খালিস্তানি আন্দোলনের সঙ্গে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর কি সম্পর্ক!
নিউজ ডেস্ক – নিজেদের ধর্ম ও অস্তিত্ব বজায় রাখতে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছে অনেক ধর্মালম্বী মানুষেরা। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলে এই খালিস্তানি আন্দোলন। নিজেদের ধর্ম বজায় রাখতেই আন্দোলনের পথে নেমেছিলেন একাধিক শিখ ও পাঞ্জাব সদস্যরা। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন অব্যাহত ছিল ২০২১ সালের বর্ষশেষে মুম্বাই পর্যন্ত। কিন্তু কেন এই আন্দোলন!
ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার পর থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৮০ দশকের শেষ সময় থেকে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল খালিস্তানি আন্দোলন। তবে এই আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ছিল শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী। কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ায় সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্র হিসাবে পরিণত হলো পাকিস্তান এবং হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হলো ভারত। তবে হিন্দু ও মুসলিম আলাদা হয়ে গেলেও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছিলেন। সেই কারণেই শিখ ধর্মালম্বীদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে শুধুমাত্র ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ এবং পাঞ্জাব নিয়েই খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কথা উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৭০-৮০ দশকে হিমাচল প্রদেশ ,হরিয়ানা এবং রাজস্থানের কিছু অংশে ওই আন্দোলনের চিত্র স্পষ্ট হয়। এমনকি দেশ স্বাধীনতার পর শুরু হওয়া এই আন্দোলনের পাশাপাশি গোটা পৃথিবীর সিংহভাগ শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ ভিড় জমায় পাঞ্জাবে।
জানা গিয়েছে, খালিস্থান আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল ভারত ও ভারতের বাইরে। যদিও পরেরবার আন্দোলন একত্রিত হয়ে এক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। যেহেতু স্বাধীনতার পর থেকে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই কারণে এই আন্দোলনের সহযোগিতা করেছিল রাজ্যের রাজনৈতিক দল শিরোমনি আকালি। এরপরই নানান বিক্ষোভ অনশনের পর অবশেষে ১৯৬৬ সালে পৃথক পাঞ্জাব রাজ্যের দাবি মেনে নিয়েছিলেন তখনকার সরকার ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সরকার শিরোমনি অকালি দলের দাবি মেনে নিলেও তখনকার বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যায় শিরোমনি আকালি। যার কারণে ওদের দাবিও কিছুটা শিথিল হয়ে যায়।যদিও ১৯৭৩ সালে চন্ডিগড়কে পাঞ্জাবে ফিরিয়ে দেয় সরকার।
১৯৫৪ সালে যখন ভারতে খালিস্তান আন্দোলন হচ্ছে ঠিক সেসময় লন্ডনে চলে এসেছিলেন দবিন্দর সিং পারমার। মূলত সেই কারণেই বিদেশের মাটিতেও তিনি খালিস্তান পন্থী সভা শুরু করেছিলেন। যদিও প্রথম প্রথম সেই সভায় সেভাবে কোনো সাড়া পরেনি। কিন্তু তিনি হার না মেনে অব্যাহত রেখেছিলেন এই দাবি। এরপরই ১৯৭০ সালে বার্মিংহামে প্রথম বিদেশের মাটিতে খালিস্তানি পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তিনি। তবে আরেকটি চমৎকার ব্যাপার হলো সেই সময় লন্ডন এসেছিলেন পাঞ্জাব নির্বাচনে হেরে যাওয়া আকালি দলের নেতার জগজিৎ সিং চৌহান। সে কারণেই একই দাবিতে দুই ব্যক্তি আলাদা না হয়ে দুজনে মিলে খালিস্তানি আন্দোলনের ঘোষণা করেছিল।
খালিস্তানি আন্দোলন সফল হওয়ার আগেই ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে জগজিৎ সিং চৌহানের পাকিস্তান সফরে ভারতের খালিস্তান আন্দোলন পরিচয় হয়েছিল। জনগণের সমর্থনে অভাব থাকলেও যথেষ্ট প্রচারিত হয়েছিল এই আন্দোলনটি। এমনকি এটি এতটাই ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছিল যে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এছাড়াও নানকানা সাহিবকে খালিস্থানে রাজধানী করার প্রস্তাব রেখেছিলেন। এরপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র ঘোষণা করে দিয়েছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী। যার কারণে এটি রাষ্ট্রদ্রোহ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ বলে একাধিক অভিযোগ করেছিল ভারত।
নানাবিধ বাঁধা আসা সত্ত্বেও খালিস্তানি আন্দোলনে কোনদিনই বিরতি দেয়নি বিক্ষোভকারীরা। ১৯৭৯ সালে ব্রিটেনে চৌহান জাতীয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছিল। যার কারণে ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮০ সালে একই সঙ্গে লন্ডন এবং অমৃতসর থেকে খালিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। মূলত এই দুই জায়গা থেকে খালিস্থান স্বীকৃতি পাওয়ার পরই প্রতীকী পাসপোর্ট, ডাক স্টাম্প, ডলার ব্রিটেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের দূতাবাস খোলা হয়েছিল। আবার খালিস্তান জাতীয় কাউন্সিলর ব্রিটেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ইকুয়েডরের একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। এমনকি সেই সময়ে ভারতে যোগাযোগ করেছিলেন শেখ নেতা তথা ধর্মতান্ত্রিক শিখ স্বদেশের প্রচারক সিঙ্ক ভিন্দ্রানওয়াল।
১৯৮২ সালে দিল্লিতে নবম বার্ষিক এশিয়ান গেমসকে ব্যাহত হওয়ার জন্য বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত নেয় অকালি দল। কিন্তু বিক্ষোভের এক সপ্তাহ আগে দিল্লি ও পাঞ্জাব সীমান্ত সিল করে দিয়েছিল হারিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভজনলাল। যার কারণে বিক্ষোভ না হওয়ায় রক্তপাতের হাত থেকে বেঁচে ছিল পাঞ্জাব। যদিও সেই দিনের পর আকালি দল এবং ভিন্দ্রানওয়ালে প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল শিখ সেনাদের। তবে ১৯৮০ সালে সেই পাঞ্জাবের মাটি রক্তাক্ত হওয়ার পেছনে হাত ছিল ভিন্দ্রানওয়ালের অনুগামীদের। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৮৩ সালে দরবার সাহেবের গেটের ডিআইজি অবতার সিং অটওয়ালের হত্যার ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল গোটা রাজ্যে। এমনকি ভিন্দ্রানওয়ালে অনুমতি না থাকায় দীর্ঘ দুঘন্টা মৃতদেহ পরে ছিল পুলিশ অফিসারের। তবে এই খুনের ঘটনার পেছনে কারা জড়িত রয়েছে এবং তারা কোথায় রয়েছে সেটা জানা সত্ত্বেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। কারণ অভিযুক্তরা সেসময় অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এমনকি গুরুদোয়ারাতে ট্রাক বোঝাই অস্ত্র আসার খবর সরকারের কাছে। সেক্ষেত্রে স্বর্ণমন্দিরে পুলিশ গেলে শিখ ধর্মের মানুষদের ধর্মের উপর আঘাত করা হবে বলে অনুমান করেছিলেন সরদার। তবে একের পরে এক হত্যায় মাটি রক্তে লাল হয়ে ওঠায় চুপ থাকতে পারেননি ইন্দিরা গান্ধীও। একসময় ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ১৯৮৪ সালে ১লা জুন ভারতীয় সেনাকে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে ও তার সশস্ত্র অনুগামীদের অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। এরপরই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার জন্য শুরু হয় অপারেশন ব্লু স্টার।
পরবর্তীতে সেনাবাহিনীদের সঙ্গে এই অপারেশনের যুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এবং পাঞ্জাব পুলিশ। এরপরেই আসে সেই মর্মান্তিক দিন। যেদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রার নেতৃত্বে স্বর্ণ মন্দির চত্বর ঘিরে ফেলা হয়েছিল। এরপরে দু’পক্ষের মধ্যে টানা একদিন অ্যান্টিট্যাঙ্ক, মেশিনগান, গ্রেনেড লঞ্চার ও গোলাগুলির পর অবশেষে মৃত্যুর সামনে হার মেনেছিল ভিন্দ্রানওয়ালে। এমনকি তার সঙ্গে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৪৯৩ জন অনুগামীর, যদিও বাকিরা পলাতক বলেই অভিযোগ।
যেহেতু ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশ অনুসারে পাঞ্জাবের খালিস্তানি আন্দোলনের নেতাদের উপর হামলা করা হয়েছিল সেই কারণে পাঞ্জাব সদস্যদের ক্ষোভ ছিল গান্ধী পরিবারের উপর। কার্যত ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিশোধ নিতে ইন্দিরা গান্ধীকে তার দুই নিরাপত্তারক্ষী সতবন্ত সিং ও বিয়ন্ত সিংকে মোহরা বানিয়ে তাকে খুন করে পাঞ্জাবীরা। যেহেতু দুজন পাঞ্জাবি নিরাপত্তারক্ষী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে খুন করেছিলেন সেই জন্য উত্তর ভারত জুড়ে শিখবিরোধী দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল। যদিও সেটি পরে পাত্তা পায়নি।
তবে এত কিছুর পরও খালিস্তানি জঙ্গিবাদ খতম হয়নি। ভারতে ও ভারতের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা এখনও সক্রিয়। বাব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনাল, ভিন্দ্রানওয়ালে টাইগার ফোর্স অফ খালিস্তান (BTFK), ভিন্দ্রানওয়ালে টাইগার ফোর্স (BTF), খালিস্তান কমান্ডো ফোর্স (KCF), খালিস্তান লিবারেশন আর্মি (KLA), খালিস্তান লিবারেশন ফোর্স, খালিস্তান জিন্দাবাদ ফোর্স (KZF), আন্তর্জাতিক শিখ যুব ফেডারেশন (ISYF),অল ইন্ডিয়া শিখ স্টুডেন্টস ফেডারেশন (AISSF), দশমেশ রেজিমেন্ট, শহীদ খালসা বাহিনী – ভারত-সহ বিভিন্ন দেশে এই সব খালিস্তানপন্থী সংগঠনগুলি জঙ্গি তালিকাভুক্ত।
জঙ্গিবাদের পাশপাশি বিদেশের মাটিতে খালিস্তানপন্থীরা বহু সভা, সমিতি, মিছিল আয়োজন করে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিখ ফর জাস্টিস নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে, যাকে ২০২০ সালে জঙ্গি সংগঠনের তালিকাভুক্ত করেছে ভারত। ২০১৪ সালেই ‘খালিস্তানের জন্য গণভোট ২০২০’ নামে একটি প্রচার শুরু করেছিল তারা। ২০২০ সালে এই নামে একটি ওয়েবসাইটও খোলা হয়। এই সংগঠনটি এখন বিভিন্ন দেশেই বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তাই খালিস্তানের দাবি এখনও মুছে যায়নি।