অমাবস্যায় মহাদেব এবং পূর্নিমার সময় দেবী পার্বতী পুত্র কার্তিকের সাথে দেখা করতে আসেন। ভগবান শিবের দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গের ইতিহাস
রাজেশ রায়:– ভারতবর্ষের এই মহান ভূমি চন্দনের থেকেও পবিত্র। ভারতবর্ষের বুকে জন্ম নেওয়া সনাতন ধর্মের ইতিহাস যে কত পুরোনো এবং কে এই ধর্ম প্রচার করেছিল তা কেউই জানে না, যার জন্য সনাতন হিন্দু ধর্মকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম বলা হয়। এত প্রাচীন কোন ধর্ম আজ বিশ্বে নেই। সনাতন ধর্ম শুধু বিশ্বাস নয় বরং জীবন অতিবাহিত করার এক পথ। সানতন ধর্ম অনুসারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে ত্রিদেব বলা হয়। ভগবান শিব বা মহেশ্বরকে ধ্বংস কর্তা বলা হয়। প্রলয় ও তান্ডব কারী ভগবান শিবের মতন দয়ালু আর কেউ নেই। ভারতবর্ষের বারোটি এমন জায়গা আছে যেখানে ভগবান শিব স্বয়ং তার ভক্তদের দর্শন দিয়েছিলেন, সেজন্য এই বারো স্থানে মহাদেবের বিশেষ স্থান হিসাবে গন্য করা হয়। শাস্ত্রে এই স্থান গুলোকে দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গ বলা হয়। দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গ গুলির নাম, ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। হিন্দু ধর্মের ১৮ মহাপুরানের মধ্যে শিব পুরানে দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই বারো জ্যোর্তিলিঙ্গ দর্শন করলে মুক্তি লাভ হয়।
১) সোমনাথ:– দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গের মুখ্য ও প্রথম হচ্ছে সোমনাথ। শিবপুরান অনুযায়ী প্রজাপতি দক্ষ তার ২৭ কন্যার বিবাহ চন্দ্রদেবের সাথে দেন। এইসব কন্যাদের মধ্যে একজন ছিলেন রোহিনী যাকে চন্দ্রদেব সবচেয়ে বেশী ভালবাসতেন। এর ফলে ওনার বাকী ২৬ জন স্ত্রী খুবই দুঃখী থাকতেন। একদিন সেই ২৬ জন তাদের পিতা প্রজাপতি দক্ষের কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা বলে। এরপর রাজা দক্ষ চন্দ্রদেবকে ডেকে বোঝান তার উচিৎ সব স্ত্রীকে সমান ভাবে সমাদর করা। কিন্তু চন্দ্রদেব ওনার কথা না শুনে আবারও রোহিনীকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেন। এরপর রাজা দক্ষ ক্রুদ্ধ হয়ে চন্দ্রদেবকে অভিশাপ দেন ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হবার। চন্দ্রদেবের এই অবস্থা দেখে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল তিন লোকেই হাহাকার পড়ে যায়। দেবরাজ ইন্দ্র সহ সমস্ত দেবতা ব্রহ্মাজীর কাছে উপস্থিত হন এর প্রতিকার জানতে। ভগবান ব্রহ্মা বলেন প্রভাস তীর্থে চন্দ্রদেব মহাদেবের আরাধনা করলে এই রোগ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। সেই অনুযায়ী চন্দ্রদেব প্রভাস তীর্থে ছয়মাস তপস্যা করার পর মহাদেবের দর্শন পান। মহাদেবের আশীর্বাদে চন্দ্রদেব একপক্ষে অর্থাৎ ১৫ দিন অন্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং ১৫ দিনে ধীরে ধীরে পূর্ণ রূপে ফিরে আসেন। চন্দ্রদেবের আরাধনায় খুশি হয়ে মহাদেব তার একটি অংশ সেখানেই রেখে যান যা সোমেশ্বর মহাদেন নামে তিন লোকে বিখ্যাত হয়। বলা হয় এই তীর্থে যিনি মহাদেবের উপসনা করেন তিনি সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি লাভ করেন। বর্তমানে সোমনাথ তীর্থ গুজরাটে অবস্থিত।
২) মল্লিকার্জুন :– শিবপুরান অনুযায়ী ভগবান শিবের দ্বিতীয় জ্যোর্তিলিঙ্গ হচ্ছে মল্লিকার্জুন। বলা হয় একবার ভগবান শিব ও দেবী পার্বতী তাদের দুই পুত্র গনেশ ও কার্তিকের বিবাহের চিন্তা করেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারছিলেননা প্রথমে কাকে বিয়ে দেবেন। সেজন্য তারা গনেশ ও কার্তিককে বলেন যে আগে সম্পূর্ণ পৃথিবী প্রদক্ষিন করে আসবে তারই আগে বিয়ে হবে। একথা শুনে কার্তিক তার বাহন ময়ূর নিয়ে বেড়িয়ে যান পৃথিবী প্রদক্ষিনে। গনেশ তখন ভাবেন তার বাহন তো ময়ূর তাতে করে পৃথিবী প্রদক্ষিনে তো অনেক বছর সময় লাগবে। সেজন্য তিনি মা পার্বতী ও পিতা মহাদেবকে প্রদক্ষিন করেন এবং বলেন ওনার কাছে ওনার বাবা মাই ওনার সম্পূর্ণ পৃথিবী। মহাদেব ও পার্বতী গনেশের উপর খুবই প্রসন্ন হন এবং রিদ্ধি ও সিদ্ধি নামে দুই কন্যার সাথে গনেশজীর বিয়ে দেন। এর কিছুদিন কার্তিক পৃথিবী প্রদক্ষিন করে এসে সব ঘটনা জানতে পেরে খুবই রেগে যান এবং তিনি জীবনে বিবাহ না করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে কৈলাস ছেড়ে ক্রন্চ পর্বতে চলে যান। মহাদেব ও পার্বতীও সেখানে যান কার্তিককে অনেক বোঝান কিন্তু কার্তিক আর বিয়ে করতে রাজি হননি। তখন মহাদেব ও পার্বতী জ্যোর্তিলিঙ্গ রূপে সেখানেই থেকে যান। এই তীর্থই মল্লিকার্জুন নামে বিখ্যাত। এখানে মল্লিকা মানে দেবী পার্বতী এবং অর্জুন মানে মহাদেব। বলা হয় অমাবস্যায় মহাদেব এবং পূর্নিমার সময় দেবী পার্বতী পুত্র কার্তিকের সাথে দেখা করতে আসেন এখানে। মল্লিকার্জুন তীর্থ অন্ধ্রপ্রদেশে অবস্থিত।
৩) মহাকালেশ্বর:– শিব পুরান অনুযায়ী এককালে উজ্জয়নী নগরে চন্দ্রসেন নামে এক পরম শিব ভক্ত রাজা ছিলেন। মহাদেবের প্রিয় গনদের মধ্যে অন্যতম মনিভদ্র রাজা চন্দ্রসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একদিন মনিভদ্র চন্দ্রসেনকে চিন্তামনি নামে একটি দৈবমনি উপহার দেন। এই মনি রাজা চন্দ্রসেন তার গলায় সজ্জিত রাখেন। এরপর চন্দ্রসেনের যশ, খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দৈব মনির লোভে অনেক রাজা উজ্জয়নী আক্রমন করেন। তখন রাজা চন্দ্রসেন মহাদেবের আরাধনা শুরু করেন। রাজা চন্দ্রসেনের আরাধনা স্থলে একদিন গোপী নামে এক বিধবা মহিলা ও তার পাঁচ বছরের ছেলে উপস্থিত হন। রাজা চন্দ্রসেনকে চোখ বুঝে ধ্যান করতে দেখে সেই বালকেরও মহাদেবের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে। এরপর সেই বালক ঘরে ফিরে একটি ছোট পাথরকে শিব মনে করে ধ্যান শুরু করেন। ক্রমশ দুপুর ঘনিয়ে আসে এবং তার মা তাকে খাবার জন্য অনেকবার ডাকে কিন্তু বালকটি আসে না। তখন তার মা ঘরে এসে দেখে ছেলেটি চোখ বুঝে ধ্যান করছে। প্রচন্ড রেগে গিয়ে সেই মহিলাটি তার ছেলের সেই পাথরটি ফেলে দেন। চোখ খুলে ছেলেটি তা দেখে মহাদেব বলে অজ্ঞান হয়ে যায়। ছেলেটির যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখে সেখানে মহাদেবের আশীর্বাদে একটি শিবমন্দির তৈরি হয়ে গেছে। এই কাহিনী রাজা চন্দ্রসেনের কাছে পৌঁছায়। রাজা চন্দ্রসেন নিজে এসে সেখানে পুজো শুরু করেন। এই মহাদেবই পরে মহাকালেশ্বর নামে তিনলোকে বিখ্যাত হন।