প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে রাশিয়ার মাস্টার স্ট্রোক। তবে কী আসন্ন শীতকালেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ হবে?
রাজেশ রায়:— সবাই জানেন এখনও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলেই যাচ্ছে যা গত ফেব্রুয়ারীতে শুরু হয়েছিল। এখানে একটা বিষয় জানা আছে রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক। দেখুন ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরোক্ষভাবে ইউক্রেনকেই সমর্থন করছে, সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও যুদ্ধাস্ত্র পাঠাচ্ছে ইউক্রেনে তারা। যার জন্য রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এবার অনেকের মনে হবে এটা তো অনেল আগের খবর, রাশিয়া অনেকদিনই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে রাশিয়া জার্মানিতে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। যে জার্মানি রাশিয়ার প্রাকৃিতিক গ্যাসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা, সেই জার্মানিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে রাশিয়া। রাশিয়া এতবড় সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই রাতারাতি নেয় নি, তাহলে পেছনে রাশিয়ার গেমপ্ল্যান কী?? সবচেয়ে বড় কথা ইউরোপে শীত আসতে চলেছে। ইউরোপীয়ান দেশ গুলো শীতকালে কীভাবে টিকে থাকবে?? শীতকালে কী যুদ্ধ বন্ধ থাকবে?? রাশিয়া প্রাকৃতিক গ্যাসকে ব্যবহার করে কীভাবে এনার্জি ডিপ্লোম্যাসি করতে চাইছে আজ এইসব ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত পাঁচটি দেশের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে জার্মানি সবার উপরে। জার্মানি ৩৫ ভাগ গ্যাসের জন্য রাশিয়ার উপরই নির্ভরশীল ছিল। জার্মানি ছাড়াও ইটালিতে গ্যাস সরবরাহ অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে এবং স্লোভাকিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র ও অস্ট্রিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ধাপে ধাপে ইউরোপের অন্যান্য দেশ পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে রাশিয়া। রাশিয়া জার্মানি সহ অন্যান্য দেশে গ্যাস সরবরাহ করত নর্ড স্ট্রিম ১ গ্যাস লাইন দিয়ে যা রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগর হয়ে জার্মানি তে গেছে। সম্প্রতি রাশিয়া আরও একটি গ্যাস সরবরাহ লাইন নর্ড স্ট্রিম ২ তৈরি করছে, যুদ্ধের কারনে প্রজেক্ট বন্ধ আছে। এই প্রজেক্টের ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। রাশিয়ার সরকারি গ্যাস সংস্থা গ্যাজপ্রোম নর্ড স্ট্রিম ১ দিয়ে গ্যাস সরবরাহ ৬০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। যাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস কে রাশিয়া কুটনৈতিক হাতিয়ার করেছে। জার্মানি ইতিমধ্যে জানিয়েছে রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় তারা তাদের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহন করবে। ইউরোপে শীত আসছে, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বরে ইউরোপে ভয়ানক ঠান্ডা পড়ে যার জন্য স্থানীয় লোকেদের বাড়ি গরম রাখতে গ্যাসের প্রয়োজন হয়। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৪০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ আসত রাশিয়া থেকে। যদিও ইউরোপ ধীরে ধীরে রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমাতে শুরু করেছিল। রাশিয়া থেকে আসা গ্যাসের দুই তৃতীয়াংশ এবছরের শেষের দিকে ইউরোপ বন্ধ করত এবং ২০২৭ এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পুরোপুরি রাশিয়ান গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্ত এখন ইউরোপ পড়েছে ভয়ানক বিপদে। সামনেই শীত আসছে যখন তাপমাত্রা হবে মাইনাস ১০ থেকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি।
ইউরোপ গ্রীষ্মকালে গ্যাস কিনে সঞ্চয় করে রাখে শীতের জন্য কারন গ্রীষ্মে গ্যাসের দাম কম থাকে। জার্মানি ৩৫ শতাংশ ও ইটালি ৪০ শতাংশ গ্যাস কেনে রাশিয়া থেকে যা এখন পুরোপুরি সরবরাহ বন্ধ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে তাদের প্রত্যেক দেশে এই মহূর্তে প্রায় ৫৭ শতাংশ করে গ্যাস স্টোর আছে কিন্তু তাদের লক্ষ হচ্ছে ১ নভেম্বরের মধ্যে এই স্টোরেজ রাড়িয়ে ৮০ শতাংশ করা। জার্মানি ১ নভেম্বরের মধ্যে স্টোরেজ বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করতে চলেছিল। কিন্তু এখন যা অবস্থা ইউরোপের অনেক দেশ যেমন বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়ার স্টোরেজ ৮০ শতাংশ হবেই না। রাশিয়ার সরকারি গ্যাস সংস্থা গ্যাজপ্রোম এখনও পুরোপুরি সাপ্লাই বন্ধ করে নি তাতেই এই অবস্থা। বন্ধ পুরোপুরি করে দিলে অবস্থা কী হবে ভেবে দেখুন। এজন্য আসন্ন শীতকাল কে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এসময় বাধ্য হয়েও রাশিয়ার সাথে কীছু সমঝোতা করতে পারে।
২০২৭ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পুরোপুরি রাশিয়া থেকে গ্যাস নোওয়া বন্ধ করবে ঠিক করেছে। এই সিদ্ধান্ত ইউরোপ কেন নিয়েছে? এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে ইউরোপ প্রতিদিন গ্যাসের জন্য রাশিয়াকে প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন ডলার দেয়। এই ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির থেকে বাঁচতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই সিদ্ধান্ত নেয়। তই যে অর্থের হিসাবটা বলা হয়েছে এটা যুদ্ধ শুরু হবার আগের হিসাব, এখনতো আরও দাম বাড়ছে। রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কীছু বিকল্প পথ ভাবছে যেমন আমেরিকা থেকে লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি কেনা। কিন্তু এটা এত সহজ নয়, এলএনজি রাখার জন্য সঠিক পরিকাঠামো দরকার যা ইউরোপের অনেক দেশের কাছেই নেই, জার্মানির কাছেও নেই। তাছাড়া আমেরিকা থেকে এলএনজি জাহাজে করে আনতে খরচ অনেক বেশী পড়বে। সেজন্য আরও একটি বিকল্প পথ বলতে নরওয়ে, আজারবাইজান থেকে গ্যাস কেনার কথা চলছে, হয়ত এবছরের শেষে পাইপলাইন তৈরিও হয়ে যাবে কিন্তু কথা হচ্ছে এবছরের শীতে কী হবে??
বলা হচ্ছে এটাই রাশিয়ার মাস্টার প্ল্যান। রাশিয়ার গ্যাস সংস্থা গ্যাজপ্রোম গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার জন্য জানিয়েছে কানাডাতে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্ট রয়েছে যা নর্ড স্ট্রিম গ্যাস লাইনে ব্যবহৃত হবার কথা কিন্তু পশ্চিমা অবরোধের জন্য এটা আটকে গেছে। অর্থাৎ রাশিয়া ঘুরিয়ে ইউরোপকেই গ্যাস সরবরাহ বন্ধের জন্য দায়ী করল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পড়েছে সবচেয়ে বড় সমস্যায় কারন যত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হবে তত দাম বাড়বে গ্যাসের এবং তত বেশী লাভ হবে রাশিয়ার। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কে গ্যাসের দাম দিতে হচ্ছে রুবেলে। এই ইউরোপীয় ইউনিয়নই রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্যাংশন দিয়েছিল এখন তারাই রাশিয়ার কারেন্সি রুবেলকে শক্তিশালী করছে!! অর্থাৎ একদিক দিয়ে রাশিয়াকে যুদ্ধে অর্থনৈতিক সাহায্য করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নই। আবার ইউক্রেনকেও তারাই সাহায্য করছে। তাই বলতে গেলে এখন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অধিকাংশ খরচ ইউরোপীয় ইউনিয়নই ওঠাচ্ছে। এই মহূর্তে রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ঠিক যেন দাবা খেলা চলছে যেখানে রাশিয়া তার চাল দিয়ে দিয়েছে, এবার দেখার ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী করে? ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাতে তিনটি বিকল্প আছে৷ প্রথম রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করা, যাতে রাশিয়ার উপর থেকে সমস্ত স্যাংশান তুলে নেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্যাস সরবরাহ লিমিটেড করা অর্থাৎ নাগরিকদের মাথাপিছু গ্যাস সরবরাহের হার বেধে দেওয়া কিন্তু এটা অত্যন্ত বাজে সিদ্ধান্ত হবে। তৃতীয়ত বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধান। ইউরোপে সৌর শক্তি তেমন কোন কাজে আসবে না কারন প্রাকৃতিক কারনে ইউরোপ ঠান্ডা, সেক্ষেত্রে বায়ু শক্তি একটি বিকল্প উৎস হতে পারে তাও এটি গ্যাস কে রিপ্লেস করতে পারবে না। তবে একটি সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে ইউরোপ হয়ত কয়লাতে ফিরে যাবে। জার্মানি ইতিমধ্যে জানিয়েছে তারা কয়লার ব্যবহার করতে পারে। তবে এর অর্থ আবারও কার্বন নির্গমন এবং পরিবেশের ক্ষতি। তবে দেখা যাক ইউরোপ কী করে?? আসন্ন শীতকালেই হয়ত রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।