ডিফেন্স

জানেনকী রাশিয়ান গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি ভারতকে নিয়ন্ত্রন করতে চেয়েছিল

রাজেশ রায়:– যখনই আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর কথা বলা হবে তখন রাশিয়ার নাম সবার প্রথমে আসবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন হোক কিংবা রাশিয়া ভারতের সাথে উভয়েরই সম্পর্ক খুব ভাল ছিল ও আছে। ভারতের প্রতিরক্ষা সেক্টরের ৭০ শতাংশ অস্ত্রই রাশিয়া থেকে ক্রয় করা। সেই ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে শুরু করে কাশ্মীর সমস্যা সব কিছুতেই রাশিয়া ভারতকে সমর্থন করেছে। কিন্ত কখনও কী ভেবে দেখেছেন রাশিয়া কেন ভারতকে এতটা সমর্থন করে? কিন্তু যদি বলা হয় রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা সময় প্রত্যক্ষ ভাবে ভারতকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করেছিল তাহলে হয়ত অনেকেই হয়ত বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এখানে যা বলা হচ্ছে তার প্রতিটি কথা সত্য। আসলে জিওপলিটিক্সে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী বন্ধু বলে কীছু হয় না। এসম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে সাথে এটাও বলা হবে কীভাবে রাশিয়ান ইনটেলিজেন্স সংস্থা কেজিবি ভারতের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করত।

সময়টা ১৯৪৭ সাল, ভারতের ইতিহাসের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাল এটি। এই বছরই ব্রিটেনের থেকে স্বাধীনতা পায় ভারত। তবে সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতের সামনে অপেক্ষা করছিল সেসময়ের সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক সংকট ঠান্ডা যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে শ্রেষ্ঠ তার জন্য। আমেরিকা ছিল গনতন্ত্রের প্রচারক অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল কমিউনিজমের প্রচারক। দুই দেশই বিশ্বে নিজের প্রভাব বাড়াতে একাধিক দেশকে নিজের বলয়ে টানতে চেষ্টা করছিল যার জন্য গোটা বিশ্ব দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিম ইউরোপ আমেরিকার দিকে এবং পূর্ব ইউরোপ সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইউরোপের পর দুই দেশেরই নজর পড়ে এশিয়ার উপর, বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারত পাকিস্তানের উপর। আমেরিকা পাকিস্তানকে তাদের দিকে টানতে শুরু করে ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে তাদের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বিপ্লবের পরই ভারতে কমিউনিজম পৌঁছে গিয়েছিল যার ফলস্বরূপ ১৯২৫ সালে ভারতের সবচেয়ে পুরোনো কমিউনিস্ট দল কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া বা সিপিআই এর প্রতিষ্ঠা হয়। এরপরই শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের জিওপলিটিক্যাল নীতি। এসম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির ডিরেক্টর ভাসিলি মিত্রখিনের লেখা দি মিত্রখিন আর্কাইভ ২ তে। 

ভারতের ইনটেলিজেন্স সংস্থার নাম যেমন “র” তেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের এই গুপ্তচর সংস্থা হচ্ছে কেজিবি বা কমিতেত গোসুদারস্টেভনয় বেজোপাসনোস্তি। সোভিয়েত ইউনিয়নের খুব সহজ পরিকল্পনা ছিল ভারতের সিপিআই দলকে ফান্ডিং করা যাতে নেহেরু সরকারকে ফেলে দেওয়া যায়। এর জন্য কেজিবির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠিক করে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসারদের প্রচুর টাকা দেওয়া হবে এবং হানিট্রাপ পদ্ধতি নেওয়া হবে অর্থাৎ সুন্দরী মহিলাদের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে তাদের ব্ল্যাকমেল করা হবে। দেখুন যেসব কথা বলা হচ্ছে একটাও বানানো কথা হয় সব ওই দি মিত্রখিন আর্কাইভ ২ বইয়ে লেখা আছে। নেহেরু সরকারকে পরিবর্তনের চেষ্টা করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন কারন সেসময় নেহেরুর নেতৃিত্বে কিছু দেশ মিলে জোট নিরপেক্ষ ছিল তারা কোন পক্ষেই যোগ দিতে চাইছিলনা। কিন্তু ভারতের ইনটেলিজেন্স সংস্থার কারনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পনা ততটা সফল হতে পারেনি। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন লক্ষ্য করল জহরলাল নেহেরু জাতিসংঘে মিশরের উপর ফ্রান্সের আক্রমনের বিরুদ্ধ কথা বলে কিন্তু হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আক্রমনের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনি। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বুঝতে পারে নেহেরু একটু সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থক সেজন্য ভারতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হবার চেষ্টা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন বুঝতে পেরেছিল ভারতে সিপিআই একা সরকার গঠন করতে পারবেনা। সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নতুন স্ট্রাটেজি তৈরি করে। 

কেজিবি কংগ্রেসের ভিতর তাদের এজেন্ট তৈরির চোষ্টা শুরু করে। এর প্রথম শিকার হয় কৃষ্ণা মেনন যিনি ১৯৫৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়েছিলেন। কৃষ্ণা মেনন ভারতের প্রতিরক্ষা সামগ্রী পশ্চিমের থেকে কেনা বাদ দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কেনা শুরু করে। ১৯৬৪ সালে জহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন চাইছিল ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী হোক বাম ঘেঁষা গুলজারিলাল নন্দা কিন্তু ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয় লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। তাসখন্ডে ভারত পাকিস্তান শান্তি চুক্তিতে সই করবার সময় রহস্যময় ভাবে মৃত্যু হয় লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর। যা আজও রহস্য, এমনকী কোনও অদৃশ্য কারনে তখন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃতদেহের ময়নাতদন্তও করা হয়নি। তাসখন্দ ফাইল বলে একটি সিনেমায় এব্যাপারে খুব ভালো ভাবে দেখানো হয়েছে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের টার্গেট হয় ইন্দিরা গান্ধী। যদিও ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তাও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইন্দিরা গান্ধীর উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলনা যার জন্য ১৯৬৭ সালে ভারতে সাধারন নির্বাচনে সোভিয়েত ইউনিয়ন সিপিআইকে ফান্ডিং করেছিল কিন্তু নির্বাচনে শেষপর্যন্ত কংগ্রেস জয়লাভ করে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন কংগ্রেসের ৩০-৪০ শতাংশ এমপিকে কিনে নেয় বলে মত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের। অন্যদিকে কংগ্রেসের ভিতর মোরারজী দেশাই ও ইন্দিরা গান্ধী এই দুই ভাগ হয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধী তার মেজরিটি বজায় রাখতে সিপিআইয়ের সাথে জোট করে ১৯৬৯ সালে। এইভাবে এতদিন পর সরাসরি ভারতের রাজনীতিতে যুক্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬৯ সালে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি গোপন বন্ধুত্বের চুক্তি হয় যা সম্পর্কে জানত মাত্র ১৩ জন লোক। এর কিছুমাস পরেই ব্যাঙ্কের জাতীয়করন করে ইন্দিরা গান্ধী সরকার। তবে কিছুমাস পরেই সিপিআই কংগ্রেসের প্রায় সমস্ত এমএলএদের নিজেদের পক্ষে করে নিয়ে খোদ ইন্দিরা গান্ধীকেই কংগ্রেস থেকে বের করে দেয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে ইন্দিরা গান্ধী আবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বলা হয় সেসময় ভারতে কংগ্রেসকে জেতাবার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচুর অর্থ খরচ করেছিল। ১৯৭৩ সাল আসতে আসতে ভারতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে দিল্লী তে সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়ান ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্ডিয়া তৈরি করেছিল। ততদিনে ভারতের প্রথম সারির দশটি মিডিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নেরই ছিল। কিন্তু এসব সত্বেও সেসময় ভারতের মানুষ ইন্দিরা গান্ধীকে যে ব্যাপক সমর্থন করত সরকম সমর্থন আজও কোন প্রধানমন্ত্রী পায়নি।

সেসময় ভারতে কমিউনিজমের প্রভাব বাড়ছিল, অন্যদিকে আমেরিকার নেতৃত্বে পাকিস্তানে ক্যাপিটালিজম হচ্ছিল। কমিউনিজম ও ক্যাপিটালিজমের মধ্যে পার্থক্যটা একটু জানা দরকার। কমিউনিজমে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ বা বাজার সম্পূর্ণ সরকার নিয়ন্ত্রন করে কিন্তু ক্যাপিটালিজমে বেসরকারী সংস্থা ও সরকার যৌথভাবে অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা গড়ে তোলে যা অনেক বেশী শক্তিশালী অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে তোলে। কমিউনিজমে বলা হয়েছে কেউ গরীব কেউ বড়লোক থাকবেনা সবার সমান অধিকার কিন্তু বাস্তবে সবচেয়ে দূর্নীতি কমিউনিস্ট দেশ গুলোতেই হচ্ছে কারন প্রতিবাদ করার কেউ নেই। অন্যদিকে ক্যাপিটালিজমে আয়ের উপর ভিত্তি করে কেউ গরীব কেউ ধনী হয়। কমিউনিজমে কোন ধর্মকে মানা হয় না কারন কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্ক্সের বক্তব্য ছিল ধর্ম হচ্ছে আফিমের নেশার মতন যা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ক্যাপিটালিজমের সব ধর্মকেই সমান স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এবার আপনাদের মনে হবে কমিউনিজম ঠিক বাকী ক্যাপিটালিজম! তাহলে কীছু উদাহারন দিয়ে বোঝানো যাক। কমিউনিজমের সবচেয়ে বড় সমর্থক দুটি দেশ চীন ও সোভিয়েত। ১৯৪৯-৭৭ সাল অবধি চীনের প্রেসিডেন্ট ছিল মাও জে ডং, যার একের পর এক ভুল নীতির জন্য সেসময় চীনের অর্থনীতি এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছিল যে চীনে খাদ্য সংকট তৈরি হয় যার করনে প্রায় ১০ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয়। ১৯৮০ সাল থেকে চীন তাদের অনেক সেক্টরে ক্যাপিটালিজম নিয়ে আসে যার ফলে চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিকাশ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নও আমেরিকার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে পুরো পঙ্গু হয়ে যায় যার ফলস্বরূপ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে ১৫ টি দেশ তৈরি হয়। কিউবা, উত্তর কোরিয়ার মতন  দেশ গুলোও কমিউনিজমের ফলে পুরো গরীব হয়ে গেছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট বলা যায় শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য ক্যাপিটালিজম কমিউনিজমের থেকে অনেক বেশী কার্যকারী। এই কথা গুলো এতক্ষন বলার কারন সেসময় কেজিবির প্রধান লক্ষ ছিল ভারতে কমিউনিজম ছড়িয়ে দেওয়া। 

১৯৭৩ সালে আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পর আরব দেশ গুলো তেলের দাম ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় সুতরাং ভারতেরও তীব্র অর্থনৈতিল সংকট তৈরি হয়েছিল। মুদ্রাস্ফীতি ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল, খাদ্য সংকট দেখা গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার সাথে সাথে কেজিবিকেও ভেঙে দেওয়া হয় ফলে ভারতে কেজিবির অপারেশন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভারতেরও কমিউনিজমের নেশা কেটে যায়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় অর্থনীতি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল যে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ প্রায় ছিলনা বললেই চলে। ভারতের অবস্থা অনেকটা আজকের শ্রীলঙ্কার মত হয়ে গিয়েছিল। তখন নরশিমা রাওয়ের সরকার বুঝতে পেরছিল এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের একটাই উপায় ক্যাপিটালিজমের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেই যে ভারত আর্থিক উন্নয়নের রাস্তায় চলা শুরু করল যার ফল স্বরূপ আজ ভারতের বৈদেশিক রিজার্ভ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম এবং ভারত পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। আজ ভারতের সাথে রাশিয়ার খুব ভাল সম্পর্ক থাকলেও সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মত ভারত রাশিয়ার উপর এতটাও নির্ভরশীল নয় বরং আন্তর্জাতিক স্তরে একঘরে হয়ে পড়া রাশিয়াই অর্থনীতির জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল। ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু যদি কেউ থেকেই থাকে তা হচ্ছে ইসরায়েল। তবে আবারও বলা দরকার জাতীয় স্বার্থের উপর ভিত্তি করে জিওপলিটিক্সে সমীকরন সবসময় পরিবর্তন হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *