অফবিট

কুড়ি প্রকারের প্রমানের কথা জানিয়েছে ভারত সরকার। ভারত সরকারের দ্বারা তৈরি নতুন সিএএ আইন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার সিএএ আইন প্রনয়ন করেছে দেশে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারত সরকারের এই ঘোষনাকে নির্বাচনের জন্য নতুন চমক বলা হচ্ছে। সিএএ বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টকে ঘিরে গোটা দেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে, বহু মানুষ যেমন এই আইনকে সমর্থন করছে আবার কীছু মানুষ এই আইনের বিরোধীতাও করছে। ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধন আইনকে অনুমোদন দিয়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে এই বিলকে আইন হিসাবে প্রনয়ন করবার কথা থাকলেও চার বছর সময় লেগে যায় সিএএকে আইন রূপে প্রনয়ন করতে। অবশেষে গত ১১ মার্চ ভারত সরকার সরকারি ভাবে সিএএর ঘোষনা করে। সিএএ আইন প্রনয়ন হওয়ার সাথে সাথে একদিকে যেমন দিল্লির মজনু কী টিলাতে থাকা পাকিস্তানি শরনার্থীরা খুশিতে হোলি খেলে, শিরোমানি গুরুদোয়ারাও ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায়, তেমনি অন্যদিকে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ সিএএর বিরোধীতা করে সুপ্রিম কোর্টে আবদেন করেছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন জানিয়েছে তামিলনাড়ুতে এই আইন শুরু করা হবেনা, কংগ্রেস নেতা শশী থারুরও জানিয়েছে তারা ক্ষমতায় এলে এই আইন প্রত্যাহার করে নেবে। বিগত কয়েকদিন ধরে ভারতের রাজনীতিতে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সিএএ আইন। 

ভারতীয় সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ভারতের নাগরিকত্বের বিষয়ে লেখা রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিন শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর কে ভারতের নাগরিক হবে, ভারতের নাগরিকত্ব নিতে চাইলে কী কী শর্ত থাকবে, যদি কোনও ব্যক্তি ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনও দেশের নাগরিকত্ব নেয় তার জন্য কী নিয়ম আছে এরকম বেশ কীছু বিষয় সম্পর্কে তথ্য রয়েছে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে। ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনও কিছু সংশোধনের অধিকার শুধুমাত্র ভারতের সংসদের আছে। ভারতের সংসদ ভারতের নাগরিকত্ব বিষয়কে আরও সহজভাবে সমাধানের জন্য ১৯৫৫ সালে একটি আইন তৈরি করে যার নাম নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫। সময়ের সাথে সাথে বিশেষ পরিস্থিতিতে এই আইনকে সংশোধন করা হয়েছে অনেকবার। ১৯৫৫ সালের পর ২০২৪ সালে পর্যন্ত এই আইনকে ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫, ২০১৫ ও ২০১৯ সালে অর্থাৎ মোট ছয়বার সংশোধন করা হয়েছে। 

২০১৯ সালে নাগরিকত্ব আইনকে সর্বশেষ সংশোধন করে ভারতের প্রতিবেশী ইসলামিক তিনটি দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে আশ্রয় নেওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা ঘোষনা করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, পার্সি, জৈন ও খ্রীস্টান ধর্মের মানুষকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এব্যাপারে ভারত সরকার জানিয়েছে ভারতের প্রতিবেশী তিনটি দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমনের কারনে তারা ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে সেই জন্য মানবিক কারনে তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই কারনে কেন্দ্রীয় সরাষ্ট্রমন্ত্রক কর্তৃক সিএএ ঘোষনার পরেই ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল ভারত সরকারের এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে জানিয়েছে ভারত কোনও আক্রমনাত্মক দেশ নয় এখানে এসে আশ্রয় নেওয়া শরনার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সিএএ সরাসরি ভারতে শরনার্থী হয়ে থাকা মানুষদের নাগরিকত্ব দেবেনা বরং সিএএ ওইসব মানুষদের সঠিক নিয়ম অনুসরন করে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবার অধিকার দেবে, যদি ওইসব মানুষদের দাবী সঠিক প্রমানিত হয় তবে তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। 

ভারত সরকার ভারতের নাগরিত্বের জন্য ৩৯ পাতার একটি নিয়ম প্রকাশ করেছে। এই নিয়মে স্পষ্ট বলা হয়েছে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য কী কী তথ্যের প্রয়োজন এবং ভারত সরকার পুরো পক্রিয়া অনলাইন করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ভারতে থাকা শরনার্থীদের কত সালে তারা ভারতে শরনার্থী হিসাবে প্রবেশ করেছে তা বলতে হবে এবং তারা যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকেই এসেছে এটারও প্রমান দেখাতে হবে। কোনও শরনার্থী বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে এসেছে কিনা তার প্রমান হিসাবে সেখানকার সরকার প্রদত্ত পাসপোর্ট, জাতীয় প্রমানপত্র, জন্ম প্রমানপত্র, মার্কশিট অথবা সেখানকার সরকার প্রদত্ত কোনও পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। সিএএতে আবেদনের জন্য শরনার্থীদের পূর্বের দেশের নাগরিক হিসাবে প্রমানের জন্য নয় প্রকারের প্রমান ও ভারতে প্রবেশের তারিখ প্রমানের জন্য কুড়ি প্রকারের প্রমানের কথা জানিয়েছে ভারত সরকার। একটি বিশেষ দল ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে, এই দলে জনগননা আধিকারিক, আইবি বা ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর আধিকারিক, পোস্ট অফিসের আধিকারিক, ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসের আধিকারিক এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্যের আধিকারিক থাকবে। 

জানুয়ারি, ২০১৯ সালে যৌথ সংসদীয় কমিটি তাদের এক তথ্যে জানিয়েছে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ৩১,৩১৩ জন অমুসলিম শরনার্থী ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সিএএতে এই সমস্ত মানুষ ভারতের নাগরিকত্বের অধিকার পাবে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসা মতুয়া সম্প্রদায়ের হিন্দু শরনার্থীরাও ভারতের নাগরিকত্ব পাবে, পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রায় তিন থেকে চার কোটি বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের অন্তত দশ লোকসভা আসনে এই মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব রয়েছে। 

তবে সিএএ আইন হিসাবে প্রনয়ন হওয়ার পথ খুব একটা সহজ ছিলনা। ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে সংসদে সিএএ বিল পাশ হয়ে যায়। ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সিএএ বিলে স্বাক্ষর করে দেন। ১৫ ডিসেম্বর সিএএকে রাষ্ট্রপতি স্বীকৃতি দেয়। এরপরেই দিল্লির শাহীনবাগে সিএএর বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ হয় এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্তেও এই বিলের পরিবর্তে বিক্ষোভ শুরু হয়। 

জানুয়ারি, ২০২০ সাল আসতে আসতে সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ আরও সংগঠিত ও জোরদার হয়। সুপ্রিম কোর্টে এই বিলের বিরুদ্ধে ১৪০টি আবেদন হয়। মার্চ মাস থেকে ভারতে করোনা মহামারীর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশে লকডাউন ঘোষনা করে। যার জন্য তিনমাস ধরে শাহিনবাগে থাকা বিক্ষোভকারীদের দিল্লি পুলিশ হটিয়ে দেয়। পরবর্তী দুই বছর করোনা মহামারীর কারনে সিএএ নিয়ে বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে যায়। 

২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শীঘ্রই সিএএকে আইন হিসাবে প্রনয়ন করার ব্যাপারে ঘোষনা করে। এরপরেই ২০২৪ সালের শুরু থেকেই পুনরায় সিএএ বিরোধী কিছু বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক জানায় আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগেই সিএএকে ঘোষনা করতে পারে ভারত সরকার। গত ১১ মার্চ মোদী সরকার সরকারী ভাবে সিএএকে আইন হিসাবে প্রনয়ন করে এবং এর নিয়ম প্রকাশ করে। সিএএ বিল ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালেই পাশ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ভারত সরকার এই আইন শুরু করবার আগে এর নিয়ম তৈরির জন্য কিছু সময় চেয়েছিল। বিগত চার বছরে আটবার সময় বাড়াতে হয়েছে সিএএর সঠিক নিয়ম তৈরির জন্য এরমধ্যে অনেক বিরোধীতাও সহ্য করতে হয়েছে ভারত সরকারকে। সিএএকে নিয়ে প্রধানত দুই ধরনের বিরোধীতা তৈরি হয়েছে।  

প্রথমত আসাম সহ উত্তর পূর্ব ভারতের বেশ কিছু রাজ্যের দাবী এই আইনের ফলে তাদের এলাকাতে অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে যা তাদের সংস্কৃতি ও ভাষার জন্য চিন্তার কারন। সেজন্য উত্তর পূর্ব ভারতের বেশ কিছু সংগঠন এই আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ন বিক্ষোভ করছে। সিএএ নিয়ে বিক্ষোভের আরেকটি কারন হল বিরোধীদের দাবী সিএএতে মুসলিম শরনার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কোনও ঘোষনা করা হয়নি। বিরোধীরা একে ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ১৪ এর সমানাধিকারের বিরোধীতা বলেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এর বিরুদ্ধে জানিয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ মুসলিম জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেজন্য সিএএতে মুসলিম শরনার্থীদের কথা বলা হয়নি। আমেরিকা ও জাতিসংঘ ভারতের এই নতুন সিএএ আইন নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করেছে। তবে ভারতের অধিকাংশ নাগরিকই কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। সিএএ আইনে শুধুমাত্র ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে আসা অমুসলিম শরনার্থীরাই নাগরিকত্ব পাবে, ৩১ ডিসেম্বরের পরে ভারতে আসা শরনার্থীরা ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার পদ্ধতি অনুসরন করে তবেই ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে তারা সিএএর সুবিধা পাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *