ডিফেন্স

ভারতকী চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী যুদ্ধে প্রস্তত?

রাজেশ রায়:— ভারতের প্রতিবেশী দেশ গুলোর তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, বাংলাদেশ যাদের সাথে ভারতের স্থলসীমানা রয়েছে। এদের মধ্যে ভারতের প্রধান দুটি শত্রু দেশ হচ্ছে পাকিস্তান ও চীন। যার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সবসময় টু ফ্রন্ট বা দ্বিমুখী যুদ্ধের জন্য প্রস্তত থাকতে হয়। ভারতীয় স্ট্রাটেজিস্ট বহুদিন ধরেই বলে আসছে দ্বিমুখী যুদ্ধের কথা। স্বর্গীয় চীফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বীপিন রাওয়াত জী একবার বলেছিলেন ভারত দ্বীমুখী যুদ্ধের জন্য প্রস্তত যা প্রাক্তন এয়ারচীফ মার্শাল বিবেক রাম চৌধুরীও স্বীকার করেছেন। টু ফ্রন্ট ওয়ার বা দ্বিমুখী যুদ্ধ আসলে কী? ভারতীয় সেনাবাহিনীকী সত্যিই এর জন্য প্রস্তত!

দক্ষিন এশিয়াতে টুফ্রন্ট ওয়ারের সম্ভবনা ভারত স্বাধীন হবার পর থেকেই তৈরি হয়। চীন ও পাকিস্তানের মতন প্রতিবেশীর সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা মাথায় রেখেই প্রতিবছর ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ঠিক হয়। ভারত ও চীনের মধ্যে একবারই পূর্ন যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৬২ সালে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চারবার পূর্ন যুদ্ধ হয়েছে এবং প্রতিটিতেই পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে। যার কারনে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরেই প্রক্সি যুদ্ধ করছে যার প্রমান মুম্বাই থেকে কাশ্মীরে পাওয়া যায়। প্রক্সি যুদ্ধ বা ছায়া যুদ্ধ কোন দুর্বল দেশের বৈশিষ্ট্য। পাকিস্তান জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে কাশ্মীর উপত্যকাকে অশান্ত করায় এবং ভারতে নিত্য জঙ্গি আক্রমনের পরিকল্পনা করে। প্রকারভেদে যুদ্ধ দুধরনের কনভেনশনাল যুদ্ধ, যাতে পরমানু অস্ত্র ব্যাবহার করা হয় না এবং পরমানু যুদ্ধ। দ্বিমুখী যুদ্ধের ঘটনা এখান থেকেই এসেছে। পাকিস্তান চারবার ভারতের বিরুদ্ধে কনভেনশনাল যুদ্ধে পরাজিত হবার পর সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে তখনই যুদ্ধ করবে যখন অন্য আরেকটি শক্তিশালী দেশ ভারত আক্রমন করবে। আর এরজন্য পাকিস্তানের সবচেয়ে আদর্শ বন্ধু হচ্ছে চীন। বহুদিন ধরেই দ্বিমুখী যুদ্ধের ব্যাপারে বলা হচ্ছিল তবে গালোয়ান ভ্যালিতে ভারত ও চীনের সেনাদের সংঘর্ষের পর থেকে এই বিষয়ে আরও বেশী প্রস্ততি নিতে শুরু করে ভারত।

প্রাক্তন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল নারাভানে বলেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী যুদ্ধ একমাত্র চীন ও পাকিস্তানের মাধ্যমেই হতে পারে। ঠিক এইজন্য সিয়াচেন ও সাক্সাগাম উপত্যকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন এখানেই দুই দেশের নিয়ন্ত্রন রয়েছে। জেনারেল নারাভানের বক্তব্য অনুযায়ী চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে মিলিটারি ও নন মিলিটারি ক্ষেত্রে সম্পর্ক ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যার জন্য ভারতকে দ্বিমুখী যুদ্ধের সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এবার জানা যাক ভারতের এই দ্বিমুখী যুদ্ধের প্রস্ততি সম্পর্কে। 

ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা খুবই শক্তিশালী। ইসরায়েলের স্পাইডার স্যাম, এম আর স্যাম, ভারতের নিজস্ব তৈরি আকাশ স্যাম সহ রাশিয়ান এস ৪০০ যুক্ত ভারতের এয়ারডিফেন্স সিস্টেম যথেষ্ট শক্তিশালী। ২০১৮ সালেই ভারত রাশিয়া থেকে পাঁচ রেজিমেন্ট এস-৪০০ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করে। ইতিমধ্যেই দুই রেজিমেন্ট এস-৪০০ ভারতে এসে পৌঁছেছে এবং তা নির্দিষ্ট স্থানে মোতায়েন করা হয়েও গেছে। এলএসি জুড়ে লাদাখ উপত্যকার পাশে তিনটি এয়ারবেসে চীনা যুদ্ধবিমান আছে। এই এস-৪০০ আসার পর চীনের বায়ুসেনা যথেষ্ট চাপে থাকবে। এছাড়া ফ্রান্স থেকে ৩৬ টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান ভারতের বায়ুসেনাতে যুক্ত হয়েছে। এই মহূর্তে চীনের বায়ুসেনাতে রাফায়েলের সমতুল্য বিমান নেই। চীনের নামে পঞ্চম প্রজন্মের জে-২০ বিমান থাকলেও তার থেকে ভারতের ৪.৫ প্রজন্মের রাফায়েল অনেকটাই আধুনিক। এলএসি এলাকায় সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য ভারত হ্যাল থেকে এলসিএইচ হেলিকপ্টার কিনছে এবং ইতিমধ্যেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অ্যাটাক হেলিকপ্টার অ্যাপাচি যুক্ত হয়েছে ভারতের বায়ুসেনাতে। ২০৩০ এর মধ্যে অন্তত ৩৫ স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনাতে। এছাড়া ভারতীয় বায়ুসেনা ও নৌবাহিনীর মধ্যে একটি সমন্বয় গঠন করা হচ্ছে যাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এই দুই বাহিনী একসাথে কাজ করতে পারে। আমকার মতন পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান প্রজেক্ট, তেজস মার্ক ২ বিমান এবং ঘাতক ড্রোনের মতন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে কাজ করছে ভারত যা অদূর ভবিষ্যতে ভারতকে যথেষ্ট শক্তিশালী করবে। 

কীছু বছর আগেও ভারত প্রতিরক্ষা সেক্টরে শক্তিশালী তো ছিলই কিন্তু ভারতকে এতটা পাত্তা দেওয়া হত না কারন সবাই জানত ভারতীয় সেনা আগে থেকে আক্রমন করবেনা। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক, ডোকলামের ঘটনা এবং গালওয়ান উপত্যকায় ভারতের সমুচিত জবাব দেবার ঘটনা বাকী বিশ্বের সামনে প্রমান করে দিয়েছে ভারত প্রয়োজনে কতটা আগ্রাসী হতে পারে। একটি দেশ সামরিক ক্ষমতায় কতটা বলীয়ান হলে তবেই সে আগ্রাসী হতে পারে তা চীন, পাকিস্তান ভাল মতই জানে। যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কথা বলা হয় তাহলে সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত ইনসাস রাইফেলের বদলে রাশিয়ান ঘাতক একে-২০৩ কেনা হচ্ছে, সাথে আমেরিকান সিগ-৭১৬ সহ একাধিক বন্দুক, স্নাইপার, মেশিনগান কেনা হচ্ছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেকানাইজড ইনফ্রন্টিকে শক্তিশালী করবার জন্য ভারত ২০৩০ এর মধ্যে ১৭০০ এফআরসিভি বা ফিউচার রেডি কমব্যাট ভ্যেইকেল কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। যেকোন ভূমিতে চলতে সক্ষম এই এফআরসিভিকে লিউটেন্যান্স জেনারেল এ বি সিভানে গেম চেঞ্জার বলেছে। সাধারন ব্যাটেল ট্যাঙ্ক গুলোর থেকে এই এফআরসিভি প্রযুক্তিগত ভাবে অনেক উন্নত কারন এফআরসিভি ড্রোনের হামলাকেও প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য লেজার সহ বিভিন্ন ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনসের উপরও কাজ চলছে। 

দীর্ঘদিন পাকিস্তান কেন্দ্রিক মোনোভাব থেকে সরে এসে ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিম সীমান্তের পাশাপাশি উত্তর সীমান্তেও সমান প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েছে। এবার জানা যাক ভারতের নেভাল পাওয়ার সম্পর্কে। একবিংশ শতাব্দীতে যেকোনো দেশের সেনাবাহিনী, বায়ুসেনার থেকে নেভিকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি কখনও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় তা সমুদ্রেই হবে কারন বিশ্বের সিংহভাগ সামুদ্রিক বানিজ্য নৌপথেই হয় যার জন্য নিজেদের বানিজ্য জাহজকে নিরাপত্তা ও নিজের দেশের সামুদ্রিক সীমানা রক্ষার জন্য শক্তিশালী নেভি দরকার। চীন দ্রুত গতিতে তার নেভিকে শক্তিশালী করছে দক্ষিন চীন সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর হয়ে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত চীন তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে। চীন তার লোনের ফাঁদে ফলে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল ও আফ্রিকার একাধিক দেশের বন্দরগুলো লিজে নিয়ে ভারতকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করছে যাকে চীনের বিখ্যাত স্ট্রিং অফ পার্লস নীতি বলে। এর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মায়ানমার, বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দরের মাধ্যমে ভারতকে ঘিরে ফেলবার পরিকল্পনা নিয়েছে চীন। যার জন্য ভারত তার তিন বাহিনীর মধ্যে নেভিকেই সবচেয়ে বেশী আধুনিক করে তুলছে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় নৌবাহিনীতে ছয়টি স্করপিয়ন ক্লাস সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে। পি-৭৫আই টেন্ডারে আরও ছয়টি সাবমেরিন কিনবে ভারত। আরিহান্ট ক্লাস নিউক্লিয়ার সাবমেরিন আরও তৈরি করা হচ্ছে। আইএনএস বিক্রান্ত নামে একটি নতুন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুক্ত হয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীতে। নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট, অ্যাডমিরাল গ্রিগরভিচ ক্লাস ফ্রিগেট, বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার সহ একাধিক যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে ভারত। 

আমেরিকা থেকে সাবমেরিন খোঁজার জন্য পি-৮আই বিমান, এমএইচ-৬০ আর হেলিকপ্টার কিনেছে ভারত। তবে যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিনের দিক দিয়ে ভারতীয় নেভির তুলনায় অনেকটাই শক্তিশালী চাইনিজ নেভি। এইজন্য ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে ভারত, আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার একটি জোট গঠন হয়েছে যার নাম কোয়াড যা চীনকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। দক্ষিন চীন সাগরেও ভারতীয় নেভি তার যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে। এই কোয়াড দেশ গুলো একত্রে মালাবার এক্সারসাইজ করে যা চাইনিজ নেভিকে কাউন্টার করার কৌশল সম্পর্কেই করা হয়। এছাড়া এই চারটি দেশ ফ্রান্সের সাথে লা পেরৌস এক্সারসাইজ করে। ফ্রান্স এখানে যুক্ত হয়েছে কারন ভারত মহাসাগরে ফ্রান্সের রিইউনিয়ন দ্বীপ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজিক অবস্থান রয়েছে। এছাড়াও ভারত তার কুটনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আসিয়ান দেশ এবং দক্ষিন চীন সাগরের দেশ গুলোর সাথে জোট তৈরি করছে। সমুদ্রপথে ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনই কারন পাকিস্তানের নেভি তেমন শক্তিশালী নয় বললেই চলে। ২০২০ সালে এলএসিতে ভারত চীন সংঘর্ষের সময়ও ভারত প্যাংগং লেকে তার সেনা মোতায়েন করে। এইসময়ই জীবুতি থেকে তিনটি চাইনিজ যুদ্ধজাহাজকে ফিরে যেতে বাধ্য করে ভারতীয় নেভি এবং মালাক্ক প্রনালী থেকেও তিনটি চাইনিজ যুদ্ধ জাহজকে ফেরায় ভারত। এই ঘটনা প্রমান করে বহরে বেশী হলেও এখনও ভারত মহাসাগরে ভারতের আধিপত্য মজবুত। এই তিন বাহিনীর পাশাপাশি ভারত সাইবার সিকিউরিটি সেক্টর এবং ইসরোর মাধ্যমে স্পেস টেকনোলজিও ক্রমশ মজবুত করছে। সুতরাং এটা বলাই যায় ভারতীয় সেনা একই সাথে চীন ও পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *