শুরু করে। 

২০০৪ থেকে ২০০৭ এর মধ্যে ইরাকের গৃহযুদ্ধ সবচেয়ে চরমে ছিল, এইসময় বাগদাদে প্রচুর আত্মঘাতী বিস্ফোরন হয়। একটা সময় ইরাকে প্রায় একশোর বেশী ছোট ছোট সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এসব দেখে ২০০৭ সালে আমেরিকা আরও বেশী সেনা পাঠায় ইরাকে। ২০১১ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে ইরাক থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। আমেরিকান সেনা ফিরে এলেও ইরাকে গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকে যার ফলে আজও ইরাক অস্থিতিশীল। ২০০৩ থেকে ২০১১ অবধি আট বছর চলা ইরাক যুদ্ধে দশ হাজার আমেরিকান সেনা ও দুই লাখ ইরাকি লোকের মৃত্যু হয়, এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *